ঢাকাঃ ‘নবীর শিক্ষা করো না ভিক্ষা মেহনত কর সবে’ বিখ্যাত প্রবাদটি সবারই জানা। দেশে দিন দিন ভিক্ষুকের সংখ্যা বেড়েই চলছে। বিষয়টি নিয়ে সচেতন মহল উদ্বিগ্ন। ইতিমধ্যে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় ভিআইপি এলাকাগুলোকে ‘ভিক্ষুকমুক্ত’ ঘোষণা করেছে।
আমাদের দেশে ভিক্ষাবৃত্তির বিচিত্র কৌশল ও মৌসুমি ভিক্ষুকের চিত্র অত্যন্ত করুণ এবং লজ্জাজনক। ভিক্ষুক নানা কৌশলে মানুষকে প্রভাবিত করে; কিন্তু আমাদের উচিত আরও সতর্ক থাকা।
ধর্মে ভিক্ষাবৃত্তি নিষিদ্ধ হলেও ধর্মকে ব্যবহার করেই ভিক্ষাবৃত্তি করা হয়, ভিক্ষা চাওয়ার সময় দোযখের ভয়, বেহেস্তের লোভ, হাম-নাত ও কোরানের বাণী শুনিয়ে সাধারণ মানুষকে ইমোশনাল করেন ভিক্ষুকরা।
এ প্রসঙ্গে নারীন্দার আহসানিয়া উলুম কামিল মাদ্রাসার হেড মোহাদ্দেস মাওলানা ড. মাসুদ হোসাইন আল কাদেরী আগামী নিউজকে বলেন, ভিক্ষাবৃত্তি প্রসঙ্গে হজরত আবদুল্লাহ ইবনু মোবারকের উদ্ধৃতি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ, 'কেউ আল্লাহর নামে সওয়াল করলে তাকে কিছু না দেওয়াই আমার নিকট পছন্দনীয়।'
মাওলানা ড. মাসুদ বলেন, ভিক্ষাবৃত্তির কিছু কারণ ও বাস্তবতা হলো- দারিদ্র্য, পারিবারিক অবহেলা, নিম্ন আয়, ভূমিহীনতা, অশিক্ষা, বসতবাড়ির অভাব, জনসংখ্যার চাপ, নারী নির্যাতন ইত্যাদি।
ভিক্ষাবৃত্তি নির্মূল করা খুব সহজ নয় এবং প্রায় সম্ভবও নয়। কিন্তু এ লজ্জা জাতিগতভাবে আমাদের জন্য অত্যন্ত দঃখজনক। কেননা অন্য ধর্মীয় গোষ্ঠীর মধ্যে ভিক্ষাবৃত্তির প্রবণতা প্রকট নয়। প্রশ্ন মূলত এখানেই; এ থেকে মুক্তির উপায় কী?
মাওলানা ড. মাসুদ আরও বলেন, ভিক্ষাবৃত্তির নামে যা কিছু করা হয়, ইসলাম তা সমর্থন করে না। এর কারণ ও প্রতিকারের উপায় খোঁজা সমাজবিজ্ঞানীদের কাজ ও প্রশাসনিক বিষয়। কিন্তু অন্যান্য সামাজিক সমস্যার মতোই এখানে ধর্মীয় পরিচিতির প্রশ্নে ইসলাম চলে আসে- দুঃখ এবং প্রশ্ন এজন্যই। তবে এর জন্য ইসলাম বা এর শিক্ষা দায়ী নয়, দায়ী হলো সমাজবাস্তবতা।
মোহাম্মদপুর কাদরিয়া তৈয়বিয়া কামিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ আল্লামা বখতিয়ার উদ্দিন আগামী নিউজকে বলেন, ইসলামে ভিক্ষাবৃত্তি হারাম এটা মোটামুটি সকলেরই জানা, কিন্তু ধর্ম ও ধর্মের লেবাস ব্যবহার করেই ভিক্ষাবৃত্তির মতো নিষিদ্ধ ও জঘন্য অপরাধ করছে মানুষ।
তিনি বলেন, রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক উদ্যোগ, কঠোর ব্যবস্থা এবং ব্যক্তির কঠিন শ্রম আর সংকল্পই পারে ভিক্ষাবৃত্তির মতো সামাজিক অনাচার প্রতিহত করতে। কেননা ভিক্ষা কখনোই বৃত্তি নয়। বরং তা ইহ ও পারলৌকিক ব্যর্থতার কারণ, কেননা হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, 'আমার নিকট অঙ্গীকার করতে পারে যে, সে মানুষের কাছে কিছু চাইবে না। আমি তার জন্য জান্নাতের অঙ্গীকার করতে পারি। '
তিনি আরও বলেন, ধীরে ধীরে পদক্ষেপ নিলেই সমাজ থেকে দারিদ্র্যের হার কমে আসবে। আমরা রেখে যেতে পারব ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য সুন্দর একটি সমাজ; যা বহুল প্রত্যাশিত। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এ মানসিকতা কী আমাদের আছে?
রমনা কালিমন্দিরের প্রধান পুরোহিত শ্রী নারায়ন চক্রবর্তীর মতে হিন্দু ধর্মে ৩ প্রকার দানের কথা বলা হয়েছে, পুরোহিত নারায়ন আগামী নিউজকে বলেন, শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার ১৭ তম অধ্যায় শ্রদ্বাত্রয়-বিভাগ যোগে ২০, ২১ ও ২২নং শ্লোকে দান সম্পৰ্কে ভগবান সুন্দর ভাবে তিন রকমের দানের কথা বলেছেন।
১) দান করা কৰ্তব্য বলে মনে করে, প্ৰত্যুপকারের আশা না করে উপযুক্ত স্থানে ( মন্দিরে, তীৰ্থে ) , উপযুক্ত সময়ে ( পর্ব বা পবিত্ৰ তিথিতে), উপযুক্ত পাত্ৰে ( সন্ন্যাসী ও বৈষ্ণবজনকে) যে দান করা হয় , তাকে সাত্ত্বিক দান বলে। ২) প্ৰত্যুপকারের আশা করে , ফল লাভের উদ্দেশ্যে , অনুতাপ সহকারে যে দান করা হয়,সেই দান রাজসিক। ৩) ইন্দ্ৰিয় তোষণের জন্য, অশুভ স্থানে, অশুভ কালে, অযোগ্য পাত্ৰে যে দান করা হয়,তাকে তামসিক দান বলে।
প্রাচীন কাল থেকেই মানব সমাজে ভিক্ষাবৃত্তি চলে আসছে। উপমহাদেশেও এর ইতিহাস দীর্ঘ দিনের। বৃটিশ ও পাকিস্তান আমলের শোষণ, বঞ্চনা, দারিদ্র, রোগ-ব্যাধি ও অশিক্ষা ইত্যাদি কারণে ভিক্ষাবৃত্তির ব্যাপক বিস্তৃতি ঘটে। বর্তমান সময়ে কিছু মানুষের কর্ম বিমুখতা এবং একদল স্বার্থন্বেষী মহলের অর্থ উপার্জনের হাতিয়ার হিসেবে ভিক্ষাবৃত্তির ব্যাপক প্রসার ঘটেছে। ভিক্ষাবৃত্তি একটি সামাজিক ব্যাধি।
এটি স্বীকৃত কোন পেশা নয়। বর্তমানে বাংলাদেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটেছে। স্বল্পোন্নত দেশের অবস্থান থেকে উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় উত্তরণ ঘটেছে। ভিক্ষাবৃত্তির লজ্জা থেকে দেশকে মুক্ত করার সময় এসেছে। ২০১০ সাল থেকে ভিক্ষুক পুনর্বাসন শুরু হলেও তা তেমন ব্যাপকতা পায়নি।
আগামীনিউজ/প্রভাত