জমজম শব্দের বাংলা আভিধানিক অর্থ গমগম বা সরগরম ভাব। যা সহজ বাংলায় জাঁকজমক বলা হয়। এয়ারপোর্ট নির্মাণের আদি ইতিহাস জানতে কথা হয় তৎকালীন সৈয়দপুর থানা ছাত্রলীগের স্কুল বিষয়ক সম্পাদক সামশাদ হোসেন বাদশাহর সঙ্গে। তিনি জানান, ১৯৭১ সালে নবম শ্রেণির ছাত্র ছিলেন। পড়তেন সৈয়দপুর সরকারি কারিগরি স্কুলে। বাড়ি শহরের বাঙ্গালীপুর নীজপাড়ায়। দেশে চরম যুদ্ধ শুরু হয়েছে। বাঙ্গালীরা শহরে অবরুদ্ধ অবস্থায় আছে। দেশের সর্ববৃহৎ সৈয়দপুর রেলওয়ে কারখানা সচল করতে পাকি সেনারা তৎপর। মে মাসে অবরুদ্ধ জীবনের কিছুটা শিথিলতা শুরু হয়েছে। রেলের চাকা ঘোরাতে বাঙ্গালীদের কারখানায় কাজ করতে ঘোষণা দেয়া হয়েছে। অনেক বাঙ্গালী রেল শ্রমিক পেটের তাগিদে রেল কারখানার কাজে যোগ দিয়েছে। তবে শহরের অবরুদ্ধ বাঙ্গালীরা দিনের বেলা যে যেখানেই থাকুক না কেন সূর্যাস্তের পূর্বেই বাড়িতে ফিরে। সন্ধ্যা নামার সঙ্গে সঙ্গে বসতবাড়ির দরজা জানালা বন্ধ হয়ে যায়। সে সময়ের শুরুতে অবরুদ্ধ অবস্থা থেকে একটু স্বচ্ছ নিঃশ্বাস নিতে সকালে বাড়ির বাইরে বের হন সামশাদ হোসেন বাদশাহ। বাড়ির সামনের রাস্তায় হাঁটার সময় সকাল ১০টা নাগাদ পাকিস্তানি পাঞ্জাবী মিলেটারির নজরে পড়েন। দ্রুত তাকে তারা পাকড়াও করে। পাছায় লাগায় বেতের ঘা। এরপর সেনাবাহি গাড়ীতে তোলে। নিয়ে যায় সৈয়দপুর ক্যান্টনমেন্ট এলাকায়। ক্যান্টনমেন্টের পাশেই তিনি দেখতে পান শতশত মানুষ কাজ করছে। বাঁশের তৈরী টুকরিতে (ডালি) করে সবাই মাথায় মাটি নিয়ে গিয়ে মাঠে ফেলছে। কেউ মাথায় করে ইট নিয়ে যাচ্ছে। সামশাদ হোসেন বাদশাহকেও পাকি সৈন্যরা ওইসব মানুষদের সঙ্গে কাজে লাগায়। তিনি জানান মাটি বহনকারীদের মাথায় দেয়া হয় একসাথে দুই টুকরি করে মাটি। আর যারা ইট বহন করে তাদের মাথায় ১০ থেকে ১২টি করে ইট দেয়া হয়। আর এসব মানুষদের কাজ দেখভাল করতে বেত হাতে দাঁড়িয়ে থাকে পাকি সৈন্যরা। পান থেকে চুন খসলেই সপাং সপাং করে বেতের ঘা পিঠে মারা হত। অনেকে মারের চোটে অজ্ঞান হয়ে পড়তো। পানি খেতে চাইলেও মিলতো না পানি। জনশ্রুতি আছে অনেকে নির্যাতনে মারাও যেত। যারা মারা যেত তাদেরকে পাশের ঝোপঝাড়ে নিয়ে গিয়ে গর্ত করে কবর দেয়া হতো। সকাল আটটা থেকে বিকাল চারটা পর্যন্ত বিরামহীনভাবে কাজ করতে হতো। দেয়া হতো না কোন খাবার।
শহরের অবরুদ্ধ ও গ্রাম থেকে বাঙ্গালীদের ধরে নিয়ে এসে কাজ করানো হতো। এমনকি পার্বতীপুর থেকেও রেলের সাটল ট্রেনে করে বাঙ্গালীদের ধরে এনে মাটি ও ইট বহন করার কাজ করানো হতো। এভাবেই পাকি সৈন্যরা নিরীহ বাঙ্গালীদের দিয়ে তাদের জাঁকজমক জমজম এয়ারপোর্ট নির্মাণ করে। সেই দিনের কথা মনে হলে আজও শিউরে উঠে সামশাদ হোসেন বাদশাহ। বর্তমানেও তার শরীরে বেতের ঘার আঘাত রয়েছে। শীতকাল এলেই শরীরে অসহ্য ব্যথা শুরু হয় তার। বাঙ্গালীর জীবন আর বেতের লাঠির আঘাতেই গড়ে ওঠে আজকের সৈয়দপুর বিমানবন্দর।
রংপুর জেলার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বইয়ের তথ্য মতে, ১৯৭১ সালে পাকি সেনাদের সহযোগী মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী শক্তি উর্দুভাষী অবাঙ্গালীরা উত্তরাঞ্চলের বিহারী অধ্যুষিত এলাকা, পার্বতীপুর, রংপুর ও দিনাজপুরের অংশ বিশেষ নিয়ে নিউ বিহার প্রদেশ করতে চাইছিল। আর এই নতুন প্রদেশের রাজধানী করতে চাইছিল বিহারী নিয়ন্ত্রিত সৈয়দপুর শহরকে। এজন্যই পাকি সৈন্যরা সৈয়দপুর সেনানিবাসের পাশেই গড়ে তোলে বিমানবন্দর। যাতে করে আকাশপথে সরাসরি পশ্চিম পাকিস্তানে যাতায়াত করা যায়। একই সঙ্গে সামরিক অস্ত্রসস্ত্র আনা নেয়া কাজেও তারা এই বিমানবন্দর ব্যবহার করতে পারে। এমনকি সেই সময়ে রংপুর ও সৈয়দপুর সেনানিবাসে কর্মরত পাকি সৈন্যরা উত্তরাঞ্চলের বৃহত্তর রংপুরের বর্তমানের আট জেলা তাদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে সৈয়দপুরে বিমানবন্দর নির্মাণের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে। এ কারণে সারাদেশ ১৬ ডিসেম্বর শত্রুমুক্ত হলেও সৈয়দপুরে বিজয়ের পতাকা উড়ে ১৮ ডিসেম্বর। স্বাধীন দেশে বিজয়ের পতাকা উড়ার সাথে দেশ শত্রুমুক্ত হয়। আর পাকিদের তৈরী জমজম এয়ারপোর্টের নাম পরিবর্তন হয়ে সৈয়দপুর বিমানবন্দর নামকরণ করা হয়। বিগত ১৯৭৭ সালে তৎকালীন সামরিক প্রশাসক মরহুম জিয়াউর রহমান সৈয়দপুর বিমানবন্দর উদ্বোধন করেন।
তবে বাঙ্গালীর স্মৃতিবিজড়িত এই বিমানবন্দরে একটি স্মৃতি চত্বর নির্মাণের দাবি জানিয়েছেন সংরক্ষিত আসনের এমপি রাবেয়া আলীম, উপজেলা আ’লীগের সাধারণ সম্পাদক ও শহীদ সন্তান মহসিনুল হক মহসিন ও পৌর আ’লীগের সভাপতি রফিকুল ইলাম বাবু ও আ’লীগের তরুণ প্রজন্মের জনপ্রিয় নেতা প্রকৌশলী একেএম রাশেদুজ্জামান রাশেদ।
তারা জানান কিভাবে, কেমন করে, কাদের দিয়ে, কি ত্যাগের বিনিময়ে এই বিমানবন্দর নির্মাণ হয়েছে তা নতুন প্রজন্মের সামনে তুলে ধরতে স্মৃতি চত্বর গড়ে তোলা সময়ের দাবি।
আগামীনিউজ/নাসির