ঢাকাঃ বৈশ্বিকভাবে গণতন্ত্রের জন্য সুসংবাদ তো নেইই, বরং দুঃসংবাদই এখন বড় হয়ে উঠেছে। ওয়াশিংটনভিত্তিক সংগঠন ফ্রিডম হাউসের প্রকাশিত বার্ষিক প্রতিবেদন ‘ফ্রিডম ইন দ্য ওয়ার্ল্ড ২০২০’-এ সেই চিত্রই উঠে এসেছে।
এটি খুব চমকে যাওয়ার মতো ঘটনা হবে না যদি আমাদের দেশের রাজনৈতিক দর্শনে ‘গণতন্ত্র’ শব্দটি ইতিহাস হয়ে যায়। কোনো রাজনৈতিক দর্শনই যে সর্বকালের জন্য অপরিহার্য হবে এমন ভাবনা বাস্তবসম্মত নয়। সময়ের বাস্তবতাই ঠিক করে দেয় কোন পদ্ধতির রাষ্ট্রচিন্তা বা রাজনৈতিক দর্শন দেশের জন্য- রাজনীতির জন্য লাগসই হবে।
গণতন্ত্র ও মানবাধিকার পরস্পরে ঘনিষ্ঠ ও একে অপরের পরিপূরক। এটি বিশ্বজনীন রাজনৈতিক একটি পরিভাষা, যেটি জনগণের সঙ্গে সম্পৃক্ত। মূলত গণতন্ত্রের প্রধানতম লক্ষ্যই হচ্ছে মানবাধিকার। তাই মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা ছাড়া প্রকৃত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠাও অসম্ভব। সভ্যতার আদিলগ্ন থেকেই প্রতিটি মানুষের নৈমিত্তিক অধিকার ও উন্নয়নের কথা চিন্তা করা হয়েছে। ক্রমান্বয়ে মানুষ বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার মাধ্যমে অধিকার সম্পর্কে অধিক সচেতন হয়ে উঠেছে। এজন্য মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার দাবিতে মানুষ সর্বদা সোচ্চার থেকেছেন। দার্শনিক রুশো, ভিক্টর হুগো, কার্ল মার্কস, জন লক প্রমুখ মনীষীদের রচনাতেও বারবার মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার ধারণা প্রতিফলিত হয়েছে। পৃথিবীতে যখনই মানবাধিকারের প্রতি অসম্মান প্রদর্শন করা হয়েছে; তখনই সংঘটিত হয়েছে নানা ধরনের বিপ্লব ও যুদ্ধ-বিগ্রহ। যার উৎকৃষ্ট উদাহরণ ইংল্যান্ডের মহাসনদ ও বিপ্লব, ফরাসি বিপ্লব, রুশ বিপ্লব এবং দু-দুটি বিশ্বযুদ্ধ। বর্তমান বিশ্বপরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠার নেপথ্যেও রয়েছে এই মানবাধিকার ও গণতন্ত্র সমুন্নত না থাকা। ফিলিস্তিন সংকট থেকে শুরু করে, মধ্যপ্রাচ্যের বিশাল ভূখণ্ডে নানা অসঙ্গতি ও অশুভ রাজনীতির দাবানলে মানবাধিকারহীন অগণতান্ত্রিক সমাজ কায়েম হয়েছে। হ্যারিংটন বলেছেন, যাদের কর্তৃত্বে রয়েছে সম্পত্তি তারাই আজ শাসন করছে। আজ সর্বক্ষেত্রে গরিবের প্রতি ভ্রুক্ষেপ না করে পুঁজিবাদীদের সব সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। ফলে বৈষম্যপূর্ণ সমাজ গড়ে ওঠার পাশাপাশি সৃষ্টি হচ্ছে অগণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা।
পৃথিবীতে গণতন্ত্রের বিপর্যয়ের কারণে মানবতারও বিপর্যয় ঘটেছে, একথা বললে অনেকেই হকচকিয়ে যেতে পারেন যে, পৃথিবীর কোথাও নেই গণতন্ত্র; গণতন্ত্র না থাকার কারণেই মানবতা বা মানবাধিকার নেই, কারণ গণতন্ত্র ও মানবাধিকার একে অপরের পরিপূরক।
এক সময় মানুষ রাজতন্ত্রকে স্বাভাবিকভাবে মনে নিয়েছিল। সময়ের পরিক্রমায় কখনো পৃথিবীর কোনো কোনো অংশে রাজতন্ত্রের জায়গায় অভিজাততন্ত্র শক্ত অবস্থান করে নেয়। একইভাবে কোথাও রাজতন্ত্র ভেঙে সামন্ততন্ত্র প্রতিষ্ঠা পায়। প্রাচীন পৃথিবীতে গ্রিসের এথেন্স নগররাষ্ট্রে গণতান্ত্রিক ধারার যাত্রা শুরু হলেও তা বিশ্বের নানা অংশে ছড়িয়ে পড়েনি।
অন্যদিক ইউরোপে শিল্পবিপ্লবের হাত ধরে পুঁজিবাদের বিকাশ ঘটে। রেনেসাঁস ও ধর্ম সংস্কার আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বুদ্ধিবৃত্তিক ক্ষেত্রে পরিবর্তন আসে। তাই পৃথিবীর নানা অংশে সাম্যবাদ, সমাজতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক দর্শন যার যার বাস্তবতায় জায়গা করে নিয়েছিল। চীন-রাশিয়ার মতো দেশগুলোতে যখন কমিউনিজম বা সাম্যবাদ শক্ত অবস্থানে ছিল, তখন কি ভাবা যেত এ অবস্থান থেকে প্রায়োগিক ক্ষেত্রে সরে যাবে দেশগুলো?
সাম্প্রতিক সময়ে যদি আমরা লক্ষ করি তাহলে দেখবো, পৃথিবীতে গনতন্ত্রের ধারক-বাহক আমেরিকাকে বলা হয়, সেদেশের কি অবস্থা না বলেলেও অনেকে জানেন।
গত মাসে নিউইয়র্কের কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি বাংলাদেশি সংগঠনের আমন্ত্রণে কথা বলতে এসেছিলেন উড্রো উইলসন সেন্টারের দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক বিশেষজ্ঞ মাইকেল কুগেলম্যান। বাংলাদেশের চলতি গণতান্ত্রিক হালচালে অসন্তুষ্ট একদল বাংলাদেশি তাঁর কাছে জানতে চেয়েছিল, বাংলাদেশে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে আমেরিকা তাদের কীভাবে সাহায্য করতে পারে। মৃদু হেসে কুগেলম্যান জবাব দিলেন, ‘আমেরিকা তোমাদের সাহায্য করবে কি, এখন তো আমেরিকার গণতন্ত্র উদ্ধারে তার নিজেরই সাহায্য দরকার। আর যা-ই হোক, গণতন্ত্র উদ্ধারে আমেরিকার কাছে সাহায্য চাইতে এসো না।’ মুখে না বললেও আমাদের বুঝতে বাকি রইল না ভদ্রলোক ডোনাল্ড ট্রাম্পের আমলে মার্কিন প্রশাসনের যে দুরবস্থা, সেদিকেই ইঙ্গিত করছিলেন।
প্রায় ৩০ লাখ ভোট কম পেয়েও ইলেক্টোরাল ভোটে এগিয়ে থেকে ডোনাল্ড ট্রাম্প আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন। এ দেশের গণতন্ত্রের কাঠামোগত দুর্বলতার জন্যই এই দুর্ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু শুধু ইলেক্টোরাল কলেজ নয়, মার্কিন গণতন্ত্রের আরও কাঠামোগত দুর্বলতা রয়েছে। তার একটি হলো এ দেশে যা ‘জেরিম্যান্ডারিং’ নামে পরিচিত, বর্তমানে সুপ্রিম কোর্টের বিবেচনাধীন রয়েছে।
সহজভাবে বলতে গেলে, জেরিম্যান্ডারিংয়ের অর্থ হলো নির্বাচনী এলাকা এভাবে ভাগ করা, যাতে ক্ষমতাসীন দল বা ব্যক্তি সহজেই পুনর্নির্বাচিত হতে পারে। এ দেশে নির্বাচনী এলাকা নির্ধারণ করা হয় প্রতি ১০ বছর অন্তর, জাতীয় জনসংখ্যা গণনার ফল প্রকাশিত হওয়ার পরে। এই এলাকা নির্ধারণের দায়িত্ব পালন করে রাজ্য পর্যায়ের আইন পরিষদ। যখন যে দল রাজ্য পর্যায়ে ক্ষমতাসীন, তারা নিজেদের স্বার্থ মাথায় রেখে নির্বাচনী এলাকা নির্ধারণ করতে উদ্যোগী হয়। রিপাবলিকান বা ডেমোক্র্যাট, যে দলই ক্ষমতায় থাকুক, তাদের লক্ষ্য থাকে নির্বাচনী এলাকা এমনভাবে কাটাছেঁড়া করে সাজানো, যাতে নিজ দলের সমর্থক আছে, এমন লোকদের এক অভিন্ন নির্বাচনী এলাকায় রেখে বিরোধীদের তার বাইরে ঠেলে দেওয়া।
মার্কিন সুপ্রিম কোর্টে এখন যে মামলাটি উঠেছে, তাতে দেখা যাচ্ছে, কোনো কোনো জায়গায় এই নির্বাচনী এলাকা পুনর্নির্ধারণের কাজটি এমন অস্বাভাবিক পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে যে এখন আর ভোটাররা তাদের পছন্দমতো প্রতিনিধি নির্বাচন করেন না, ক্ষমতাসীন দলের প্রতিনিধিরাই উল্টো ঠিক করে দেন কে তাঁদের ভোট দেবেন। বিচারকদের বিবেচ্য হচ্ছে অঙ্গরাজ্য উইসকনসিন। এখানে গত নির্বাচনে রিপাবলিকান দল পেয়েছিল প্রদত্ত ভোটের ৪৮ শতাংশ, অথচ আইনসভার ৬১ শতাংশ আসন তারা কবজা করে নেয়। এমন অসম্ভব সম্ভব হওয়ার পেছনের কারণ হলো অতিসফল জেরিম্যান্ডারিং। উইসকনসিনের রিপাবলিকান নিয়ন্ত্রিত আইন পরিষদ নির্বাচনী এলাকাসমূহ এভাবে কাটাকুটি করে সাজায় যে পাশাপাশি না থাকা সত্ত্বেও সব রিপাবলিকান সমর্থকের ভোটের এলাকা পড়ে একই সীমানার ভেতর। যেসব ডেমোক্র্যাট সেসব এলাকার বাসিন্দা, তাদের কেটে এমনভাবে বাদ দেওয়া হয় যে পাশাপাশি বাড়ি সত্ত্বেও একজন রিপাবলিকান ভোট দিয়েছেন একই পাড়ার কোনো স্কুলে, আরেক ডেমোক্র্যাট ভোট দিয়েছেন তিন মাইল দূরের কোনো এক লাইব্রেরিতে, ভিন্ন নির্বাচনী এলাকায়। এই কাটাকুটির প্রধান লক্ষ্য, রিপাবলিকানরা যাতে তাঁদের সমর্থকদের সংখ্যাধিক্য না হারায়, অথবা ডেমোক্র্যাটরা কিছুতেই সংখ্যাধিক্য অর্জনে সক্ষম না হয়। একজন রিপাবলিকান সাংসদের বেলায় দেখা গেছে, তাঁর নিজের বাড়ির ঠিকানা ডেমোক্রেটিক নিয়ন্ত্রিত এলাকায় হওয়ায় তাঁকে নির্বাচিত হতে সাহায্য করার জন্য শুধু তাঁর বাড়িটি আলাদা করে রিপাবলিকান এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। পুরো ব্যাপারটা এত দৃষ্টিকটু ছিল যে গত বছর উইসকনসিনের একটি স্থানীয় আদালত নির্বাচনী এলাকার পুরো মানচিত্রকেই অবৈধ বলে রায় দিয়েছেন। এর বিরুদ্ধে রিপাবলিকান দল আপিল করলে সেটি শেষ পর্যন্ত সুপ্রিম কোর্টে গড়ায়।
অ্যারিস্টটল কি তবে ভুল বললেন? তিনি বলেছেন, গণতন্ত্র হচ্ছে গরিবতন্ত্র। কথাটা কি ভুল, নাকি ঠিক?
অ্যারিস্টটল কি ভ্রান্ত
তাঁর গুরু প্লেটো বলেছিলেন মূর্খতন্ত্র। গণতন্ত্র হচ্ছে মূর্খদের রাজত্ব। অধিকাংশ লোকই মূর্খ, গণতন্ত্রের অছিলায় এই মূর্খরাই রাজত্ব কায়েম করে। গুরু প্লেটোর এই কথার সঙ্গে শিষ্য অ্যারিস্টটলের বক্তব্যের তফাত আছে, আবার নেইও। নেই বলছি এই জন্য যে, যেখানে দারিদ্র্য, সেখানেই তো অজ্ঞতা। লোকে শখ করে মূর্খ হয় না, বাধ্য হয়েই হয়, দারিদ্র্যই তাদের বাধ্য করে। গরিব বলেই মূর্খ হয়, মূর্খ বলে গরিব নয়। কাজেই গরিবের রাজত্ব বললেই মূর্খের রাজত্ব বোঝাবে এবং গরিবতন্ত্র বলে যদি গণতন্ত্রের পরিচয় দিতে চান কেউ, তবে সেই পরিচিতির মধ্যে মূর্খের শাসনের উপাদানটিও রয়ে যাবে।
ভারতে গণতন্ত্র কোথায়?
ভারতের স্বাধীনতার প্রধান অঙ্গীকার ছিল একটা অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক ও সমতাভিত্তিক ভারতবর্ষের নির্মাণ। কিন্তু ৭৩ বছর পর আজ আমরা যদি গণতন্ত্র ও সমতাভিত্তিক সমাজের কথা বলি, তা হলে আজকের পশ্চিমবঙ্গ কোথায় দাঁড়িয়ে? পশ্চিমবঙ্গ এমন এক রাজত্বে পরিণত হয়েছে, যেখানে মানুষ তাঁর ন্যূনতম গণতান্ত্রিক অধিকারটা প্রয়োগ করার জায়গায় নেই। ভোটদানের অধিকার প্রয়োগ করতে গিয়ে যেখানে নাগরিককে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের হাতে খুন হতে হয়, সেখানে তার কোন মুখে গণতন্ত্রের বড়াই করবে বুঝতে পারি না। তার পরে যখন দেবেন্দ্রনাথ রায়ের মতো একজন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধির নিথর দেহ নিজের বাড়ি থেকে কিছুটা দূরে ঝুলন্ত, হাত বাঁধা অবস্থায় পাওয়া যায়, তখন এই গণতন্ত্রের ধামাধারীদের মৌনব্রত সবাইকে শুধু উদ্বিগ্নই করে না, ইহকালের সমস্ত দায়িত্ব কী রকম একটা শক্তির হাতে সঁপে দিয়েছে, তার জোরালো প্রমাণ মেলে।
ভারতের মানুষ কতটা নিরাপদে বাস করে? যেখানে আপনি প্রকাশ্যে আপনার রাজনৈতিক মতামত রাখতে ভয় পান, পাছে ‘অনুপ্রাণিত’ দামাল ছেলেরা আপনাকে বা আপনার পরিবারকে আক্রমণ করে। এ রকম একটা সমাজ ব্যবস্থার কথা মাথায় রেখেই কি তৃণমূল তাদের রাজনৈতিক ঘুঁটি সাজিয়েছিল? এ কথা ঠিক যে, এই রাজ্যের আপামর জনতা ৩৪ বছর ধরে সিপিএমের অত্যাচার থেকে পরিত্রাণ চেয়েছিল। কিন্তু তৃণমূল সরকার আসার পরে কি রাজ্যের শাপমুক্তি ঘটেছে? না ঘটেনি, বরং তার চেয়েও বেশী হচ্ছে।
পাকিস্তানের গণতন্ত্র কোন পথে?
ক্রিকেট থেকে শুরু করে রাজনীতি পর্যন্ত পাকিস্তানের ‘আনপ্রেডিক্টেবল’ তকমার চেয়ে জুতসই কোনো উপাখ্যান খুঁজে পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না। দেশটি স্বাভাবিক কর্মকাণ্ডকে অস্বাভাবিক করে কখনো আমাদের করে কিংকর্তব্যবিমূঢ়, আবার কখনো কখনো অনিশ্চয়তাকে জয় করে বিশ্ববাসীকে অতিমাত্রায় বিস্মিত করে। যা হোক, ২০১৭ সালের ২৮ জুলাই পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্ট কর্তৃক দুর্নীতির দায়ে নওয়াজ শরিফের প্রধানমন্ত্রী পদে বহাল থাকার অযোগ্যতার রায় এবং পরবর্তী সময়ে নওয়াজের পদত্যাগ পাকিস্তানের গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে সংকট ও সম্ভাবনার দ্বিমুখী রাস্তা খুলে দিয়েছে।
পাকিস্তানের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান কিভাবে ক্ষমতায় এসেছে এটাও সবার জানা আছে কম-বেশি। ধর্মীয় সাম্প্রদায়ীকতাকে কাজে লাগিয়ে ক্ষমতার মসনদে বসা ইমরান খান কি পারবে ক্ষমতা ধরে রাখতে?
১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর থেকেই পাকিস্তানের রাজনীতিতে সেনাবাহিনীর সরাসরি হস্তক্ষেপ কিংবা পরোক্ষ দাপট নতুন কোনো ঘটনা নয়। সেনাবাহিনী রাজনৈতিক ফায়দার জন্য বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলকে সহযোগিতা করাসহ অনেক শীর্ষস্থানীয় নেতৃত্ব তৈরি করে পাকিস্তানের রাজনৈতিক মেরুকরণকে সব সময়ই গভীরতর করেছে। প্রাদেশিক অসমতাকে কাজে লাগিয়ে সেনাবাহিনী সব সময়ই পাঞ্জাবকেন্দ্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে সমুন্নত রাখতে যা করতে হয়, তার সবটুকুই করেছে। এই প্রক্রিয়ার ফসল নওয়াজ শরিফ নিজেও। ১৯৮০-র দশকে জেনারেল জিয়ার সামরিক সরকার বেনজির ভুট্টোকে রাজনৈতিকভাবে কোণঠাসা করার জন্য নওয়াজ শরিফকে বিভিন্ন উপায়ে সহযোগিতা করতে থাকে। ফলে নওয়াজ শরিফ পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী থেকে ১৯৯০ সালে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রিত্ব লাভ করেন। তাঁর এই শাসনামলে নওয়াজ শরিফ ও তাঁর পুরো পরিবার রাজনৈতিক ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে দেশে-বিদেশে ব্যবসাকে সম্প্রসারিত করে সম্পদের পাহাড় গড়ে। তাঁর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ উঠলে ১৯৯৩ সালেও নওয়াজকে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে বরখাস্ত হতে হয়।
প্রধানমন্ত্রী পদ থেকে অপসারণ বা পদত্যাগ পাকিস্তানের রাজনীতিতে নতুন কোনো বিষয় নয়। ৭০ বছরের রাজনৈতিক ইতিহাসে নওয়াজসহ ১৮ জন প্রধানমন্ত্রীর কেউই মেয়াদ পূর্ণ করতে পারেননি। শুধু নওয়াজকেই তৃতীয়বারের মতো এই অভিজ্ঞতার শিকার হতে হলো। তবে নওয়াজ দৃশ্যত দুর্নীতির দোষে দুষ্ট হয়ে প্রধানমন্ত্রিত্ব হারালেও কৌশলগত কিছু বিষয় এর পেছনে কাজ করেছে। ভারতের সঙ্গে নওয়াজের দহরম-মহরম সেনাবাহিনী বরাবরই বাঁকা চোখে দেখেছে। আবার আইএসআইকে কূটনীতির কৌশল হিসেবে জঙ্গিবাদের সঙ্গে ব্যবহারে নওয়াজের অনীহা ভালোভাবে নেয়নি পাকিস্তানের অগণতান্ত্রিক শক্তিগুলো। তাই অনেকেই নওয়াজকে তাঁরই দুর্বল নীতির বলি মনে করছেন। ফলে বিচার বিভাগীয় ক্যুর একটা উৎকট গন্ধ রয়েই যায়।
মিয়ানমারে মানবাধিকার ও গণতন্ত্র
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশ মিয়ানমার ১৯৪৮ সালে ব্রিটিশ উপনিবেশিক শাসন থেকে স্বাধীন প্রজাতন্ত্র হিসেবে আত্মপ্রকাশের পর ৫০ বছরের বেশি সময় থেকেছে সেনা শাসনের অধীনে।
২০২০ সালের ৮ নভেম্বর দেশটিতে পার্লামেন্টারি নির্বাচনে অং সান সু চির ক্ষমতাসীন দল ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্রেসি (এনএলডি) ৪১২ আসনের মধ্যে ৩৪৬টিতে জয় পায়। নির্বাচনের কয়েক দিনের মধ্যে পার্লামেন্টে নির্বাচিত সরকারের অধিবেশন হওয়ার কথা ছিল। অধিবেশনের প্রাক্কালে সেদিন ভোরে গণতান্ত্রিক সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করে এক বছরের জন্য জরুরি অবস্থা জারি করেছে সেনাবাহিনী।
২০১৭ সালের আগস্টে মিয়ানমারের রাখাইনে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করে দেশটির সেনাবাহিনী। অং সান সুচির দল তখন ক্ষমতায়। তখন এক সেনা কর্মকর্তা তাঁর অধীন জওয়ানদের নির্দেশ দিয়েছিলেন এভাবে, ‘যা দেখবে, যা শুনবে, সব লক্ষ্য করেই গুলি চালাবে।’ আরেক কর্মকর্তার নির্দেশ ছিল এমন, ‘ছেলে–বুড়ো যাকে দেখবে, তাকেই হত্যা করবে।’
সেনাসদস্যরা যে ওই সব নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছিলেন তার প্রমাণ বিশ্ব দেখেছিল পরের কয়েক মাসে। হতাহতের সংখ্যা জানা যায়নি, হয়তো কোনো দিন জানা যাবেও না; কিন্তু ভিটেমাটি ছেড়ে প্রাণ হাতের মুঠোয় নিয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে আসে লাখ লাখ রোহিঙ্গা। মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর সেই নিষ্ঠুর নির্মমতার বর্ণনা এবার মিলল দেশটির সাবেক দুই সেনাসদস্যের মুখে। এই প্রথম রোহিঙ্গা গণহত্যার অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে এমন স্বীকারোক্তি পাওয়া গেল।
মায়ো উইন তুন এবং জ নাইং তুন নামের মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সাবেক দুই সদস্য ওই স্বীকারোক্তি দিয়েছেন। চলতি বছরের শুরুর দিকে আরাকান আর্মি তাঁদের ধরে নিয়ে যায়। রাখাইনের এই সশস্ত্র গোষ্ঠী মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সঙ্গে লড়ছে। এই গোষ্ঠীই তাঁদের কাছ থেকে ওই ভিডিও স্বীকারোক্তি নেয়। তাঁরা দুজনই মিয়ানমারের দুই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সদস্য। ভিডিও স্বীকারোক্তিতে মায়ো উইন তুন বলেছেন, ‘আমি জাতিগতভাবে বৈষম্যের শিকার।’
জাতিসংঘ অগণতান্ত্রিক মানবাধিকার পরিষদ, ‘রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্বের নর্দমা’
র্তমান বিশ্বে সবচেয়ে বেশি মাত্রায় মানবাধিকার লঙ্ঘন করা হচ্ছে যেসব জাতির তাদের অন্যতম হল দরিদ্র ইয়েমেনি জাতি।
ইয়েমেনের ওপর গত ছয় বছর ধরে আগ্রাসন ও প্রায় সর্বাত্মক নিষেধাজ্ঞা চাপিয়ে দিয়েছে সৌদি সরকার ও তার জোটভুক্ত কয়েকটি দেশ। অবশ্য সৌদি জোটের এই বর্বরতার প্রধান হোতা ও মূল সহযোগী হিসেবে সক্রিয় রয়েছে মার্কিন সরকার। ব্রিটেনসহ পশ্চিমা বিশ্ব এবং ইহুদিবাদী ইসরাইলও ইয়েমেনে যুদ্ধ-অপরাধ ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের অন্যতম বড় সহযোগী। সেখানে জাতিসংঘের ভূমিকা কি ছিলো?
সৌদি জোটের পৈশাচিক ও নির্বিচার বোমা হামলায় হতাহত হয়েছে হাজার হাজার নারী ও শিশুসহ প্রায় অর্ধলক্ষ ইয়েমেনি। ধ্বংস হয়ে গেছে ইয়েমেনের বেশিরভাগ অবকাঠামো এবং দুর্ভিক্ষ, ক্ষুধা, অপুষ্টি ও দারিদ্রের শিকার হয়ে সেখানে মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছে লাখ লাখ শিশুসহ কয়েক মিলিয়ন মানুষ।
বিস্ময়ের ব্যাপার হল জাতিসংঘ ইয়েমেনি শিশুদের ওপর সৌদি হত্যাযজ্ঞের ব্যাপারে রিয়াদ সরকারকে শিশু-ঘাতকদের তালিকাভুক্ত করেও পরে সৌদি চাপের মুখে ও চাঁদা বন্ধ হয়ে যাওয়ার ভয়ে ওই তালিকা থেকে সৌদি সরকারের নাম বাদ দিতে বাধ্য হয়। অন্যদিকে পশ্চিমা সরকারগুলো মানবাধিকারের বুলি কপচাতে অভ্যস্ত হলেও সৌদি বর্বরতার মৌখিক নিন্দা জানাতেও ব্যর্থ হয়েছে। পশ্চিমা সরকারগুলোর পক্ষ থেকে সৌদি জোটকে অস্ত্রসহ সব ধরনের সহায়তা দেয়া হচ্ছে ইয়েমেনিদের বিপক্ষে। সৌদি আগ্রাসন ও অবরোধে পরোক্ষভাবে সহায়তা করছে জাতিসংঘও। এভাবে ইয়েমেনে ঘটেছে একবিংশ শতকের সবচেয়ে বড় মানবীয় বিপর্যয়।
এ অবস্থায় পশ্চিমা বিশ্ব ও জাতিসংঘের কথিত মানবাধিকার নীতির ভণ্ডামি আর কপটতার স্বরূপ তুলে ধরে সবচেয়ে জোরালো ও স্পষ্ট ভাষায় যিনি প্রতিবাদ আর নিন্দা জানিয়ে আসছেন তিনি হলেন ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ি।
আমেরিকার পূর্ণ সমর্থন নিয়ে সৌদি আরব গত ছয় বছর ধরে ইয়েমেনের নিরস্ত্র জনগণের ওপর ভয়াবহ হামলা চালিয়ে গেলেও পাশ্চাত্যে এ সম্পর্কে টু শব্দটি পর্যন্ত করেনি। তারা ইয়েমেনে অবরোধ আরোপ করে ইয়েমেনে খাদ্য এবং ওষুধ পৌঁছতে দিচ্ছে না। যতক্ষণ ইয়েমেনিরা মার খাচ্ছিল ততদিন আমেরিকাসহ জাতিসংঘ পর্যন্ত নীরবতা অবলম্বন করেছে। কিন্তু যখনই ইয়েমেনিরা সৌদি আরবে পাল্টা হামলা শুরু করেছে তখনই পাশ্চাত্যের চিৎকার চেঁচামেচি শুরু হয়েছে। বাস্তবতা সম্পর্কে এর চেয়ে নির্লজ্জ মিথ্যাচার আর হতে পারে না। এটা স্পষ্ট জাতিসংঘকে এই বিশ্বসংস্থার নীতি অনুযায়ী মজলুম জাতিগুলোর সহযোগী ও রক্ষক হতে হবে এবং ন্যায়নীতির আলোকে বক্তব্য রাখতে হবে। অথচ জাতিসংঘ নিরপেক্ষতা বজায় রাখতেও ব্যর্থ হচ্ছে।
সারা পৃথিবীর কত শতাংশ মানুষ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার মধ্যে জীবন যাপন করছে, সে প্রশ্নই এখন বেশি আলোচনার বিষয়ে পরিণত হয়েছে। অনেক দেশে গণতন্ত্রের নামে যা চর্চা হচ্ছে, দৃশ্যত গণতান্ত্রিক মনে হলেও মর্মবস্তুর দিক থেকে তা আদৌ গণতান্ত্রিক কি না, সে প্রশ্নই এখন প্রধান হয়ে উঠছে। কেননা, আমরা এমন এক সময়ে বাস করছি, যখন বিভিন্ন দেশে কর্তৃত্ববাদী নেতাদের শাসনের লক্ষণ সুস্পষ্ট, এমনকি স্বৈরাচারী শাসকেরাও নিজেদের গণতন্ত্রের রক্ষাকর্তা হিসেবেই দাবি করেন।
আপনি পৃথিবীর যে কোন দেশে যাবেন, দেখবেন গনতেন্ত্রের নামে সব দেশেই চলছে ভণ্ডামি, মানে কাগজে আছে কলমে নেই। তার মানে কি দাড়ালো? দাড়ালো এই যে পৃথিবীর কোথাও গনতন্ত্র নেই, কোথাও স্বৈরাচার, কোথাও ফ্যাসিবাদ, কোথাও রাজতন্ত্র, কোথাও মাফিয়াতন্ত্র, কোথাও আমলাতন্ত্র এই হলো পৃথিবীর গনতন্ত্রের হাল-ছাল।
আগামীনিউজ/প্রভাত