ইসলামের ইতিহাস ও আধ্যাত্মিকতার বিভিন্ন দিকের ওপর নির্ভর করে মানুষের বিশ্বাস, সংস্কৃতি ও আচার-আচরণ গড়ে উঠেছে। বাংলাদেশের মত অনেক মুসলিম দেশে সুফি দরবেশ ও অলী-আউলিয়াদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও ভালবাসা রয়েছে, কারণ তারা ইসলাম প্রচার ও সমাজে আধ্যাত্মিক আলো ছড়িয়ে দিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। বিশেষত, বাংলাদেশে ইসলামের বিস্তারে সুফি ও দরবেশদের ভূমিকা ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ।
মাজার ও দরগাহ নিয়ে বিরোধ:
মাজার ও দরগাহ নিয়ে মতবিরোধ মূলত বিভিন্ন ইসলামিক মতাদর্শের মধ্যে রয়েছে। যেমন সালাফি, আহলে হাদিস, ওহাবি এবং লা-মাজহাবি গোষ্ঠী মাজারের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেয়, কারণ তারা বিশ্বাস করে যে আল্লাহর কাছে সরাসরি ইবাদত করা উচিত এবং কোনো মাধ্যম ব্যবহার করা উচিত নয়। অন্যদিকে, বহু মুসলিম সুফি আধ্যাত্মিকতা অনুসরণ করে অলী-আউলিয়াদের মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য লাভের চেষ্টা করেন। তারা মনে করেন যে অলী-আউলিয়াদের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করা তাদের প্রতি ভালবাসা ও সম্মান প্রকাশের একটি মাধ্যম।
ফেতনার প্রসঙ্গ:
“আল-ফিতনা তো আশাদ্দু মিনাল কাতেল” (বাকারা ২:২১৭) — এর মাধ্যমে বোঝানো হচ্ছে যে ফিতনা বা বিদ্বেষ ছড়ানো সমাজের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর এবং তা হত্যার চাইতেও জঘন্য পাপ। আজকের সময়ে ধর্মের দোহাই দিয়ে ফেতনা ছড়ানোর প্রবণতা কিছু গোষ্ঠীর মধ্যে দেখা যায়, এবং এটাই ইসলামের মূল শিক্ষা থেকে মানুষকে দূরে সরিয়ে দিতে পারে।
সম্মান ও ঐক্যের আহ্বান:
ইসলামের মূল শিক্ষাগুলো হলো একতা, সহনশীলতা এবং পারস্পরিক শ্রদ্ধা। মাজার বা দরগাহ নিয়ে যারা বিরোধ সৃষ্টি করছে, তাদের কর্মকাণ্ড যদি ফিতনার জন্ম দেয়, তবে তা ইসলামের মূল শিক্ষার বিরোধী। আমাদের উচিত এমন কাজে জড়ানো যা সমাজে শান্তি, ভ্রাতৃত্ব এবং ইসলামের প্রকৃত আধ্যাত্মিক মূল্যবোধ বজায় রাখে।
রাজনৈতিক নেতাদের ভূমিকা:
যেসব রাজনৈতিক নেতা নির্বাচনী কর্মসূচী শুরুতে দরগাহ জিয়ারত করেন, তারা সাধারণত দেশের আধ্যাত্মিক ঐতিহ্যের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে এটি করেন। তাদের এসব কর্মকাণ্ডকে সরাসরি শিরকের সাথে তুলনা করা সম্ভবত সঠিক হবে না, কারণ তাদের মাজার জিয়ারত মূলত ইসলামের আধ্যাত্মিক দিককে সম্মান জানানো এবং নিজেদের ধর্মীয় মানসিকতা প্রকাশের একটি ধারা হিসেবে দেখা যেতে পারে।
সর্বোপরি, আমাদের উচিত ইসলামের মূল শিক্ষা—শান্তি, ভ্রাতৃত্ব, এবং মানবতার প্রতি সহানুভূতির আলোকে ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান ও মতপার্থক্যগুলোকে দেখার চেষ্টা করা।
প্রকৃতপক্ষে, ইসলাম এমন এক ধর্ম যা শান্তি, সত্য, এবং কল্যাণের বার্তা বহন করে। ইসলামের প্রচার ও প্রসারের ক্ষেত্রে পীর, ওলি, আউলিয়াদের অবদান কোনোভাবেই অস্বীকার করা যা য় না। তারা আল্লাহর পথে এবং সত্যের পথে মানুষকে আহ্বান করেছেন, তাদের মাজারগুলো সাধারণত সেই স্মৃতি ও শিক্ষার প্রতীক হিসেবে দেখা হয়। তবে, আজকের যুগে যেভাবে কিছু ভণ্ড ও মুরিদেরা সেই মাজারকে ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেছে, তা সত্যিই দুঃখজনক।
ইসলামের দৃষ্টিতে কবর বাধানো বা মাজার গড়া নিয়ে বিতর্ক থাকলেও, মূল সমস্যা প্রকৃত শিক্ষা ও উপলব্ধির অভাব। অনেক ভণ্ড মুরিদ ও তথাকথিত ধর্ম ব্যবসায়ীরা পীর আউলিয়াদের প্রকৃত শিক্ষার পরিবর্তে তাদের কবরকে কেন্দ্র করে অন্ধবিশ্বাস ও ব্যবসা তৈরি করেছেন। ফলে অনেক সময় প্রকৃত শিক্ষার পরিবর্তে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হচ্ছে।
মাজার ভাঙার ইস্যুটি অত্যন্ত সংবেদনশীল। মাজার ভাঙা দিয়ে সমস্যার সমাধান না করে, প্রকৃত শিক্ষার মাধ্যমে ভ্রান্ত ধারণা দূর করার চেষ্টা করাই বাঞ্চনীয়। ইসলামে সহিংসতা নয়, বরং শান্তি ও সহনশীলতার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান চাওয়া হয়। তাই আমাদের উচিত ধর্ম ব্যবসায়ী ও ভণ্ডদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা এবং প্রকৃত ইসলামের শিক্ষায় সবাইকে আলোকিত করা।
আল্লাহ আমাদের সকলকে সঠিক পথের দিশা দিন এবং শান্তি ও কল্যাণের পথে চলতে সহায়তা করুন, আমিন।
লেখকঃ একে এম রেজাউল করিম