ঢাকাঃ ব্রিটিশ ভারতে কোম্পানি শাসনের গোড়াপত্তন ঘটেছিলো বাংলায়। তাই এখানেই বরাবর ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন, প্রতিবাদ, প্রতিরোধ জোরদার হয়েছে বেশি। বাংলার জনমনেও এর প্রভাব ছিলো বহুমাত্রিক। প্রতিটি বিবদমান বিষয় পরস্পর জটিল ব্যাপক এবং গভীরভাবে সম্পর্কিত ছিলো। রাজনৈতিক দলগুলোর সাথেও বাঙালি বিপ্লববাদী দলগুলোর সম্পর্ক ছিলো বিরোধপূর্ণ। এই পরিস্থিতি থেকে উদ্ভূত কোনো বিষয়ই স্বাতন্ত্র বজায় রেখে আলোচনা করা সম্ভব নয়। অর্থাৎ সোমেন চন্দ হত্যাদায় ইতিহাসের একটি বিশেষ অধ্যায়েরই নামান্তর। এই ঘটনা বাঙালির অতীত গৌরবময় ঐতিহ্যকে জাতির সামনে তুলে আনে।
বিশ শতকের প্রথমার্ধে বিদ্যমান ধর্মীয় উগ্রবাদ, দাঙ্গা, সমাজিক অস্থিরতা, শ্রেণিবৈষম্য, দুর্ভিক্ষ, দুর্যোগ ইত্যাদির সাথে যুক্ত হয়েছিলো নতুন উপসর্গ– বিশ্বযুদ্ধের উত্তাপ। এই বিশাল প্রেক্ষাপটে সোমেন চন্দের হত্যাদায় একটি ব্যতিক্রমী বিষয়। কারণ এই হত্যাকাণ্ড ঘটেছিলো ঢাকার রাজপথে। সুতারাং এর দায় আপনা থেকেই এসে যায় বাংলার কমিউনিস্ট বিরোধী কোনো পক্ষের উপর। কিন্ত বাস্তবতা ভিন্ন।
সোমেন চন্দ কাজে এবং কথায়, চেতনায় এবং প্রকাশে প্রকৃত কমিউনিস্ট ছিলেন। সমাজতন্ত্র, সাম্যবাদ, মার্কসবাদ এবং লেনিনবাদ ছিলো তার ধ্যানজ্ঞান। বিশ্বের সকল শোষিত মানুষের মুক্তির লড়াইয়ে তিনি রাজপথে নেমেছিলেন। একই সাথে তিনি সরব ছিলেন সাহিত্যকর্মে। সেখানেও তিনি ছিলেন এক ব্যতিক্রমী কথাসাহিত্যিক। বাংলা সাহিত্যে তার অবদান অমর। অথচ এই উচ্চ মেধা সম্পন্ন সাহসী এবং উদীয়মান সোমেনকে পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে হয়েছে মাত্র ২২ বছর বয়সে। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগে কে বা কারা এই হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত এবং এর দায় কার।
ভারতের স্বাধীনতাকামী দলগুলোর মাঝে বাঙালি বিপ্লববাদী দল এবং কমিউনিস্ট পার্টির কার্যক্রম দুটি বিশেষ দিকে এবং ভাবধারায় অগ্রসরমান ছিলো। এর বাইরে ছিলো অন্যান্য রাজনৈতিক দল যাদের লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য সুনির্দিষ্ট ছিলো না বা তাদের তেমন জোরালো কর্মকাণ্ডও ছিলো না। ইংরেজ সরকার তাদের মোটামুটি অনুগত রাখতে পেরেছিলো। বিভিন্ন মিশন পাঠিয়ে আলোচনার নামে রাজনৈতিক দলগুলোকে দমিয়ে রাখতে পেরেছিলো।
চল্লিশের দশকে অবস্থা পাল্টে যায়। ‘প্রলেতারিয়ান পাথ’ নীতি এবং আর্দশ বাস্তবায়নে কমিউনিস্টরা বরাবর সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে ছিলো। এরই অংশ হিসাবে বড় বড় কলকারখানায় ধর্মঘট, থানা ও সেনা-শিবির ধ্বংস, গ্রাম-শহরে জাতীয় সেনাবাহিনী গঠন করে সরকারি প্রতিষ্ঠানে আগুন ধরিয়ে দেয়া ইত্যাদি ছিলো তাদের সাধারণ কর্মসূচি। এদিক থেকে বাঙালি বিপ্লবী দলগুলোর সাথে কমিউনিস্টদের তেমন কোনো পার্থক্য ছিলো না। কিন্ত কমিউনিস্টদের কার্যক্রম পাল্টে যায় জার্মানি দ্বারা রাশিয়া আক্রান্ত হবার পর।
বিপ্লবী জোটের নেতা সুভাষ বোসও নতুন কর্মসূচি নিয়ে দেশত্যাগ করেছিলেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন শুধু দেশের ভেতরে আন্দোলন সীমাবদ্ধ রাখলে গন্তব্যে পৌঁছা যাবে না। প্রথমে শোষিত জনতার বন্ধুরাষ্ট্র রাশিয়ার দ্বারস্থ হন তিনি। সেখানে আশ্রয় না পেয়ে ফ্যসিবাদী হিটলারের স্মরণাপন্ন হন। পরিস্থিতি বিচারে সুভাষ বোস কমিউনিস্টদের আপাত প্রতিপক্ষ। এগুলোর নানা বিশ্লেষণ থাকতে পারে।
১৯৪১ সালের ২২ জুন কমিউনিস্ট দেশ রাশিয়া আক্রান্ত হয়। হিটলার তার প্রশিক্ষিত দুর্ধর্ষ নাৎসি বাহিনী নিয়ে অতর্কিতে হামলা চালায় প্রায় দুই হাজার মাইল দীর্ঘ সমাজতান্ত্রিক দেশ রাশিয়ার মস্কো সীমান্তে।
পরের মাসেই, ২২ জুলাই ইংরেজ সরকার এক প্রেস নোটে ঘোষণা দেয়- কমিউনিস্ট নেতৃবৃন্দ যুদ্ধ প্রচেষ্টায় সাহায্য করবে বলে প্রতিশ্রুতি দেয়ায় তাদের অধিকাংশকে মুক্তির আদেশ দেয়া হলো। একই সাথে পার্টি বৈধ বলে ঘোষণা করা হলো। সকল বন্দি মুক্ত না হওয়ায় সরকার পক্ষে কর্মসূচি দিতে কিছুটা সময় নেয় কমিউনিস্টরা। অবশেষে ১৫ ডিসেম্বর দেউলি বন্দি নিবাসে আবদ্ধ কমিউনিস্ট পার্টির প্রথম শ্রেণির নেতৃবৃন্দ ঘোষণা করেন–– বিপ্লবের কেন্দ্রভূমি রাশিয়া আক্রান্ত। সুতরাং এ য্দ্ধু ‘জনযুদ্ধ’। যে করেই হোক হিটলারকে রুখতে হবে। তারই জন্য আজ ব্রিটিশের সঙ্গে সহযোগিতা করা প্রয়োজন। ঘোষণার সাথে সাথে দলের ভেতরে আসে বাঁধভাঙ্গা জোয়ার।
জোয়ার এসেছে বিপ্লবীদের মাঝেও। সুভাষ নিজ প্রতিষ্ঠিত আজাদ হিন্দ রেডিও বার্লিন থেকে ঘোষণা দিয়েছেন, ‘অক্ষশক্তির আক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে ব্রিটেন যদি আমেরিকার দ্বারস্থ হতে লজ্জা না পায় তাহলে ভারতবর্ষের স্বাধীনতার জন্য অন্য কোন জাতির সাহয্যপ্রার্থী হওয়া আমার পক্ষে অন্যায়ও নয় অপরাধও হতে পারে না’। (আমি সুভাষ বলছি- শৈলেশ দে, পৃষ্ঠা-১৯)
ব্রিটিশ গোয়েন্দাদের ফাঁকি দিয়ে সুভাষ দেশ ছেড়েছিলেন ১৯৪১ সালের ১৭ জানুয়ারি। নিখোঁজ সুভাষ নিজের অবস্থান জানালেন প্রায় বছরখানেক পর, ৭ ডিসেম্বর। দিনটা আরো একদিক থেকে সাড়া জাগানো। এই দিন জাপান আমেরিকার সর্বশ্রেষ্ঠ নৌ ঘাঁটি পার্ল হার্বারে বোমা ফেলে মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যে এটি নিশ্চিহ্ন করে দেয়। এই ঘটনার জের ধরে কানাডা, ওলন্দাজ, উপনিবেশ দক্ষিণ অফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়া এবং নিউজিল্যান্ড মিত্রশক্তির সাথে যুক্ত হয় অর্থাৎ প্রকৃত বিশ্বযুদ্ধ ওই দিন থেকেই শুরু হয়।
শুধু তাই নয়, এই ৭ ডিসেম্বরেই বাংলার মন্ত্রিসভাতেও ব্যাপক রদবদল ঘটে যায়। প্রধানমন্ত্রী শেরে বাংলা এ. কে ফজলুল হকের যুক্ত মন্ত্রীসভা থেকে শরিকদল মুসলিম লীগ পদত্যাগ করে। ফজলুল হক ১২ ডিসেম্বর নিজদল কৃষক প্রজার সাথে সুভাষ গঠিত ফরোয়ার্ড ব্লক, হিন্দু মহাসভা ও তফসিলীদের নিয়ে প্রগতিশীল দল গঠন করেন এবং মন্ত্রীসভা পুনর্গঠন করেন।
একই দিনে ঘটে যাওয়া এই তিনটি ঘটনা সম্পূর্ণ কাকতালীয় নাও হতে পারে। কারণ জাপান ভারতীয়দের মনযোগ আকর্ষণ করতে পেরেছিলো দুটি কারণে, প্রথমত এশিয়া মহাদেশের হয়ে জাপান হয়তোবা ভারতের জনসাধারণের প্রতি সহানুভূতিশীল হবে আর অন্যটি জাপানের শৌর্যবীর্য। ক্রমাগত দেশ জয় করে জাপান ঝড়ের গতিতে এগিয়ে আসছিলো ভারতের দিকে। এছাড়া জাপানের প্রধানমন্ত্রী জেনারেল তোজো বারবার ঘোষণা দিচ্ছিলেন- ওহফরধ ভড়ৎ ঃযব ওহফরধহং. আজীবন অহিংসা লালনকারী গান্ধীজী অসহযোগ আন্দোলনের সিদ্ধান্ত নেন। দলের ভেতরে তুমুল আলোচনা শুরু হয়। অবশেষে কংগ্রেস প্রসিডেন্ট মৌলানা আবুল কালাম আজাদ, মুসলিম লীগ প্রধান মোহাম্মদ আলী জিন্নাহসহ অন্যান্য নেতাদের বৈঠক শুরু হয়। সুভাষ বোসের কর্মকাণ্ড নিয়েও এখন তাদের আর বিরোধিতা নেই অর্থাৎ ঐতিহাসিক ‘ভারত ছাড় ’ আন্দোলন আসন্ন।
১৯৪১ এর উত্তেজনা ১৯৪২ এর শুরুতেই চরমরূপ নেয়। বিপ্লবী দলগুলোসহ অধিকাংশ রাজনৈতিক দলের তখন এক শ্লোগান- ঙহব হধঃরড়হ-ওহফরধ, ঙহব বহবসু-ঊহমষধহফ, ঙহব মড়ধষ-ওহফবঢ়বহফবহপব. (আমি সুভাষ বলছি- শৈলেশ দে পৃ: ৪৭৮)। পূর্বের স্লোগান ‘এক পাই, এক ভাই নাহি দিব সমরে’ এর পরিবর্তে কমিউনিস্টদের নতুন স্লোগান– ‘চাল দাও , টাকা দাও, সেনা দলে ছেলে দাও’ স্লোগানে স্লোগানে রাজপথ মুখর হয়ে উঠে। এমনি এক উত্তেজনাকর মুহূর্তে ৮ মার্চ সর্বভারতীয় ফ্যাসিবাদ বিরোধী সম্মেলনের আয়োজন হয় ঢাকায়। বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ফ্যাসিবাদ বিরোধী স্লোগান আর ব্যানার নিয়ে এগিয়ে আসছে কমিউনিস্টদের খ- খ- দল। সোমেন চন্দ তেমনি একটি মিছিল নিয়ে এগিয়ে আসার পথে অতর্কিত হামলার শিকার হন। প্রকাশ্য দিবালোকে তাঁকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়।
এই পর্যায়ে এসে সোমেন চন্দের হত্যাদায় প্রশ্নের সদুত্তর হতে পারে– যারা বিশ্বজুড়ে আগ্রাসী অভিযান চালিয়ে দখলদারিত্বের খেলায় মেতেছিলো, যারা উপনিবেশ গেড়ে অন্যের সম্পদ নিজ দেশে পাচার করে শোষণের রাজত্ব কায়েম করেছিলো এই দায় তাদের। কিছুতেই এই দায় স্বাধীনতাকামীদের উপর বর্তায় না।
যদিও উত্তেজনার বশবর্তী হয়ে ভাই ভাইকে অবিশ্বাস করতে পারে এবং অনাকাঙ্খিত যে কোন ঘটনা ঘটে যেতে পারে ।
ভারতীয়রা শৃঙ্খল মুক্তির সংগ্রাম করেছে। এটি তাদের মৌলিক অধিকার কিন্ত অন্যের দেশ দখল করা কারো অধিকার হতে পারে না। অক্ষশক্তি বা মিত্রশক্তি বলে ভারতের কিছু ছিলো না। দুটো শক্তি তাদের শক্তি প্রদর্শন করেতে গিয়ে বিশ্বজুড়ে অশান্তি ছড়িয়ে দিয়েছিলো। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রতিশোধ স্বরূপ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অবতারণা ঘটেছে। শক্তির মহড়া দিতে গিয়ে এই দুটো যুদ্ধে দুই পক্ষই তাদের বড় বড় অর্জনগুলো হারিয়েছে। তবে প্রাপ্তি বলে যদি কিছু থাকে সেটি হয়েছে ভারতের স্বাধীনতা লাভ।
সোমেন চন্দের রক্ত বৃথা যায়নি। সাম্রাজ্যবাদীদের সাথে কমিউনিস্টদের আজীবনের লড়াই। যুদ্ধের কৌশল আর নীতিগত বিষয় এক নয়। যুদ্ধশেষে ব্রিটিশ ভারত থেকে তাদের উপনিবেশ গুটিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছিলো। এর পেছনে রয়েছে ভারতীদেয় সশস্ত্র সংগ্রাম। বিশ্বের সকল শোষিত জনগণের প্রতি সহানুভূতিশীল রাশিয়ার পাশে দাঁড়িয়ে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে কমিউনিস্টরা বাংলার মর্যাদা বিশ্বের দরবারে পৌছে দিয়েছে।
ব্রিটিশ স্বেচ্ছায় ভারত ছেড়ে যায়নি। ব্রিটিশের আতঙ্ক সুভাষ বোস জার্মানিতে আশ্রয় নিয়ে নিজ দেশের স্বাধীনতার জন্য লড়াই করেছেন। বিভিন্ন অঞ্চলে মিত্র বাহিনীর পরাজয়ের পর বা পশ্চাদপসরণের পর ভারতীয় সৈন্যদের কথা তারা ভাবেনি। সৈন্যরা বিভিন্ন শত্রু শিবিরে বন্দি অবস্থায় মানবেতর জীবন যাপন করেছে। সুভাষ বোস তাদের মুক্তির ব্যবস্থা করেছেন। তাদের মোটিভেট করে নিজের দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করেছেন। এভাবে সামরিক এবং প্রবাসী ভারতীয়দের নিয়ে গঠন করেছেন ‘আজাদ হিন্দ ফৌজ’। দেশের ভেতরে বিচ্ছিন্ন বিপ্লবীদলগুলোকে নিয়ে ১৯৩৯ সালে গঠন করেছিলেন ‘ফরোয়ার্ড ব্লক’ । এভাবেই তিনি দেশের জন্য নিজের জীবন বাজি রেখে কর্মময় স্বার্থক জীবন পাড়ি দিয়েছেন। ১৯২১ সালে ওঈঝ এর চাকরি ত্যাগ করে দেশ সেবার ব্রত নিয়ে তিনি প্রতিটি মুহূর্ত কাজে ব্যয় করেছেন। কিন্ত প্রবল পরাক্রমশালী হিটলারকে থামাতে পেরেছিলো একমাত্র রাশিয়া। রাশিয়া বিশ্বযুদ্ধ সমাপ্তির সূচনা করেছিলো। বিশ্বযুদ্ধে পরোক্ষভাবে জয়ী দেশ ভারত।
এ কৃতিত্ব সোমেন চন্দের দল কমিউনিস্ট পার্টির এবং বিপ্লবী দলগুলোর। রাজনৈতিক দলগুলোর এক জোট হয়ে ভারত ছাড় আন্দোলনে সর্বোপরি ভারতের জনগণের অবদান অনস্বীকার্য।
সোমেন চন্দ হত্যাদায় পর্যবেক্ষণ জনে জনে ভিন্ন হতে পারে। সকল মত ও ব্যাখ্যা বিশ্লেষণই মূল্যবান। এর সবই বাঙালির ইতিহাসকে সমৃদ্ধ করবে। সোমেন চন্দের সংগ্রামী জীবনের স্বার্থকতা এখানেই। এরপরও এই কথা ঠিক যে, সোমেন চন্দ ফ্যাসিবাদ বিরোধী সংগ্রামের শহীদ।
লেখক : সদস্য, প্রগতি লেখক সংঘ
আগামীনিউজ/প্রভাত