ঢাকাঃ চিকিৎসাবিদ্যায় পড়াশুনার পর বিসিএস স্বাস্থ্য ক্যাডার হওয়া ডা. সাবরিনা হুসাইন ওরফে সাবরিনা আরিফ চৌধুরী গত বছর এমন দিনেও দাপিয়ে বেড়িয়েছেন। করোনা জালিয়াতিতে ধরা পড়ে এখন কাশিমপুর-৩ মহিলা কারাগারে আছেন এ কার্ডিয়াক সার্জন।
কারাগারে ভোরে আজানের সময়ে ঘুম ভাঙে সাবরিনার। নামাজ আদায়ের মধ্যে দিয়ে তার দিন শুরু হয়। বই পড়ে সময় কাটানোর পাশাপাশি নিয়মিত শরীর চর্চাও করেন। এছাড়া মাঝেমধ্যে কারাগারে নারীদের পার্লারে যান।
স্বামী আরিফুল হক চৌধুরীকে নিয়ে তাদের কথিত প্রতিষ্ঠান জেকেজি হেলথ কেয়ার থেকে করোনা নমুনা পরীক্ষার ভুয়া রিপোর্ট দিয়ে গ্রেপ্তারের পর তার কারাবাসের প্রায় আট মাস হয়েছে।
সাবরিনা ছিলেন জেকেজি হেলথ কেয়ারের চেয়ারম্যান। করোনাভাইরাসের নমুনা পরীক্ষার জালিয়াতিতে ধরা পড়ার পর গত বছরের ১২ জুলাই তাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এ ঘটনায় গ্রেপ্তার সাবরিনার স্বামী জেকেজির সিইও আরিফ চৌধুরীও কারাগারে।
গ্রেপ্তারের পর স্বজনদের তেমন কেউ কারাগারে তার সঙ্গে দেখা করতে না গেলেও কারাগারের বিধি অনুযায়ী মোবাইল ফোনে সাবরিনা পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন।
জাতীয় হৃদরোগ ইনিস্টিটিউটের কার্ডিয়াক সার্জারি বিভাগের রেজিস্ট্রার (বরখাস্ত) ডা. সাবরিনা ২৭তম বিসিএস স্বাস্থ্য ক্যাডারের কর্মকর্তা। একারণে কাশিমপুর মহিলা কারাগারে ডিভিশন সুবিধা পেয়েছেন। কারাবিধি অনুযায়ী ডিভিশনের সকল সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছেন।
তার কক্ষে একটি খাট, ফ্যান রয়েছে। প্রতিদিন একটি দৈনিক পত্রিকা বরাদ্দ। তাছাড়া বিছানা, চাদর, বালিশ ও মশারি রয়েছে। ডিভিশনপ্রাপ্তির জন্য তিনি উন্নত বাথরুম ব্যবহার করতে পারেন।
তাকে রাখা হয়েছে কারাগারটির রজনীগন্ধা ডিভিশন সেলের একটি কক্ষে। তার সঙ্গে আরো দুইজন সাজাপ্রাপ্ত বন্দি আছেন। আলোচিত মামলায় অভিযুক্ত হওয়ায় বাইরের কারও সঙ্গে যোগাযোগ বা তথ্য পাচার না হয় সে বিষয়ে সতর্ক থাকে কারা কর্তৃপক্ষ।
ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় করোনা শনাক্তের জন্য নমুনা সংগ্রহ করে তা পরীক্ষা না করেই জেকেজি হেলথকেয়ার ২৭ হাজার মানুষকে রিপোর্ট দেয়। এর বেশিরভাগই ভুয়া বলে ধরা পড়ে।
গত বছরের ২৩ জুন অভিযান চালিয়ে প্রতিষ্ঠানটি সিলগালা করে দেওয়া হয়। পরে তাদের বিরুদ্ধে তেজগাঁও থানায় মামলা করা হয় এবং দুজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। ৫ আগস্ট সাবরিনা ও আরিফসহ আটজনের বিরুদ্ধে চার্জশিট (অভিযোগপত্র) দাখিল করে ডিবি পুলিশ।
যেখানে সাবরিনা ও তার স্বামী আরিফ চৌধুরীকে প্রতারণার মূলহোতা বলে উল্লেখ করা হয়। বাকিরা প্রতারণা ও জালিয়াতি করতে তাদের সহযোগিতা করেছে। মামলায় পেনাল কোডের ১৭০/২৬৯/৪২০/৪০৬/৪৬৬/৪৭১/৩৪ ধারায় অভিযোগ আনা হয়। এর মধ্যে একাধিক ধারায় সর্বোচ্চ শাস্তি সাত বছরের কারাদণ্ড।
এদিকে জাতীয় পরিচয়পত্রের (এনআইডি) তথ্য গোপন করে দ্বিতীয় এনআইডি করার অভিযোগের মামলায় এই চিকিৎসকের বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল ৫ এপ্রিল দিন ধার্য করেছে আদালত।
গত বছরের ৩০ আগস্ট বাড্ডা থানায় ডা. সাবরিনার বিরুদ্ধে মামলাটি করেন গুলশান থানা নির্বাচন অফিসার মোহাম্মদ মমিন মিয়া। ২০১০ সালের জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন আইনের ১৪ ও ১৫ ধারায় মামলাটি করা হয়।
ইসি সূত্রে জানা গেছে, ডা. সাবরিনার দুই এনআইডিতে স্বামীর নাম দুরকম উল্লেখ করা হয়েছে। একটি এনআইডির চেয়ে অন্যটিতে বয়স কম দেখানো হয়েছে। বর্তমান তার দুটি এনআইডি-ই ব্লক করে দেয়া হয়েছে। বিষয়টি নজরে আসার পর বিস্তারিত জানতে ইসির কাছে তথ্য চেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
প্রায় এক বছর তদন্তের পর সাবরিনা আরিফের জাতীয় পরিচয়পত্র ও আয়কর বিবরণী সনদ তৈরিতেও জালিয়াতির প্রমাণ পেয়েছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি)। এখন তারা অভিযোগপত্র দিতে যাচ্ছে।
ডিবির যুগ্ম পুলিশ কমিশনার মো. মাহবুব জানান, তারা (ডিবি) সাবরিনার একটি মামলার তদন্ত করছে। মামলায় বেশ অগ্রগতি আছে। এর বেশি জানাননি পুলিশের এই ঊদ্ধর্তন কর্মকর্তা।
ডিবির তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, সাবরিনা ২০০৯ সালে প্রথম জাতীয় পরিচয়পত্র করেন। এতে তাঁর নাম লেখা রয়েছে- সাবরিনা শারমিন হোসেন, বর্তমান ও স্থায়ী ঠিকানা-১২২/ক; পিসি কালচার হাউজিং সোসাইটি মোহাম্মদপুর; জন্মতারিখ-২ ডিসেম্বর, ১৯৭৮ সাল; পেশা-সরকারি চাকরি। বাবার নাম সৈয়দ মুশাররফ হোসেন ও মায়ের নাম কিশোয়ার জেসমিন।
এরপর ২০১৬ সালে তার আরেকটি জাতীয় পরিচয়পত্রের তথ্য পায় ডিবি। তাতে নাম-সাবরিনা শারমিন হুসেন, বর্তমান ও স্থায়ী ঠিকানা-১৪/এ আনোয়ার ল্যান্ড মার্ক, বাড্ডা; জন্মতারিখ ২ ডিসেম্বর ১৯৮৩ সাল। এতে বাবার নাম সৈয়দ মুশাররফ হোসেন, মায়ের নাম জেসমিন হুসেন রয়েছ; পেশা উল্লেখ করা হয়েছে চিকিৎসক।
জানা যায়, সাবরিনা ১৯৯১ সালে এসএসসি ও ২০০০ সালে এমবিবিএস পাস করেন। জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে করা দ্বিতীয় জাতীয় পরিচয়পত্রের তথ্য অনুযায়ী সাবরিনা ১৭ বছরে এমবিবিএস ও ৮ বছর বয়সে এসএসসি (মাধ্যমিক) পাস করেছেন। জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে করা দ্বিতীয় আয়কর বিবরণী সনদে একই ধরনের তথ্য রয়েছে।
কারা সূত্রে জানা যায়, ভোরে ঘুম থেকে ওঠেন তিনি। নামাজ দোয়ায় সময় কাটান। পাশাপাশি কারাগারে অন্য বন্দিদের মতো তিনিও অনুশোচনাও করেন। কারাগারের লাইব্রেরি থেকে বই নিয়ে আসেন। বেশিরভাগ সময় নিরিবিলি একা একাই থাকেন। কারাবিধি অনুযায়ী সরকারের যে খাবার মেন্যু সেখান থেকেই খাবার খান। এর বাইরে খান না।
কারাগারের এক কর্মকর্তা জানান, পরিবারের কেউ তেমন আসেন না। করোনার মধ্যে একবার দেখা করতে এসেছিল স্বজনরা। কারাগারে সপ্তাহে ফোনে একদিন কথা বলার সুযোগ আছে। তিনিও সেই সুযোগে স্বজনদের সঙ্গে কথা বলেন।
মহিলা কারাগারের বিউটি পার্লার থাকে। মাঝে মধ্যেই তিনি সেটা ব্যবহার করেন করেন বলে জানান কারাগারের এই কর্মকর্তা। তিনি বলেন, ‘বন্দিদের প্রশিক্ষণের জন্য পার্লার আছে। কারাগারে সব বন্দি এই বিউটি পার্লার ব্যবহার করতে পারেন। সে হিসেবে তিনি (সাবরিনা) মাঝে মধ্যে সেখানে যান।’
আগামীনিউজ/প্রভাত