Dr. Neem on Daraz
Victory Day

ভোগবাদী প্রতিযোগিতার মুনাফাবাদী সংস্কৃতি


আগামী নিউজ | ড. অভিনু কিবরিয়া ইসলাম প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ১৮, ২০২১, ০৩:১৬ পিএম
ভোগবাদী প্রতিযোগিতার মুনাফাবাদী সংস্কৃতি

ছবি: আগামী নিউজ

ঢাকাঃ আমাদের দেশে বর্তমান আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতিতে পুঁজিবাদী লুটপাটতন্ত্র ও তার দর্শন বিস্তৃতি লাভ করায়, কেন্দ্র থেকে তৃণমূলে গণমুখী সাংস্কৃতিক তৎপরতার স্থান নিয়েছে আত্মমুখিনতা ও ভোগবাদী প্রতিযোগিতার মুনাফাবাদী সংস্কৃতি। এর পাশাপাশি লুটপাট ও শোষণের ধারাকে নিরঙ্কুশ করতে সমাজ ও রাষ্ট্রে গণতান্ত্রিক পরিসর সংকুচিত হওয়ায়, পরমতসহিষ্ণুতা ও গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিও হারিয়ে যাচ্ছে সমাজ থেকে।

সামাজিক ও নৈতিক মূল্যবোধগুলো ক্ষয়ে যাচ্ছে। প্রাণ-প্রকৃতির সাথে মানুষের এবং মানুষের সাথে মানুষের বিচ্ছিন্নতা বর্তমান নিওলিবারেল যুগের বৈশিষ্ট্য। সেই বিচ্ছিন্নতাসৃষ্ট দার্শনিক শূন্যতা ও নৈতিকতার অবক্ষয় থেকে মুক্তি পেতে মানুষ ধর্মের কাছে আশ্রয় খুঁজছে। এ প্রেক্ষাপটে আমাদের এ অঞ্চলে সমাজের সংশ্লেষণী ক্ষমতায় ধর্মের যে উদারবাদী ব্যাখ্যা দাঁড় হয়েছিলো এই জনপদে, বাইরে থেকে আমদানিকৃত রক্ষণশীল ও সংকীর্ণ ধর্মীয় ব্যাখ্যা তাকে প্রতিস্থাপিত করার এক উর্বর ক্ষেত্র পেয়েছে।

ভোগবাদী মুনাফার দর্শন এবং পশ্চাদপদ উগ্র মৌলবাদী দর্শন আপাতদৃষ্টিতে পরস্পরবিরোধী মনে হলেও, আমরা দেখছি তা পরস্পরের পরিপূরক হিসেবেই কাজ করছে। আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতির পাটাতন শক্ত না থাকায়, এ সময়কালে, সোশ্যাল মিডিয়া, ইন্টারনেট ও স্যাটেলাইট চ্যানেলের মাধ্যমে তরুণদের মধ্যে বহিরাগত সংস্কৃতির অন্ধ অনুকরণের ঘটনা ঘটছে। আমাদের নিজস্বতার পাটাতন দুর্বল থাকায় পাশ্চাত্য সংস্কৃতি, ভারতীয় পুঁজিনির্ভর সংস্কৃতি কিংবা ধর্মের কট্টর ও সংকীর্ণ ব্যাখ্যার অনুপ্রবেশের প্রভাবে এক জগাখিচুড়ি প্রজন্ম তৈরি হয়েছে, যা নিজের শেকড়কেই ভুলে যেতে বসেছে।

এই বাস্তবতার মুখে আমাদের বুদ্ধিজীবীরাও যেন খেই হারিয়ে ফেলছেন। রাষ্ট্রীয় আনুকূল্যের প্রত্যাশায় অনেকে যেমন বিভিন্নভাবে স্তুতিসর্বস্ব সভাকবিতে পরিণত হয়েছেন, আবার কেউ কেউ পুরনো ধর্মীয় পুনর্জাগরণবাদী চিন্তাকেই বিভ্রান্তিকর ছদ্মবেশে উপস্থাপন করছেন।

একথা সত্য যে, ফরাসি বিপ্লব বা এনলাইটমেন্ট যে মানবকেন্দ্রিকতার জয়গান গেয়েছিল, পুঁজির দাপটে খোদ সেই মানবতাই আজ বিপন্ন হয়ে উঠছে। তার পাশাপাশি এ-ও সত্য যে, এনলাইটমেন্টজাত আধুনিকতা উৎপাদন ব্যবস্থার বিকাশের সাথে সঙ্গতি রেখেই এমন কিছু মানবিক মূল্যবোধ জন্ম নিয়েছে যা অনেক পুরাতন সামন্ত ও পশ্চাদপদ সংস্কারকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে। মানুষকে জ্ঞানকাণ্ডের কেন্দ্রে আনার প্রবণতা মানুষের আত্মশক্তির কিছুটা উন্মেষ ঘটিয়েছে একদিকে, অপরদিকে প্রকৃতির সাথে মানুষের, মানুষের সাথে মানুষের বিচ্ছিন্নতা ঘটিয়েছে। এই এনলাইটমেন্টজাত আধুনিকতার যৌক্তিক সমালোচনা প্রয়োজন, কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে এর দ্বারা সৃষ্ট সাংস্কৃতিক ও দার্শনিক সংকটের প্রতিক্রিয়ায় আমাদের দেশে একদল বুদ্ধিজীবী সঠিক অবস্থান নিতে পারেননি। তারা ‘অর্গানিক’ বুদ্ধিজীবী হয়ে উঠতে চেয়ে ট্রাডিশনাল তো হয়েছেনই, কখনো কখনো তাদের ‘অর্গানিক’ হয়ে ওঠার প্রচেষ্টা ‘সংখ্যাগুরুর আইডেন্টিটি রাজনীতি’র হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে।

আধুনিকতাকে অতিক্রম করতে যাওয়ার বাহানায় এ ধরনের বুদ্ধিজীবীরা পুরনো সামন্তীয় ভাবালুতা ও আধ্যাত্মিকতাকে নতুনভাবে সাজিয়ে নিয়ে তার ওপর ভর করতে চেষ্টা করছেন। তারা এটা অনুধাবন করতে ব্যর্থ হয়েছেন যে, ধর্মাশ্রয়ী পুনর্জাগরণবাদী ধ্যান-ধারণা সাময়িক ঢেউ তুললেও তা টেকসই অবস্থানে যেতে পারবে না। কারণ তার বিকাশের জন্য অর্থনৈতিক-সামাজিক-রাজনৈতিক ক্ষেত্রে যে আর্থ-সামাজিক কাঠামো প্রয়োজন, বর্তমান পৃথিবীতে বাস্তব জীবনযাপনের মূলধারা সেদিকে নয়।

বুর্জোয়া বিপ্লবের পর যত সময় অতিক্রান্ত হচ্ছে, বুর্জোয়া শক্তি ফ্যাসিবাদের দিকে ধাবিত হচ্ছে, তারা ক্রমেই তাদেরই একদা ঘোষিত মানবাধিকার, গণতন্ত্র, সেক্যুলারিজমকে আর ধারণ করতে পারছে না। সোভিয়েত পতনের পর, বর্তমান যুগে সাম্রাজ্যবাদ তার ‘ওয়ার অন টেরর’ নামক সাম্রাজ্যবাদী প্রকল্প হাজির করার প্রক্রিয়ায় মানুষ হত্যা করেছে, এ কথা তো অস্বীকার করার জো নেই। কিন্তু সাম্রাজ্যবাদের মুনাফাবাদী এই নয়া ‘ক্রুসেড’ ডিসকোর্সের পাল্টা বয়ান হিসেবে রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ‘জিহাদ’কে নানা মাত্রিকতায় তত্ত্বায়ন প্রকারান্তরে সাম্রাজ্যবাদী প্রকল্পের অন্তর্গত বাইনারিকেই শক্তিশালী করে এবং সাম্প্রদায়িক ধ্যান-ধারণাকে উস্কে দেয়। শোষিত, মজলুম, নিম্নবর্গ বা প্রলেতারিয়েত যে নামেই ডাকা হোক না কেন, জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে তাদের মধ্যে বিভেদ নেই, এবং এ শতাব্দিতে তাদের সংগ্রামকে ধর্ম বা জাতীয়তার আইডেন্টিটি পলিটিক্সের ছাতার নিচে হাজির করার প্রচেষ্টা শাসকশ্রেণি, জালিম, উচ্চবর্গ বা বুর্জোয়াদের প্রকৃত চরিত্রকে আড়াল করে দেয়, লড়াইয়ের মূল লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত করে দেয়।

লেখক: সহকারি অধ্যাপক, যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

আগামীনিউজ/প্রভাত

আগামী নিউজ এর সংবাদ সবার আগে পেতে Follow Or Like করুন আগামী নিউজ এর ফেইসবুক পেজ এ , আগামী নিউজ এর টুইটার এবং সাবস্ক্রাইব করুন আগামী নিউজ ইউটিউব চ্যানেলে