Dr. Neem on Daraz
Victory Day

মানব পাচারঃ এ যেন ‍‍`রোগী মারা যাবার পরেই ডাক্তার আসিল‍‍`


আগামী নিউজ | ম. শাফিউল আল ইমরান প্রকাশিত: জুন ১০, ২০২০, ০৫:০২ পিএম
মানব পাচারঃ এ যেন ‍‍`রোগী মারা যাবার পরেই ডাক্তার আসিল‍‍`

সংগৃহীত ছবি

পৃথিবীর জুড়ে মহামারী,প্রাকৃতিক দুর্যোগ যাই আসুক না কেনো থেমে নেই মানবপাচার। নানা প্রলোভনে শিশু, পুরুষ, নারী সবই হচ্ছে পাচার। সম্প্রতি লিবিয়ার বেনগাজীতে ২৬ জন বাংলাদেশি মানবপাচারকারীদের হাতে খুন হয়েছে।  মানবপাচারের দায়ে কুয়েতে বাংলাদেশি এক সংসদ সদস্যের আটক হওয়ার ঘটনায় প্রশাসন নড়ে চড়ে বসেছে। কিন্ত প্রশ্ন উঠেছে;  যখনই কোন মানুষ মরছে, ভূমধ্যসাগরে নৌকা ডুবির ঘটনা ঘটছে অথবা গুলিকরে মানুষ মারছে এ ধরণের খবরগুলো পত্র-পত্রিকায় আসার পর প্রশাসন নড়ে চড়ে বসে? 

অভিযোগ উঠেছে, মানবপাচারের মত ঘটনা দীর্ঘদিন ধরে চলে আসলেও  প্রশাসনের কোনই নজরে ছিলনা? নাকি প্রশাসনের দূর্নীতি পরায়ণ কোন কর্মকর্তার যোগ সাজস রয়েছে! সেইসাথে দেশের একজন পার্লামেন্টিয়ান মানবপাচারের মত জঘন্ন অপরাধে বিদেশের কোন কারাগারে আটক বা গ্রেফতার হলে দেশের ভাবমূর্তি কেথায় গিয়ে ঠেকে এমন প্রশ্ন সবার মুখে মুখে। আবার সেটা যদি হয় বাংলাদেশেরমত কোন দেশের কোন সংসদ সদস্যর বেলায়! কারণ প্রায় এক কোটি ২০ লাখ মানুষ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে চাকুরী ব্যবসা করে দেশের অর্থনীতিকে এতো দূর নিয়ে যেতে সাহায্য করেছে সেখানে মানবপাচারের মত অপধারের লাগাম টেনে ধরতে না পারলে যেমন দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হবে তেমনি অর্থনীতির গতি কমে আসবে। 

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মানবপাচার সাধারণত মাফিয়া চক্রগুলোর জন্য মাদক ও অস্ত্র ব্যবসার পর সবচেয়ে লাভজনক অবৈধ ব্যবসা। এটি শুধু এশিয়ার দেশগুলোর সমস্যা নয় বিশ্বের অনান্য দেশগুলোর জন্যও বিরাট সমস্যা। এর সবচেয়ে বেশি শিকার হয় নারী ও শিশুরা। যৌন ব্যবসা বা পাশবিক কাজে ব্যবহারের জন্যই বেশির ভাগ পাচার হয়। বিশ্বজুড়ে পাচারকারীদের রয়েছে ২০০ বিলিয়ন ডলারের বড় বাজার। একটি শক্তিশালী সংঘবদ্ধ চক্র ছাড়াও বিভিন্ন দেশের এজেন্সি, সীমান্তরক্ষী বাহিনী এমনকি রাজনীতিবিদরাও এ পাচার প্রক্রিয়ায় যুক্ত। সম্প্রতি, করোনার কারণে সারা পৃথিবীতে অভিবাসী শ্রমিকরা চাকরী হারিয়েছে।

শুধু কুয়েত থেকেই দেশে ফেরত পাঠানো হয়েছে প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার বাংলাদেশি কর্মীকে। ফিরে আসা কর্মীদের বড় একটি অংশই কুয়েত গিয়েছিলেন অর্থ ও মানবপাচারে অভিযুক্ত এমপি কাজী শহিদ ইসলাম পাপুলের কোম্পানির মাধ্যমে। ফেরত আসা শ্রমিকদের অভিযোগ, তাদের প্রত্যেকের কাছ থেকে নেয়া হয়েছিলো ৭ থেকে ৮ লাখ টাকা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কুয়েত গিয়ে চাকরি তো দূরে থাক, কোনরকম জীবন নিয়ে শূন্যহাতে ফিরেছেন তারা।

এর কয়েকদিন আগে, গত ২৮ মে লিবিয়ার সাহারা মরুভূমি অঞ্চলের মিজদা শহরে ২৬ বাংলাদেশিসহ ৩০ জনকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এতে আহত হয় আরো ১১ জন। এই ঘটনার পর বাংলাদেশে মানবপাচার আইনে মামলা হয়। পুলিশ বেশ কিছু পাচারকারীকে গ্রেফতার করে। পরে ডিএমপি’র মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স বিভাগে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, 

লিবিয়ায় নিহত বাংলাদেশিদের অন অ্যারাইভাল ও ট্যুরিস্ট ভিসায় পাঠানো হয়েছিল। মানবপাচারে সক্রিয় দেশীয় দালালরা প্রথমে ঢাকায় অবস্থান নেয়। পরে বেনগাজিতে মানবপাচারের জন্য স্থানীয় দালালদের কাছ থেকে প্রাপ্ত পাসপোর্টগুলো স্ক্যান করে সফট কপি দুবাই এবং লিবিয়াতে পাঠায়। সেখান থেকে ট্যুরিস্ট ভিসা এবং অন অ্যারাইভাল মোয়াফাকা সংগ্রহ করার পরে বেনগাজিতে ক্যাম্পে নির্ধারণ করে। এরপর বিভিন্ন চুক্তিতে ভিকটিমদের লিবিয়া পাঠানোর প্রক্রিয়া শুরু করে দালালরা। মানব পাচারের অভিযোগ প্রমাণ হওয়ায় ২০১৭ সালে  থাইল্যান্ডের এক জেনারেল ও মেয়রকে আটক করা হয়েছিল। পরবর্তিতে অমানবিক এ পেশার সঙ্গে সম্পৃক্ততার অভিযোগে তাদের জেল দেওয়া হয়। 

বিভিন্ন কারনে মানব পাচার হয়ে থাকে। বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশী পাচারের শিকার হয় কথামত কাজ না দেওয়ার কারনে। অথবা যেখানে কাজ যে কাজ করতে যাবার কথা সে কাজ না করে অন্য কাজ করানো। বেতন ঠিকভাবে না দেওয়া। নারীদের পাচার করার মুখ্য উদ্দেশ্য-দেহব্যবসায়ে কাজে লাগানো, ইচ্ছার বিরুদ্ধে যৌনকর্মে নিয়োজিত করা, পানশালায় নাচানো, অশ্লীল ছবি, চলচ্চিত্র ইত্যাদিতে অংশগ্রহণ করানো। এ ছাড়া সস্তা শ্রমের জন্য ব্যবহার করা, নেশার দ্রব্য পাচার করানো, তাদের অঙ্গ-প্রতঙ্গ বিক্রি ইত্যাদি। আর শিশুদের ক্ষেত্রে সস্তা শ্রম, ভিক্ষাবৃত্তিতে ব্যবহার, যৌন শোষণের জন্য বিক্রি, নেশার দ্রব্য পাচার, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বিক্রি। মানবপাচারীরা সাধারণত দারিদ্র্য, অবৈধভাবে সীমান্ত অতিক্রমে ইচ্ছুক, নিরক্ষর, অজ্ঞ ও অসচেতন যারা তারাই মূলত পাচারকারীদের টার্গেট। এরা নিকটাত্মীয়, প্রতিবেশী, অপরিচিত লোক, বিদেশ ও শহর থেকে আগত লোক, পাশের গ্রামের লোক, ছেলে বন্ধু, বিদেশে লোক পাঠানো দালাল ও স্বামী-এসব শ্রেণির লোকের মাধ্যমে মানবপাচার সংঘটিত হয়। 

মানবপাচার রোধে পৃথিবীর ১৩৩টি দেশের স্বাক্ষরে  'পালেরোমা' চুক্তি নামে একটি আন্তর্জাতিক প্রটোকল প্রণয়ন করা হয়েছে। সেখানে  মানবপাচারের সঙ্গে সম্পর্কিত অপরাধ প্রতিহত করা, অপরাধীদের শাস্তির ব্যবস্থা করা ও মানবপাচারের শিকার ব্যক্তিদের সহায়তা করাই এ প্রটোকলের মূলনীতি হিসেবে ধরা হয়েছে। কিন্ত মানবপাচার রোধের জন্য আন্তর্জাতিক সমাজের পদক্ষেপে খুব একটা প্রত্যাশিত ফল অর্জিত হয়নি। তেমনি দেশে ২০১২ সালে 'মানবপাচার প্রতিরোধ ও দমন আইন' নামে একটি শক্তিশালী আইন প্রণয়ন  করা হয়। সেখানে পাচারকারীদের  অপরাধের জন্য সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড নির্ধারণ করা হলেও আইনের প্রত্যাশিত সুফল পাওয়া যায় নাই। 

সংগত কারণেই দেশবাসীর মনে প্রশ্ন,  মানব পাচারের সাথে কারা জড়িত! আরো কোন কোন রাঘব-বোয়াল এর সাথে জড়িত আছে। তারা কী সরকারের চেয়ে বেশী শক্তিশালী? ক্যাসিনো ঘটনা, মানবপাচারের ঘটনা এসব কি শুধু একদিনের ঘটনা! কেন কোন ঘটনায় কেবল প্রধানমন্ত্রী নির্দেশনা দিলে সবাই নড়ে চড়ে বসে। এ অবস্থা কতদিন চলতে থাকবে? অবস্থা দৃষ্টে মনে হচ্ছে "রোগী মারা যাবার পরেই ডাক্তার আসিল।" 

আগামীনিউজ/ইমরান/জেএস

আগামী নিউজ এর সংবাদ সবার আগে পেতে Follow Or Like করুন আগামী নিউজ এর ফেইসবুক পেজ এ , আগামী নিউজ এর টুইটার এবং সাবস্ক্রাইব করুন আগামী নিউজ ইউটিউব চ্যানেলে