ঢাকাঃ করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউ সামাল যে 'লকডাউন' শুরু হয়েছে বাংলাদেশে শুরু থেকেই তার বিরোধিতা করছিলো ব্যবসায়ীরা। দেশের বেশ কিছু জায়গায় এনিয়ে দোকানি ও ব্যবসায়ীদের সাথে পুলিশের সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটেছে।
দেশে গত বছরের নভেম্বর থেকে এ বছরের ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত করোনাভাইরসের সংক্রমণ ছিল নিম্নমুখী। কিন্তু দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হয় মার্চ মাসে। দ্বিতীয় ঢেউয়ে সংক্রমণ যেমন বেশি তীব্র, একইসাথে গুরুতর রোগী এবং মৃত্যুর সংখ্যাও প্রথম ঢেউয়ের তুলনায় অনেক বেশি। স্বাস্থ্য বিভাগের পরিসংখ্যানেই তা দেখা যাচ্ছে।
২৮ এপ্রিল শেষ হচ্ছে লকডাউন, খুলছে দোকানপাট, হাটবাজার ও বড় বড় শপিংমল, চলবে গণপরিবহন। সামনে আসছে প্রবিত্র ঈদুল ফিতর, দলে দলে শহর ছেড়ে মানুষ যাচ্ছে বাড়িতে, হুমকির মুখে পড়ছে গ্রামাঞ্চলগুলো। বাস,ট্রেন,লঞ্চসহ গণপরিবহনগুলোতে মানুষের যে সমাগম হবে তা থেকেই ছড়িয়ে যেতে পারে সারা দেশে।
করোনাভাইরাসের জিনোম সিকোয়েন্স নিয়ে বেশি গবেষণা করেছে চাইল্ড হেলথ রিসার্চ ফাউণ্ডেশন। এই প্রতিষ্ঠানের নির্বাহী পরিচালক ড: সমীর সাহা ‘আগামী নিউজ’কে বলেন, সংক্রমণ যখন নিম্নমুখী হয়েছিল, তখন সবার মাঝে একটা ধারণা তৈরি হয়েছিল যে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ হয়েছে। সেজন্য সবক্ষেত্রে ঢিলেঢালাভাব থাকার বিষয়টি এবার সংক্রমণের তীব্রতার অন্যতম কারণ বলে তিনি মনে করেন।
ড. সমীর বলেন, সামনে তো ঈদ, মানুষ দলে দলে বাড়ি ফিরবে, সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়বে গোটা দেশে তখন সামাল দিতে পারবে না কোন ভাবেই।
ড. সমীর আরও বলেন, ভারতের অবস্থা আপনারা নিশ্চই জানেন,ভারতে নির্বাচন চলমান, সভা-সমাবেশ চলছে, মানুষ কোন কিছু কিছুরই তোয়াক্কা করেনি, করোনার পাদুর্ভাব ছড়িয়ে পড়েছে শহর থেকে গ্রামে, স্বাস্থ্যবিধি না মানার কারণে আজ এই অবস্থা হয়েছে ভারতে যা এখন তারা সামাল দিতে পারছে না।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী আগামী নিউজকে বলেন, কোন ভাবেই লকডাউন তুলে দেয়া ঠিক হবে না, আমি মনে করি লকডাউন আরও কঠোর হওয়া উচিৎ। তিনি বলেন, সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের খাওয়ার নিশ্চয়তা প্রধান করে লকডাউন চলমান রাখা দরকার, না হয় গ্রামের দিকে মানুষ যে ভাবে ছুটছে আমাদের অবস্থা ভারতের চেয়েও ভয়াবহ অবস্থার দিকে চলে যাবে যা সামাল দেয়া কষ্টকর হবে, এখন থেকেই সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে।
ডা. লেলিন আরও বলেন, আমাদের সীমান্ত এলাকায় নজরদারি বাড়ানো দরকার, ভারতের সাথে আপাতত সকল কার্যক্রম বন্ধ করা দরকার, মেডিকেল ভিসায় অনেকেই ভারতে যাচ্ছে, এটি এখন বন্ধ করা দরকার তা না হলে বড় ধরণের বিপদের আশংকা তৈরী হবে দেশে, বাংলাদেশের সর্বনাশ হবে।
করোনাভাইরাসের প্রভাবে বিপর্যস্ত ভারত। প্রতিদিনই দেশটিতে করোনায় আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে। দেশটির একাধিক রাজ্যে অক্সিজেনের তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে বলে বিভিন্ন গণমাধ্যমের খবরে জানা গেছে।
বাংলাদেশ ও বৈশ্বিক তথ্য-উপাত্ত মূল্যায়ন করে একদল বিশ্লেষক বলছেন, করোনাভাইরাসের ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট বা ধরন বাংলাদেশে প্রবেশ করলে পরিস্থিতির অবনতির আশঙ্কা আছে।
করোনাভাইরাস সম্পর্কিত বাংলাদেশ ও বৈশ্বিক তথ্য উপাত্ত, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নানা পদক্ষেপ, ভাইরাসের বিস্তারের ধরন - এমন নানা কিছু বিশ্লেষণ করে বিশ্লেষকদের দলটি যে সম্ভাব্য চিত্র তৈরি করেছে তাতে একথা বলা হয়।
"বাংলাদেশের বিশাল সীমান্ত ভারতের সাথে। তাই আনুষ্ঠানিক যোগাযোগ যতই বন্ধ থাকুক - তাতে সেখানকার ভাইরাস আসবে না এই নিশ্চয়তা নেই" - বলেন বিশ্লেষক দলটির প্রধান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইন্সটিটিউটের শিক্ষক ডঃ শাফিউন নাহিন শিমুল। তিনি বলছেন, "ভারতে এর ব্যাপকভাবে বিস্তার হচ্ছে এবং সেখানে ভাইরাসের ডাবল ভ্যারিয়েন্টের কথা বলা হচ্ছে।"
"অন্যদিকে আমরা আগে ধারণা দিয়েছিলাম যে সেকেন্ড ওয়েভের চূড়া বা পিক আসবে মে মাসের শেষে বা জুনের দিকে। কিন্তু চলতি মাসের শুরু থেকেই স্বল্প মাত্রায় লকডাউনসহ কিছু পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে।"
"এখন আমাদের মডেল বলছে যে জুলাইতে আসতে পারে সেকেন্ড ওয়েভের পিক বা চূড়া। তবে স্বাস্থ্যবিধি সবাই ঠিক মতো মানলে সেটি তেমন খারাপ নাও হতে পারে। এখানে পিক বা সর্বোচ্চ চূড়া বলতে দিনে অন্তত ১০/১২ হাজার সংক্রমণ শনাক্ত হওয়াকে বোঝানো হয়েছে বলে বলছেন তিনি।
রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইন্সটিটিউটের (আইইডিসিআরে) উপদেষ্টা মোশতাক হোসেন বলছেন, ''আমার ধারণা হলো, মানুষকে বাধা দেয়ার পরেও দেখা গেল তারা বাড়িতে যাচ্ছে। সোজা পথে না গিয়ে তারা বাঁকা পথে যাচ্ছে, অ্যাক্সিডেন্টের সম্ভাবনা বাড়ছে, বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে বিপদ হচ্ছে। অনেকে হয়রানির শিকার হচ্ছে, কিন্তু ঠেকানো যাচ্ছে না। তাই সম্ভবত ভাবা হয়েছে, তাদের যেহেতু কোনভাবেই ঠেকানো যাচ্ছে না, তারা তারা হয়তো হাল ছেড়ে দিয়েছে।''
''অসহায়ত্ব বলেন আর ব্যর্থতা বলেন, মানুষের মনে এই বিশ্বাস জন্মানো যায় নি যে, এভাবে গণহারে ভ্রমণ করলে রোগটা আরো ছড়িয়ে পড়বে। তিনি নিজে আক্রান্ত হতে পারেন, বাড়ির লোকজনকে আক্রান্ত করতে পারেন।''
গত কয়েকদিন ধরেই কোভিড-১৯ রোগী শনাক্তের সংখ্যায় নিত্যনতুন রেকর্ড হচ্ছে, মৃত্যুর সংখ্যাও বাড়ছে। গতকাল একদিনে শনাক্ত ২৬৯৭ জন রোগী শনাক্ত হয়, মৃত্যু হয়েছে ৮৩ জনের।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সংক্রমণ বাড়তে থাকার এই তালিকায় নতুন ঝুঁকি তৈরি করবে মানুষের দলেদলে শহর থেকে গ্রামে ছড়িয়ে পড়ার এই প্রবণতা।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ বিভাগের সাবেক পরিচালক বেনজীর আহমেদ আগামী নিউজকে বলেন, আমাদের সংক্রমণগুলো এখনো বড় শহর কেন্দ্রিক, যেমন ঢাকা, চট্টগ্রাম, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ। সাধারণত যখন ছুটি হয়, মানুষ যখন ঈদের সময় বাড়ি যায়, বেশিরভাগ মানুষ কিন্তু এসব বড় শহর থেকেই যান।
''আমাদের একটা হিসাব হলো, এখনো আমাদের ৭৫/৮০ভাগ জনপদ সংক্রমণ মুক্ত । ফলে এই আক্রান্ত শহরগুলো থেকে যারা যাচ্ছেন, তাদের মধ্যে কেউ কেউ এই ভাইরাসটি বহন করে নিয়ে যেতে পারেন। তাদের অনেকে হয়তো উপসর্গ নেই, তারা নিজেও জানেন না যে, তারা আক্রান্ত।''
''২০ বা ৩০ হাজার গ্রামেও যদি এরকম আক্রান্ত লোক যান, তাহলে আমাদের যে জায়গাগুলো সংক্রমণ মুক্ত ছিল, সেই জায়গাগুলোয় সংক্রমণের একটা ঝুঁকি তৈরি হবে।'' বলছেন মি. আহমেদ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশে সংক্রমণের যে প্রবণতা তৈরি হয়েছে, তা আরো বাড়লে প্রচলিত স্বাস্থ্য ব্যবস্থার পক্ষে তা সামলানো সম্ভব হবে না। তাই তারা এই রোগটি সামলাতে এখনি কম্যুনিটি ভিত্তিক ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলার পরামর্শ দিয়েছেন।
আগামীনিউজ/প্রভাত