ঢাকা : আমাদের দেশে সড়ক ও মহাসড়কে আইন না মানার প্রবনতা, অতিরিক্ত গতিতে গাড়ি চালানো এবং বিপজ্জনক ওভারটেকিংয়ের কারণে ঘটছে বেশিরভাগ সড়ক দুর্ঘটনা। ফলে সরকারের পক্ষ থেকে নানা উদ্যোগ নিলেও থামাতে পারছে না এই মৃত্যুর মিছিল। এমনটাই জানিয়েছেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অ্যাক্সিডেন্ট রিসার্স ইনস্টিটিউটের (এআরআই) অধ্যাপক শামসুল ইসলাম।
তিনি আগামীনিউজ ডটকমকে বলেন, ‘উন্নত বিশ্ব যেভাবে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যমাত্রার ভিত্তিতে কার্যকরী পদক্ষেপ নেয় আমরা তা না করে ধার করা কিছু লোক নিয়ে টাস্কফোর্স গঠন বা বিশেষ কমিটি করি। আসলে এভাবে আর যাই হোক সড়ক নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়।’
এই বিশেষজ্ঞ আরো বলেন, ‘সড়কে যেভাবে মানুষ মারা যাচ্ছে তা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। যত দ্রুত সম্ভব দুর্ঘটনা নিরসনে আমাদের ব্যবস্থা নিতে হবে।’ দুর্ঘটনা রোধ করতে একটি সমন্বিত কমিটির মাধ্যমে কাজ করা প্রয়োজন বলেও মনে করেন তিনি।
সম্প্রতি বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির বার্ষিক প্রতিবেদনে জানা যায়, ২০১৯ সালে সড়ক দুর্ঘটনা আগের বছরের সমপরিমাণ হলেও প্রাণহানি ৮ দশমিক ০৭ শতাংশ বেড়েছে। সড়কে ৫ হাজার ৫১৬টি দুর্ঘটনায় ৭ হাজার ৮৫৫ জন নিহত ও ১৩ হাজার ৩৩০ জন আহত হয়েছেন।
তুলনামূলক তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ২০১৮ সালের তুলনায় সদ্য বিদায়ী ২০১৯ সালে পথচারীকে গাড়িচাপা দেওয়ার ঘটনা ১৪ দশমিক ৮২ শতাংশ, বেপরোয়া গতির কারণে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে খাদে পড়ার ঘটনা ১ দশমিক ৮৯ শতাংশ ও ট্রেন-যানবাহন সংঘর্ষের ঘটনা শূন্য দশমিক শূন্য ৮ শতাংশ বৃদ্ধি পেলেও দেশের সড়ক-মহাসড়কের উন্নয়ন, ব্লাকস্পট নিরসন, রোড ডিভাইডার স্থাপন, সড়ক নিরাপত্তামূলক প্রচারণার কারণে মুখোমুখি সংঘর্ষের ঘটনা ১১ দশমিক ৩৬ শতাংশ কমেছে।
ধরণ বিশ্লেষণে দেখা গেছে, এই বছর মোট সংঘটিত দুর্ঘটনার ৩২ দশমিক ৩৮ শতাংশ জাতীয় মহাসড়কে, ৩৭ দশমিক ৫১ শতাংশ আঞ্চলিক মহাসড়কে, ২১ দশমিক ৩ শতাংশ ফিডার রোডে সংঘটিত হয়।
দুর্ঘটনার কারণ হিসেবে সংগঠনটি তাদের পর্যবেক্ষণে এক নম্বরে বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালানো, ওভারটেকিং প্রবণতা, চালকের অদক্ষতা, যাত্রী ও পথচারীদের অসতর্কতা, রেলক্রসিং ও মহাসড়কে হঠাৎ ফিডার রোড থেকে যানবাহন উঠে আসা এবং ট্রাফিক আইনের দুর্বল প্রয়োগকে দায়ী করেন।
নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা) বাংলাদেশের সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে যে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, সেখানে সড়ক দুর্ঘটনার জন্য এককভাবে মোটরবাইককে বেশি দায়ী করা হয়েছে। ২০১৯ সালে মোট চার হাজার ৭০২টি সড়ক দুর্ঘটনায় পাঁচ হাজার ২২৭ জন নিহত হওয়ার তথ্য দিয়েছে এই সংগঠন। এসব সড়ক দুর্ঘটনার জন্য এক হাজার ৯৮টি মোটরবাইক দায়ী। এর পরের স্থানটিতে রয়েছে ট্রাক। এ যানবাহনটি মোট ১০৩টি দুর্ঘটনার জন্য দায়ী। আর বাস ঘটিয়েছে ৯৯২টি দুর্ঘটনা।
দুর্ঘটনা নিরসনের বিষয়ে অধ্যাপক শামসুল ইসলাম আরো বলেন, ‘দেশের উন্নয়নের সঙ্গে দ্রুত গতির যানবাহনের সংখ্যা বাড়ছে। সেই দ্রুতগতিটা ধরে রাখতে সবচেয়ে বেশি জরুরি সড়কের নিরাপত্তা। এজন্য দরকার সড়কে নজরদারি এবং বিনিয়োগ। কারণ, বিনিয়োগকৃত অর্থ সঠিকভাবে ব্যবহার হচ্ছে কি না তার জন্য একটি শক্তিশালী মনিটরিং টিম থাকতে হবে।’ সরকারের যে সব সুপারিশমালা আছে সেগুলো বাস্তবায়নের জন্য অ্যাকশন প্ল্যান করতে হবে বলেও তিনি জানান।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঢাকাসহ সারাদেশের সড়কেই বাড়ছে মোটর বাইকের সংখ্যা। এদিকে রাইড শেয়ারিংয়ে মোটরবাইকের ব্যবহারও দিন দিন বাড়ছে। ফলে ঢাকার অনেক রাস্তাই থাকে এই যানটির দখলে। এছাড়া নিয়ম-কানুনগুলো ঠিকভাবে না মেনে চলা, টেকসই পদ্ধতি অবলম্বন না করার কারণে দূর্ঘটনা বাড়ছে। এরসঙ্গে যোগ হয়েছে সারাদেশের রাস্তাগুলোয় ছোটযান নসিমন করিমনের দৈরাত্ম্য। হাইকোর্ট থেকে এ যানগুলো নিষিদ্ধ করা হলেও বন্ধ হয়নি এগুলো।
এদিকে হাইওয়ে পুলিশের একটি সূত্র জানায়, বেপরোয়া গতিতে যানবাহন চালানোয় সড়কপথে দুর্ঘটনা বাড়লেও অধিকাংশ মহাসড়কেই যানবাহনের গতি পরিমাপক যন্ত্রের কোনো ব্যবহার নেই। এ সুযোগে চালকরা একটু ফাঁকা রাস্তা পেলেই বেপরোয়া গতিতে চালাচ্ছেন যানবাহন। আর এতেই বাড়ছে দুর্ঘটনার সংখ্যা।
সূত্র আরো জানায়, কোনো কোনো সময় নির্দিষ্ট স্থানে গতি পরিমাপক যন্ত্র বসানোর পর দু’একটি যানবাহনের চালকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার পরপরই তা অন্য চালকরা জেনে যান। এ কারণে তারা ওই স্থানে আসার আগেই যানবাহনের গতি কমিয়ে দেন। আবার স্থানটি পার হওয়ার পরপরই গতি বাড়িয়ে দেন। এ কারণে শুধু গতি পরিমাপক যন্ত্র দিয়ে গতিরোধ করা সম্ভব হচ্ছে না।
যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী সড়ক দূর্ঘটনা কমানোর জন্য কয়েকটি পদক্ষেপের কথা উল্লেখ করেন। সেগুলো হলো- দুর্ঘটনা প্রবণ সড়ক ও মহাসড়কে সিসি ক্যামেরা স্থাপন, সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮ কঠোরভাবে বাস্তবায়ন, জাতীয় ও আঞ্চলিক মহাসড়কের পাশ থেকে হাটবাজার অপসারণ, ফুটপাত দখলমুক্ত করা, দেশের সড়ক-মহাসড়কে রোড সাইন (ট্রাফিক চিহ্ন) স্থাপন ও জেব্রাক্রসিং অঙ্কন, গণপরিবহন চালকদের প্রফেশনাল ট্রেনিং ও নৈতিক শিক্ষার ব্যবস্থা, পথচারী ও গণপরিবহনবান্ধব সড়ক পরিবহন বিধিমালা প্রণয়ন ও তার বাস্তবায়ন, এই বিষয়গুলোর বাস্তবায়ন হলেই দুর্ঘটনা অনেকটা কমে আসবে বলে মনে করেন তিনি।
আগামীনিউজ/শাই/এএম/এস