ঢাকাঃ বঙ্গবন্ধুর মূর্তি ভাঙ্গাতে আপনারা যারা ক্ষুব্ধ হয়েছেন, আপনাদের সাথে আমিও ক্ষুব্ধ। কিন্তু আপনাদের মত অতটা অবাক হয়নি, অতটা বিষ্ময় জাগেনি আমার। আমি-আমরা জানতাম এমনটা হবে। এটা জেনে আরও ভয়াবহ পরিণতি ও অবস্থার জন্য অপেক্ষা করছি। খুব বেদনাবোধ করছি এ জন্য যে, চোখের সামনে চীরচেনা ও কল্পনার এই বাংলাদেশকে ক্রমশ বদলাতে দেখছি। কিছু করতে না পারার ব্যাথা অনুভব করছি।
জীবন-যৌবনের অতি গুরুত্বপূর্ণ সোনালী সময়গুলো যে স্বপ্ন ও ভাবনায় ব্যয় করেছি, তাকে কেবলি বিপুল সময়ের অপচয় মনে হয়। কত সাথী-সহযোদ্ধাকে হারিয়েছি, তাঁদের জন্য শুধু নিজেকে খুব অপরাধী মনে হয়।
কওমী মাদ্রাসা ও মৌলবাদের বিপদ নিয়ে অনেকদিন ধরে ব্লগিং ও লেখালেখি করছি। এখন যা দেখছেন এগুলো হচ্ছে তাদের দেয়া সামান্য সুড়সুড়ি ও মহড়া। মাঠের হাওয়া বোঝার আগাম কেরামতি ও মুজরকি। হাওয়াই দাওয়াইয়ে এরা যাবে না। তারা তাদের নকশায় কাজ করছে। আমরা আমাদের দায়িত্ব ভুলে বসে আছি। তাদেরকে দূর্বল ভাবছি, অবজ্ঞা করছি, খাটো করে দেখছি। আর একটা শ্রেণী এসব দেখার দায়িত্ব কথিত মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সরকারের কাঁধে দিয়ে হাত-পা ছুড়ছেন, উন্নয়ন-অগ্রগতির ফর্দি পড়ছেন।
বঙ্গবন্ধু শুধু একজন ব্যক্তি নয়, একটি প্রতিষ্ঠান, একটি প্রতিক। তিনি স্বাধীনতার স্তপতি। বাংলাদেশ সৃষ্টির মূল কারিগর। এখানে দু’টি শব্দ গুরুত্বপূর্ণ একটি স্বাধীনতা অন্যটি বাংলাদেশ। এই শব্দের সাথে, আবেগ-বাস্তবতার সাথে এই ব্যক্তির জীবন, সম্মান, মর্যাদা, অবদান সম্পর্কিত। বাংলাদেশ ও স্বাধীনতার সাথে তার অস্তিত্ব অনেকভাবে জড়িত। সেই ব্যক্তির মূর্তিকে আঘাত করার অর্থ বাংলাদেশের স্বাধীনতার উপর আঘাত হানা। আর এই কাজটি যারা করেছে তারা গোপনে করেনি। প্রকাশ্যে হাজার লোকের সামনে ঘোষণা দিয়ে করেছে।
মূর্তির বিরুদ্ধে তারা ক্রমাগত ফতুয়া দিচ্ছে। শুধু বঙ্গবন্ধু নয়, যে কোন ভাষ্কর্য-মূর্তির বিরুদ্ধে তাদের অবস্থান-ঘোষণা স্পষ্ট। বুঝতে পারছেন তাদের নকশার বিস্তিৃতি? তারমানে শহীদমিনার, স্মৃতিসৌধ, অপরাজেয় বাংলা কোন কিছুকেই তারা হিসেবের বাইরে রাখেনি। উল্টো শর্ত দিয়েছে মুসলমানের দেশে মূর্তি করা যাবে না, করলে আল্লাহর ৯৯ নামাঙ্কিত কুতুবমিনারের মত মুজিবমিনার করতে হবে।
যাঁর উপর আঘাত করেছে সেই বঙ্গবন্ধুর হাতে গড়া দল আওয়ামী লীগ এখন ক্ষমতায়। তাঁরই কন্যা দেশটির প্রধানমন্ত্রী। তাঁকে ভালবেসে কওমীওয়ালারা ‘কওমী জননী’ উপাধি দিয়েছেন। এই মৌলবাদী হেফাজতের সাথে তিনি বোঝাপড়া করেই ক্ষমতায় থাকতে চান। এ যাত্রায় এ ইস্যুতে তাদের সাথে কোন কৌশল-সুবিধায় একটা রফা করে নেবেন জানি, কিন্তু তারপর? আপনারা কি নিরাপদ হয়ে গেলেন? দেশ ও স্বাধীনতা কি অরক্ষিত হলো?
বঙ্গবন্ধুর পরিচয় মূর্তিতে নয়, কীর্তিতে। এখন আপনাদের কাছে প্রশ্ন, বঙ্গবন্ধুর মূর্তি বড় না তাঁর কীর্তি বড়? মূর্তি ভাঙ্গার জন্য আপনারা প্রচন্ড ক্ষেপেছেন। বলছেন এটা আপনাদের অস্তিত্বের উপর আঘাত। তাদের প্রতিরোধের কথা বলছেন। তাইতো, আমিও তাই মনে করি। মৌলবাদীদের এ অপকর্ম সামান্য ও প্রতিকী বিষয় হলেও এর অর্থ-তাৎপর্য অনেক গভীর ও সুদূরপ্রসারী।
এবার আসা যাক বঙ্গবন্ধুর কীর্তি কি? বঙ্গবন্ধুর সাথে যুক্ত হয়ে আছে বাংলাদেশ রাষ্ট্র ও তার স্বাধীনতা। রাষ্ট্র, ভাষা, স্বাধীনতা এগুলো কোন বায়বীয় বিষয় নয়। তার অর্থ, বোধ-বিবেচনা ও মূল্যবোধের কতক মৌলিক দিক আছে। সেগুলো কি তারা মানে? সমর্থন করে? চর্চা ও পালন করে? তাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও পাঠক্রমে কি এর আলাপ আছে? আমরা যেভাবে মানি, সম্মান করি, পালন-চর্চা করি, তারা কি করে? করে না।
তারা স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, একুশ ফেব্রুয়ারী, জাতীয় শোক দিবস পালন করে? করে না। বাঙালি সংস্কৃতি, বর্ষবরণ, গণতন্ত্র, সংবিধান মানে না। মানবাধিকার, বাক-ব্যক্তি স্বাধীনতা, মুক্তবুদ্ধির চর্চা, জাতীয় সঙ্গীত এগুলোর কোন কিছুকে তারা সমর্থন করে না, মানে না।
বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় চারমূলনীতির কথা বলেন, তার কোন নীতি-স্তম্ভকেই তারা মানে, সমর্থন করে? বাঙালি জাতিয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র বা সামাজিক ন্যায় বিচার যাই বলেন এর কোনটিকেই তারা সমর্থন করে না, মানেও না। তারা বর্তমান সংবিধানকেও মানুষের তৈরী বলে একে মানে না? তারা আল্লাহ সার্বভৌমত্ব ছাড়া কোন কিছুকে স্বীকার করে না। তারা রাষ্ট্রকে কোন ইহোলৌকিক প্রতিষ্ঠান মনে করে না। যদিও শাসকদল নিজেরাই এসব নীতির কতটুকু মানেন, পালন করেন সে প্রশ্ন আছে।
আমরা দেখছি বর্তমান শাসক ক্রমাগতভাবে তাদেরকে নানা ইস্যু-বিষয়ে ছাড় ও সুবিধা দিয়ে যাচ্ছেন। বিমানবন্দরে লালন ভেঙ্গেছে, মতিঝিলের বলাকা ভেঙ্গেছে, হাইকোর্টের জাস্টিশিয়া সরিয়েছেন, নারীনীতি স্থগিত করেছেন, কওমীর শিক্ষানীতি মানেনি, পাঠ্যপুস্তকে পরিবর্তন এনেছেন। কওমীর ৫ দফা শর্তেই সনদের স্বীকৃতি দিয়েছেন। যাত্রা-পালাগানের অনুষ্ঠান বন্ধ করছেন। নারীদের খেলাধূলা বন্ধ করছেন। ইত্যাদি।
আপনারা কি সত্যিই বিশ্বাস করেন হেফাজত শেখ হাসিনাকে সম্মান-সমর্থন করে, তাঁর মঙ্গল কামনা করে? যদি বলেন হ্যাঁ, তাহলে বলবো আপনারা রাজনীতির শিশু। আর যদি বলেন না, এটা নেত্রীর ক্ষমতাকেন্দ্রীক রাজনীতির কৌশল, তিনি অতটা নির্বোধ নন। তাহলে বলবো তিনি দুধ-কলা দিয়ে অজগর পুষছেন এবং তাদের পেটে ঢুকে বসে আছেন। অজগর সাপের শিকারকে পদ্ধতি বড় অদ্ভুদ। প্রথমে সে শিকার ধরে তাকে পেঁচিয়ে অপেক্ষা করে, যতক্ষন না তার দম ফুরিয়ে যায়।
তারপর শিকারের মাথার দিক থেকে ধীরে ধীরে গিলতে শুরু করে। মাথা গিলে ফেললে শিকারের আর কিছু করার ক্ষমতা থাকে না। একটা অজগর তার চেয়ে ১০-১২ গুণ শিকারও গিলে ফেলতে পারে। শিকার গিলতে অজগর সাপ সময় নেয় কয়েক দিন, আর হজম করতে কয়েক মাস। মৌলবাদ অজগরের মত এমনই এক ভঙঙ্কর বিষধর অপশক্তি!
আপনারা যারা বঙ্গবন্ধুর ভাষ্কর্য ভাঙ্গলো বলে চিৎকার করছেন? কিন্তু এই মৌলবাদীরা যে বঙ্গবন্ধুর কীর্তির বিরুদ্ধে কাজ করছে, তাঁকে অস্বীকার করছে, তাঁকে ধ্বংস করছে, সে আলাপ করছেন না। সে কারণেই আপনাদের কাছে প্রশ্ন রাখছি, বঙ্গবন্ধুর মূর্তি বড় না তাঁর কীর্তি বড়? বঙ্গবন্ধুর মূর্তিতে না হয় পাহাড়া বসিয়ে কিছুদিন রক্ষা করলেন, কিন্তু বঙ্গবন্ধুর কীর্তিকে রক্ষা করবেন কিভাবে?
লেখক: প্রক্টর, ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়, কানাডা