ঢাকাঃ রাজধানীর অটোরিকশা চালকদের আচরণ অনেকটা স্বৈরাচারী ধরণের। যাত্রীদের জিম্মি করে অটোরিকশা চালকরা ইচ্ছেমতো ভাড়া হাঁকছেন। মিটার থাকলেও চুক্তিছাড়া নড়েন না একজনও। যাত্রীদের চাহিদামতো গন্তব্যে যেতে রাজি না হওয়ার হাজারো অজুহাতও রয়েছে তাদের।
ডিজেলের দাম বৃদ্ধির পর বাসভাড়া নিয়ে চলছে তুগলকি কান্ড। সরকারের বেঁধে দেয়া ভাড়ার চেয়ে প্রতিটি রুটে চলাচলকরা বাসে বেশি ভাড়া আদায় করা হচ্ছে। এ নিয়ে প্রতিদিন সড়কে চলছে- অবরোধ, প্রতিবাদ, সংঘাত-সংঘর্ষ। শিক্ষার্থীরা রাস্তা অবরোধ করে ছাত্রছাত্রীদের জন্য হাফ ভাড়া নির্ধারণের দাবি করছেন। অন্যদিকে কর্মজীবীদের অনেকেই বাধ্য হয়েই সিএনজিচালিত অটোরিকশা ব্যবহার করছেন। কিন্তু সিএনজিচালিত অটো রিকশাগুলো বাস-মালিকদের মতো যাত্রীদের জিম্মি করে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করছে। মিটারে অটোরিকশা চালানোর ব্যাপারে সরকারের কঠোর নির্দেশনা রয়েছে। কিন্তু সরকারের দেয়া নির্দেশনা তোয়াক্কা করছে না অটোরিকশা চালকরা। ফলে রাজধানী ঢাকা ও এর আশপাশের কর্মজীবী ও সাধারণ মানুষ যেন গণপরিবহন আর অটোরিকশার চালকদের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছেন।
জানা যায়, রাজধানী ঢাকায় ২০০২ সালের শেষ দিক থেকে সিএনজিচালিত অটোরিকশা চলাচল শুরু হয়। পরবর্তীতে সরকার নির্ধারিত কিলোমিটার প্রতি ভাড়া বাড়িয়ে ৭ টাকা ৬৪ পয়সা এবং বিরতিকালীন চার্জ ১ টাকা ৪০ পয়সা করা হয়। পরে ২০১৫ সালে ভাড়া ও জমা বাড়ানো হয়। ২০১৫ সালে সিএনজির জমা ৯০০ টাকা এবং যাত্রীদের জন্য প্রথম ২ কিলোমিটারের ভাড়া ৪০ টাকা, পরে প্রতি কিলোমিটার ১২ টাকা এবং বিরতিকালীন চার্জ প্রতি মিনিটে ২ টাকা নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু কোনো সিএনজি অটোরিকশা চালক এই ভাড়া একদমই মানেন না। উল্টো যাত্রীদের কাছ থেকে তারা তাদের নিজেদের ইচ্ছে মতো ভাড়া আদায় করেন।
সূত্র জানায়, অটোরিকশা চালকদের এমন একরোখা আচরণের কারণে কমলাপুর ও বিমানবন্দর রেলস্টেশনের বাইরে এসেই যাত্রীদের অস্বস্তিকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়। সিএনজি চালকদের হাতে তাদের নাজেহাল হতে হয়। বাগি¦ত-ায়ও জড়াতে হয়। সিএনজি অটোরিকশায় মিটার ব্যবহারের কোনো বালাই নেই। চালকরা যোগসাজশ করে একইরকম ভাড়া হাঁকেন। ধূসর রঙের ব্যক্তিগত মালিকানার অটোরিকশায় (প্রাইভেট) যাত্রী পরিবহণের অনুমতি নেই। কিন্তু ইচ্ছেমতো ভাড়ায় তাতেও যাত্রী বহন করা হচ্ছে। প্রাইভেট সিএনজি অটোরিকশার চালকদের দাবি- পুলিশকে মাসোয়ারা দিয়ে তারা রাজপথে অটোরিকশা চালান।
মিটারে যাওয়ার নিয়ম থাকলেও সিএনজি অটোরিকশার চালকরা যাত্রীদের সঙ্গে চুক্তি করে গন্তব্যে যাচ্ছেন বলে সূত্র জানায়। যে গন্তব্যে মিটারের ভাড়া আসে ১০০ থেকে ১২০ টাকা, সেখানে পৌঁছাতে ভাড়া নেয়া হচ্ছে ৩০০ টাকা থেকে ৩৫০ টাকা। চুক্তিতে যাত্রী তুলে চালকরা মিটার চালু করেই পথ চলেন। আবার যাত্রীদেরও বলে দেন, ট্রাফিক পুলিশ ধরলে বলবেন মিটারে যাচ্ছি। এদিকে যদি কেউ মিটারে যেতে রাজি হন, তবে মিটারের চেয়ে বাড়তি বকশিশ চাওয়া হয় অন্তত ৫০ টাকা।
এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর সিএনজি অটোরিকশা ব্যবসায়ী মালিক সমিতির ভাষ্য, মিটার এখন অকার্যকর। এটা শতভাগ সত্য। ঢাকায় বৈধ সিএনজি অটোরিকশা সংখ্যা ১৫ হাজার। তবে আরো ১৫ থেকে ২০ হাজার সিএনজি অটোরিকশা চলে অবৈধ। ওইসব অবৈধ সিএনজি অটোরিকশা ঢাকা জেলা, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, গাজীপুর জেলা থেকে আনা হয়েছে। ওইসব সিএনজিতে মিটার নেই। তারা মিটার ছাড়াই চলাচল করে। ওইসব সিএনজি অটোরিকশা রাজধানীতে চলাচল করায় মিটার লাগানো গাড়িগুলোর অকার্যকর হয়ে গেছে।
সিএনজিচালিত অটোরিকশায় মিটার আছে। আলোও জ্বলছে। যাত্রীর ইচ্ছামতো গন্তব্যে মিটার অনুযায়ী চলাচল করবে, এটাই আইন। কিন্তু গত ২০ বছরেও এই আইন বাস্তবায়ন হয়নি। উল্টো যাত্রীদের সাথে নিয়মিত ঝগড়া করছেন চালকরা। প্রতিদিনই এমন দৃশ্য দেখা যায় রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায়। শুধু সিএনজিচালিত অটোরিকশাই নয়, অ্যাপসনির্ভর মোটরসাইকেলগুলোও চুক্তির ভিত্তিতে যাত্রী পরিবহন করছে। তবে চালকদের এই নৈরাজ্য দমনে ট্রাফিক বিভাগের কোনো তৎপরতা নেই এমন অভিযোগ করেছেন যাত্রীরা।
তবে পুলিশ বলছে, মিটারে না গিয়ে চুক্তিতে যাওয়ার কোনো ঘটনা নজরে এলে আমরা ব্যবস্থা নিয়ে থাকি। করোনা মহামারিতে ক্ষতিগ্রস্ত চালকদের কেউ কেউ মিটারে যেতে চান না। এ সুযোগ সবাই নিতে চাইলে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আদালতে এ ব্যাপারে রিট হয়েছিল। এরপর এসব অটোরিকশার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। বিষয়টি এখনো বহাল আছে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির ভাষ্য, সিএনজি অটোরিকশা চালকরা সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। এটা সরকার নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। সিএনজি অটোরিকশার সর্বশেষ ভাড়া বাড়ানোর সময় আমরা সরকারকে বলেছিলাম, বাড়তি ভাড়ায়ও অটোরিকশাগুলোকে মিটারে চালাতে যাতে বাধ্য করা হয়। ভাড়া বাড়ানো হলো কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হলো না। মিটারে চলার প্রতিশ্রুতি দিয়েও চালকরা তা প্রতিনিয়ত ভঙ্গ করছেন। বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির এক সমীক্ষায় জানা গেছে, মিটার উপেক্ষা করে চুক্তিতে বাড়তি ভাড়া নিয়ে ৯৬ শতাংশ অটোরিকশা চালক যাত্রী পরিবহণ করেন।
এদিকে, ঢাকাসহ সারা দেশে একই পদ্ধতিতে খুন হচ্ছেন ব্যাটারিচালিত অটোচালকরা। গত ৬ বছরে ৭৪টি হত্যাকান্ডের ঘটনা ঘটেছে। আর প্রতিটি ঘটনার তদন্ত করে একই ক্লু উদঘাটন করেছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। সংস্থাটির তদন্তে বেরিয়ে এসেছে-লাইসেন্স ও নম্বরপ্লেট না থাকার কারণেই একের পর এক খুন ও ছিনতাইয়ের শিকার হচ্ছেন তারা। হত্যার পর খুব সহজেই এসব ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার রং পরিবর্তন করে তা আবার রাস্তায় নামানো হচ্ছে। ওইসব ঘটনায় খুনি ধরা পড়লেও কোনোভাবেই ঠেকানো যাচ্ছে না এই ধরনের অপরাধমূলক কর্মকান্ড। সম্প্রতি এই ধরনের একাধিক খুনের ঘটনার তদন্তে মাঠে নামে পিবিআই। তাদের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে ২০১৫ সালে হাতেগোনা কয়েকটি ঘটনা থাকলেও ২০২১ সালে তা বেড়ে কয়েকগুণে গিয়ে ঠেকেছে। গত ৬ বছরে শুধু তারাই এ ধরনের ৭৪টি খুনের মামলা তদন্ত করেছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে।
পুলিশ সূত্রমতে, ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা ছিনতাই ও খুনের ঘটনার ৭৪টি মামলা তাদের হাতে রয়েছে। এরমধ্যে ২৬টি মামলার নিষ্পত্তি হয়েছে। বাকি ৪৮টি মামলা তদন্তাধীন। ২০১৫ সাল থেকে এ ধরনের যান ছিনতাইয়ে খুনের ঘটনা ঘটতে শুরু করলেও গত কয়েক বছরে তা ভয়াবহভাবে বেড়েছে। ২০১৮ সালে এ ধরনের ঘটনায় ১১টি, ২০১৯ সালে ১৯টি, ২০২০ সালে ২১টি এবং ২০২১ সালের প্রথম দুই মাসে ৭টি মামলার তদন্তের দায়িত্ব তারা হাতে পেয়েছেন। শুধুমাত্র ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা ও ইজিবাইক ছিনতাইয়ে চলতি বছরে যে সংখ্যক খুনের ঘটনা ঘটেছে, অন্য কোনো একক বিষয়ে এত বিপুল সংখ্যক হত্যাকান্ড সংঘটিত হয়নি।
আগামীনিউজ/শরিফ