দেশেই রেলের যন্ত্রাংশ উৎপাদনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। সেজন্য একটি নীতিমালা প্রস্তুত করা হয়েছে। নতুন কিংবা আয়ুষ্কাল শেষ হয়ে যাওয়া ইঞ্জিন-কোচ মেরামতে আমদানিনির্ভর যন্ত্রাংশের বিকল্প উৎস সৃষ্টির লক্ষ্যে ওই নীতিমালা রেলওয়ের জন্য কল্যাণ বয়ে আনবে। বর্তমানে দেশে যেসব ট্রেন চলাচল করছে সেগুলোর অধিকাংশের ইঞ্জিন-কোচই বয়সের ভারে ন্যুব্জ। সেজন্যই মাঝেমধ্যেই সেগুলো বিকল হয়ে পড়ে। বর্তমানে ৮৭ শতাংশ ইঞ্জিন ও ৭৭ শতাংশ কোচের আয়ুষ্কাল শেষ। আর সেগুলো সচল রাখতে যন্ত্রাংশ আমদানি করতে হচ্ছে। মূলত ওই কারণে দেশেই যন্ত্রাংশ উৎপাদনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। রেলপথ মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, বর্তমানে ইঞ্জিন-কোচ মেরামত এবং লাইন ও সিগন্যাল ব্যবস্থা ঠিক রাখতে প্রায় হাজার কোটি টাকা প্রয়োজন হয়। কিন্তু নতুন নীতিমালা চূড়ান্ত হলে রেলওয়ের নিজস্ব কারখানাতেই যন্ত্রাংশ তৈরি হবে। রেলের অনেক ইঞ্জিন-কোচের আয়ুষ্কাল শেষ হয়ে এখন বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তার মধ্যে ২০১৩ সালে চীন থেকে আনা ডেমু ট্রেনের আয়ুষ্কাল নির্ধারিত সময়ের আগে শেষ হতে চলেছে। ৬৫৪ কোটি টাকায় কেনা ২০টি ডেমু ট্রেনের মধ্যে বর্তমানে সচল মাত্র ৩টি আছে। ৩৫ বছর আয়ুষ্কাল থাকলেও ডেমু ট্রেন ১ বছর যেতে না যেতেই নষ্ট হতে শুরু করে। অচল পড়ে থাকা ডেমু সেটগুলো মেরামত করতে হলে একমাত্র চীন থেকেই যন্ত্রাংশ সংগ্রহ করতে হবে। আর ওই যন্ত্রাংশের দাম বিশ্ববাজারের চেয়ে প্রায় ১০ গুণ বেশি। অর্থাৎ সেগুলো মেরামত করতে ক্রয়ের প্রায় সমপরিমাণ টাকা লাগবে। নীতিমালা চূড়ান্ত হলে ডেমুর অধিকাংশ যন্ত্রাংশ দেশেই উৎপাদন করা সম্ভব হবে।
সূত্র জানায়, রেলের ৯৫ শতাংশ যন্ত্রাংশ বিভিন্ন বিদেশি প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে সংগ্রহ করতে হয়। তাতে কোটি কোটি টাকা খরচ হয়। আবার সময়মতো ক্রয় করাও সম্ভব হয় না। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে যন্ত্রাংশ না পাওয়ায় ইঞ্জিনের যথাযথ মেরামতও হয় না। তখন ট্রেন পরিচালনায় হিমশিম খেতে হয়। এখন নীতিমালা চূড়ান্তের মধ্য দিয়ে ওই সমস্যা সমাধান করতে চাচ্ছে রেলওয়ে। আর দীর্ঘ সময় নিয়ে নীতিমালা প্রস্তুত করা হয়েছে। কারণ রেল শুধু আমদানিনির্ভর হতে পারে না। রেলেও দক্ষ শ্রমিক রয়েছে। দেশেই নতুন ইঞ্জিনসহ অধিকাংশ যন্ত্রাংশ তৈরি করা সম্ভব। যে হারে রেলে উন্নয়ন হচ্ছে, সামনের দিনগুলোয় যন্ত্রাংশের চাহিদাও ব্যাপক বাড়বে। আর নীতিমালা অনুযায়ী যন্ত্রাংশ দেশের মাটিতে উৎপাদন সম্ভব হলে রেলে সেবা দারুণভাবে বাড়বে। খসড়া নীতিমালায় সর্বোচ্চ সংখ্যক লোকোমোটিভের যন্ত্রাংশ দেশে তৈরির সুযোগ সৃষ্টি, রেলে যন্ত্রাংশ সরবরাহের জন্য টেকসই উদ্যোক্তা তৈরিসহ ৭টি উদ্দেশ্য রয়েছে, যা দেশ ও রেলের কল্যাণ বয়ে আনবে।
সূত্র আরো জানায়, আয়ুষ্কাল শেষ হয়ে যাওয়া কিংবা নতুন ইঞ্জিন-কোচ মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য নিয়মিত যন্ত্রাংশের দরকার হয়। একই সঙ্গে প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশ মজুত রাখতে হয়। অধিকাংশ ইঞ্জিন যন্ত্রাংশের কোনো ড্রয়িং-স্পেসিফিকেশন না থাকায় পার্ট নম্বর ও বিবরণের ভিত্তিতে চিহ্নিত করতে হয়। বিশ্বে ওসব যন্ত্রাংশ বিলুপ্তির পথে। কিন্তু শুধুমাত্র ইঞ্জিন সচল রাখার জন্যসেগুলো বেশি অর্থ দিয়ে ক্রয় করতে হয়। এমন পরিস্থিতিতে পরনির্ভরশীলতা কমাতে বিসিক নীতিমালার আওতায় এবং পরবর্তী রেলওয়ের মেকানিক্যাল শাখা থেকে জারি করা নীতিমালা অনুযায়ী স্থানীয় প্রস্তুততকারকদের সাময়িকভাবে যন্ত্রাংশ তৈরির অনুমোদন দেয়া হয়। কিন্তু যথাযথ মনিটরিং, নীতিমালা ও গাইডলাইন না থাকায় তা আলোর মুখ দেখেনি। কোনো শিল্পোদ্যোক্তাও এগিয়ে আসেনি। এখন শিল্প উদ্যোক্তাদের বিনিয়োগ নিশ্চয়তা ও গুণগতমানের যন্ত্রাংশ ক্রয়ের নিশ্চয়তা রেখেই নীতিমালা করা হয়েছে। নতুন নীতিমালার কারণে বছরের পর বছর উদ্যোক্তারা রেলওয়ের সঙ্গে ব্যবসা করতে পারবে। যেসব উদ্যোক্তা বা প্রতিষ্ঠানের বিসিক তালিকাভুক্তির বা অনুরূপ অন্য কোনো সনদ, নিজস্ব কারখানা, পর্যাপ্ত মেশিনারিজ, দক্ষ জনবল ও আর্থিক সক্ষমতা রয়েছে, তারা যন্ত্রাংশ উৎপাদনের জন্য যোগ্য হবে। রেলওয়ে কর্তৃক গঠন করা ডকুমেন্ট অ্যাসেসমেন্ট কমিটি, ফ্যাক্টরি ইনস্পেকশন কমিটি, কোয়ালিটি ম্যানেজমেন্ট কমিটি ও মূল্য নির্ধারণ কমিটি ওসব বিষয় দেখাশোনা করবে।
এদিকে এ ব্যাপারে রেলওয়ের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (আরএস) মঞ্জুর-উল-আলম চৌধুরী জানান, নীতিমালা চূড়ান্ত হওয়ার পর রেলে আমূল পরিবর্তন আসবে। একই সঙ্গে দেশীয় শিল্পোদ্যোক্তারা উপকৃত হবেন। দেশের অর্থ দেশে থাকবে, এগিয়ে যাবে রেল। রেলের ইঞ্জিনে ২৫ হাজার ধরনের যন্ত্রাংশ প্রয়োজন হয়। যন্ত্রাংশগুলো বিশেষ আইটেম। ওসব আইটেমের মাত্র ৫ শতাংশ বাংলাদেশে উৎপাদন হয়।
অন্যদিকে এ বিষয়ে রেলপথ সচিব সেলিম রেজা জানান, নীতিমালা চূড়ান্ত হলে দেশেই নতুন কোচ তৈরি করা হবে। ইঞ্জিন মেরামত করতে আমদানিনির্ভর যন্ত্রাংশের দিকে তাকিয়ে থাকতে হবে না। যন্ত্রাংশ তৈরি-উৎপাদনে দেশীয় শিল্পোদ্যোক্তাদের পাশে থাকবে রেল।
আগামীনিউজ/শরিফ