কুমিল্লাঃ মুসলমানদের অন্যতম প্রধান ধর্মীয় উৎসব ঈদুল আজহা বা কোরবানির ঈদ। এ ঈদে সৃষ্টিকর্তার সন্তুষ্টি অর্জনে উদ্দেশ্যে কোরবানি করা হয়। সামর্থ্যবান প্রত্যেক মুসলমান বছরে একবার ঈদুল আজহায় ওয়াজিব হিসেবে ঈদের দিন বা পরবর্তী দুদিন কোরবানি দিয়ে থাকেন। কোরবানি শুধু পশু জবাই নয়, এর সাথে ত্যাগ এবং পরিচ্ছন্নতার বিষয়টি গভীরভাবে জড়িত। কোরবানি শব্দের অর্থ ত্যাগ।
কোরবানি মুসলমানদেরকে ত্যাগের দীক্ষা দেয় যাতে করে তারা জীবনে এই ত্যাগ প্রতিষ্ঠা করে কল্যাণের দিকে এগিয়ে যেতে পারে। কিন্তু এই ত্যাগের শিক্ষাই সব নয়। এর সাথে পশু কোরবানির পর সৃষ্ট বর্জ্য কিভাবে পরিষ্কার করতে হবে সে বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করতে হবে। দেশের অধিকাংশ কোরবানিদাতাই সুষ্ঠুভাবে পশু কোরবানি দিতে কী কী করণীয় সে বিষয়ে সচেতন নন। সুষ্ঠুভাবে কোরবানি না দিলে পরিবেশ দূষণ ঘটে যা ধর্মীয় এবং সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে অগ্রহণযোগ্য। কোরবানি দিতে পারা একজন মুসলমানের জন্য অত্যন্ত আনন্দের।
কিন্তু, আমরা সচেতন না বলে আনন্দের চাইতে অসুবিধার মুখোমুখি হই বেশি। কারণ যত্রতত্র কোরবানি দেওয়া; চামড়া, রক্ত, ব্যবহৃত চাটাই ইত্যাদি যাবতীয় আবর্জনা যেখানে-সেখানে ফেলে দেওয়ার ফলে খুব দ্রুত জীবাণু সংক্রমণসহ দুর্গন্ধ ছড়াতে থাকে। এতে বায়ু, পানি ও মাটি- তিনটি প্রাকৃতিক উপাদানই দূষিত হয়। যার দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি বা প্রভাব থাকে। সৌদি আরব, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়াসহ বিভিন্ন মুসলিম দেশে একটি নির্দিষ্ট স্থানে কোরবানি দেওয়া হয়। সে দেশের মুসলমানগণ মসজিদ বা লাইসেন্সপ্রাপ্ত জবাইখানাতে কাজটি সম্পন্ন করে থাকেন।
কিন্তু আমাদের সারা দেশে ঈদুল আজহা পরবর্তী অভিজ্ঞতা বড়োই তিক্ত। নির্দিষ্ট স্থানে তো নয়ই, অনেকে নিজেদের সুবিধার জন্য ঘরের কাছে, এমনকি চলাচলের রাস্তার উপরও কোরবানি দিয়ে থাকেন। তাই আমাদের দেশে ঈদ পরবর্তী পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা আরও বেশি জরুরি। কোরবানি পরবর্তী পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার লক্ষ্যে গভর্নেন্স ইনোভেশন ইউনিট (জিআইইউ) ২০১৫ তা বাস্তবায়নে কাজ করছে।
সকল সিটি কর্পোরেশন, পৌরসভা ও জেলা সদরে প্রতি বছর জনস্বার্থে নির্ধারিত স্থানে কোরবানির পশু জবাই নিশ্চিত করতে বলা হয়। এবারও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় সিটি কর্পোরেশন ও পৌরসভার মেয়র, বিভাগীয় কমিশনার এবং জেলা প্রশাসক বরাবর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছে।
পরিবেশ দূষণ রোধকল্পে ও জনস্বাস্থ্যের সুরক্ষায় নির্ধারিত স্থানে কোরবানির পশু জবাই কার্যক্রমকে মূলত তিনটি পর্যায়ের অধীনে পরিকল্পনা করা হয় যা সকল বিভাগীয় সদর, সিটি কর্পোরেশন, পৌরসভা ও জেলা সদরে প্রেরণ করা হয়। এ তিনটি পর্যায় হচ্ছে (১) কোরবানির পশু সংখ্যার নিরিখে কোরবানির স্থান নির্ধারণ ও কোরবানি প্রদানের উপযোগীকরণ, জনমত গঠন ও প্রচার, বেসরকারি উদ্যোগকে উৎসাহ প্রদান, সম্ভাব্য ব্যয় নির্ধারণ ও তার সংস্থান (২) সুষ্ঠুভাবে কোরবানি প্রদান নিশ্চিতকরণ এবং (৩) বর্জ্য ব্যবস্থাপনা।
সরকার গত কয়েক বছর ধরে সিটি কর্পোরেশনের মাধ্যমে পশু কোরবানি দেওয়ার জন্য স্থান নির্ধারণ করে দেওয়া এবং বর্জ্য ফেলার জন্য ব্যাগ সরবরাহের উদ্যোগ নিয়েছে। জনগণের মাঝে সচেতনতা সৃষ্টির মাধ্যমে বর্ণিত সুবিধাদি গ্রহণ করে নিজ নিজ এলাকাকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও পরিবেশবান্ধব রাখা সম্ভব। সিটি কর্পোরেশনের নির্ধারিত স্থানে পশু জবাই করা এবং প্রয়োজনে ব্যবস্থাপনা কমিটির সহযোগিতা নেয়া যেতে পারে। তবে শুধু সরকারি পদক্ষেপের জন্য অপেক্ষা করলে চলবে না। এলাকাভিত্তিক ব্যক্তিগত বা সমষ্টিগত ছোটো-ছোটো পদক্ষেপই বৃহৎ আকারে কার্যকর ভূমিকা রাখা যায়।
কোরবানি করা পশুর হাড়, লেজ, কান, মাথার খুলি ও পায়ের অবশিষ্টাংশ অবশ্যই এলাকার নির্দিষ্ট স্থানে ফেলে দিতে হবে। চেষ্টা করতে হবে কোনো মোটা প্লাস্টিকের ব্যাগে জড়িয়ে সেটি কাছাকাছি নির্দিষ্ট স্থানে রেখে দেওয়া। সিটি কর্পোরেশন কর্তৃপক্ষ ১-২ দিনের মধ্যেই তা সরিয়ে নেওয়ার বিষয়ে উদ্যোগ নিয়ে থাকে। কোরবানির সময় ব্যবহৃত পাটি, হোগলা, ন্যাকড়া, কাপড় বা কাঠের গুঁড়ি- এ ধরনের সামগ্রী রাস্তায় না ফেলে নির্দিষ্ট স্থানে ফেলার ব্যবস্থা করতে কোরবানি আদায়কারীর সচেতন থাকা জরুরী। কোরবানি যেন অন্যের বিরক্তি বা অসুবিধার কারণ না হয় সেদিকে অবশ্যই যত্নবান হতে হবে। বিভিন্ন স্থানে কোরবানির পশুর বর্জ্য অপসারণে কন্ট্রোলরুম স্থাপন করা হয়েছে। ডাম্পার, পে লোডার, টায়ার ডোজার, পানির গাড়ি (জেট স্প্রেসহ), প্রাইম মুভার, ট্রেইলার, স্কেভেটর, চেইন ডোজার পরিচ্ছন্নতা কাজে গতিশীলতা আনতে ব্যবহার করা হবে যা দ্রুত কোরবানি পরবর্তী বর্জ্য অপসারণে সহায়ক হবে।
কোরবানির মাধ্যমে শুধু আত্মত্যাগ নয়, আত্মসচেতনতার শিক্ষাও নিতে হবে। কারণ পশু জবাইয়ের ফলে সৃষ্ট বর্জ্য যদি পরিবেশ দূষণ করে তবে তা ব্যক্তির সামাজিক মর্যাদা ক্ষুন্ন হয়। প্রত্যেকের সচেতনতায় কোরবানিদাতার আত্মার শুদ্ধতার পাশাপাশি পরিবেশের শুদ্ধতাও নিশ্চিত হবে- এ প্রত্যাশা সকলের প্রতি।