ঢাকাঃ মসজিদুল হারাম এবং মসজিদে নববীর নয়নাভিরাম সৌন্দর্যে যে কেউই মুগ্ধ হবেন। এই ঐতিহাসিক মসজিদ দুটি মুসলমানদের কাছে অন্যতম পবিত্র স্থান। সৌদি আরবের মক্কা শহরে অবস্থিত মসজিদুল হারাম ইসলামের সবচেয়ে পবিত্র স্থান যা কাবাকে ঘিরে অবস্থিত। অন্যদিকে মসজিদে নববী হজরত মুহাম্মদ (সা.) কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত মসজিদ, যা বর্তমান সৌদি আরবের মদিনায় অবস্থিত। গুরুত্বের দিক থেকে মসজিদুল হারামের পর মসজিদে নববীর স্থান। হজরত মুহাম্মদ (সা.) হিজরত করে মদিনায় আসার পর এই মসজিদ নির্মাণ করা হয়।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বহুবার পুনর্নির্মাণ কিংবা সংস্কার করা হয়েছে মুসলমানদের এই পবিত্র দুটি মসজিদ। বর্তমানে এই পবিত্র স্থান দুটির যে নয়নাভিরাম সৌন্দর্য আমরা দেখছি তার সূচনা হয় আধুনিক মিসরীয় স্থপতি ড. কামাল মুহাম্মদ ইসমাইলের হাত ধরে। তার অক্লান্ত প্রচেষ্টায় আজ সুন্দর রূপ পেয়েছে মসজিদুল হারাম এবং মসজিদে নববী।
স্থপতি ড. কামালই মক্কা ও মদিনার পবিত্র দুই মসজিদের আধুনিকায়নের প্রথম কারিগর। এরপর থেকেই কামাল মুহাম্মদ ইসমাইলকে বলা হয় ‘প্রফেসর অব জেনারেশনস’। যিনি বিনা পারিশ্রমিকে মেধা এবং শ্রম দিয়েছেন রাসূল (সা.)-এর স্মৃতিবিজড়িত স্থানে।
স্থপতি ড. কামাল মুহাম্মদ ইসমাইলের পরিচয়:
কামাল মুহাম্মদ ইসমাইল ১৩ সেপ্টেম্বর ১৯০৮ মিসরে সম্ভ্রান্ত ধার্মিক পরিবারের জন্মগ্রহণ করেন। সে সময় তিনি মিসরের ইতিহাসে সবচেয়ে কম বয়সে উচ্চ বিদ্যালয়ের সার্টিফিকেট অর্জন করেন। রয়েল স্কুল অব ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ভর্তি হওয়া এবং স্নাতক অর্জনে সবচেয়ে কম বয়সী ব্যক্তিও ছিলেন এ মানুষটি। সবচেয়ে কম বয়সে ইসলামি আর্কিটেকচারে তিনটি ডক্টরেট ডিগ্রি প্রাপ্তির জন্য ইউরোপে গমন করেন। সে সময়ে ‘নীল স্কার্ফ’ এবং ‘আয়রন র্যাংক’ প্রাপ্ত সর্বকনিষ্ঠ ব্যক্তিও তিনি।
দেরিতে হলেও ৪৪ বছর বয়সে বিয়ে করেন এই গুণী স্থপতি। তার স্ত্রী পুত্রসন্তান জন্ম দেওয়ার সময় মারা যান। পরে একাই বাকি জীবন পার করেন তিনি। জীবনের শেষ দিনগুলোয় গণমাধ্যম, যশ-খ্যাতি ও অর্থের মোহ থেকে দূরে থেকে পবিত্র দুই মসজিদের সেবা ও আল্লাহর ইবাদতে অতিবাহিত করেন ড. ইসমাইল।
মসজিদুল হারাম এবং মসজিদে নববীর আধুনিক রূপকার:
ড. ইসলামাইল প্রথম স্থপতি যিনি মক্কা ও মদিনা মসজিদ সম্প্রসারণের পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন করেন। মসজিদুল হারাম এবং মসজিদে নববীসহ বিভিন্ন কাজে অবদান রাখায় কোনোদিন অর্থ নেননি তিনি। এমনকি সৌদির তৎকালীন বাদশাহ ফাহাদ এবং বিন লাদেন এই কারিগরকে কাজের পুরস্কার হিসেবে বিপুল অঙ্কের অর্থ দিতে চাইলে ফিরিয়ে দেন তিনি।
বাদশাহ বকর বিন লাদেনকে একবার স্থপতি ইব্রাহিম বলেন, মজিদের মতো পবিত্র স্থানে কাজের বিনিময়ে কেন আমি অর্থ নেব? শেষ বিচারের দিন আমার সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর সামনে কীভাবে মুখ দেখাব?
মসজিদুল হারাম-এ তাওয়াফ করতে ছুটে আসেন বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মুসলমানরা। প্রয়োজনের তাগিদে এর সংস্কার এবং আধুনিকায়নের দায়িত্ব পান এই স্থপতি। তখন তাওয়াফকারীদের সুবিধার্থে মসজিদুল হারামের তাওয়াফের স্থানটুকু মার্বেল পাথর বসানোর পরিকল্পনা নেন। তৎকালীন সময়ে গ্রিসের একটি পাহাড়েই সবচেয়ে ভালো সাদা মার্বেল পাথর পাওয়া যেত, এমন খবর পান স্থপতি ইসমাইল। তখনই ছুটে যান সুদূর গ্রিসে। তাপশোষণ করতে পারে মূল্যবান দুর্লভ সাদা মার্বেলের জন্য সেখানকার কর্তৃপক্ষের সঙ্গে চুক্তি করেন তিনি। মজিদুল হারামের জন্য প্রায় অর্ধেক পাহাড় পরিমাণ মার্বেল কেনার চুক্তিও স্বাক্ষর করেন। চুক্তিতে স্বাক্ষর করে আবার মক্কায় ফেরেন। পরবর্তীতে নিখুঁতভাবে মসজিদের মেঝেতে মার্বেলের স্থাপনের কাজ শেষ করেন স্থপতি ইসমাইল।
১৫ বছর পর। মদিনার মসজিদেও একইভাবে মার্বেল স্থাপনের জন্য গুণী ও ধার্মিক স্থপতি মুহাম্মদ ইসমাইলকেই দায়িত্ব দেন তৎকালীন সৌদির বাদশাহ। এ বিষয়ে কামাল বলেন, ‘হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর মসজিদেও একইভাবে ঢাকতে বলায়, আমি খুবই চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলাম। কারণ, এই ধরনের মার্বেল পৃথিবীতে মধ্যে গ্রিসের একটি জায়গাতেই ছিল। ১৫ বছর আগে ওই পাহাড় থেকে দুর্লভ মার্বেলের অর্ধেক কিনে নেই আমি।’
হাল না ছাড়া এই স্থপতি আবারো হাজারো মাইল পাড়ি দিয়ে ছুটে যান গ্রিসে। ওই মার্বেল কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালকের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। একই সঙ্গে মসজিদের জন্য মার্বেলের কথা তুলে ধরেন। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটির কর্তৃপক্ষ তাকে বলেন, ১৫ বছর আগে তিনি চলে যাওয়ার পর মার্বেল বিক্রি হয়ে যায়।
পরিচালকের কথায় নিরাশ হন স্থপতি ইসমাইল। তবে গ্রিস ত্যাগ করার আগে যে কোম্পানির কাছে ওই মার্বেল বিক্রি করা হয় তাদের ঠিকানা জানতে চান তিনি। কিন্তু বিষয়টি অনেক বছর আগের হওয়ায় ঠিকানা আছে কিনা সন্দেহ প্রকাশ করে মার্বেল কোম্পানি। তবে অবশেষে তাদের ঠিকানা পাওয়া যায়।
অনেক খোঁজ করে প্রকৌশলী কামাল মুহাম্মদ ইসমাইল সৌদি আরবে পৌঁছে পাথর ক্রয়কারী প্রতিষ্ঠানের পরিচালকের সঙ্গে দেখা করেন। জানতে চান, কিনে নেয়া ওই মার্বেল সম্পর্কে। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটির দায়িত্বপ্রাপ্তরা এতদিনের পুরনো ঘটনা মনে করতে পারছিল না। তবে, মজুতখানার দায়িত্বশীলদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেন। জানা যায়, কেনা পাথর এখনো কোথাও ব্যবহার করা হয়নি।
এমন খবরে শিশুর মতো কেঁদে উঠলেন মুহাম্মদ ইসমাইল। তখন পুরো বিষয়টি সংস্থাটির মালিককে খুলে বললেন। স্থপতি কামাল সংস্থার মালিককে একটি ফাঁকা চেক দিয়ে বলেন, তিনি যত দাম চান তা লিখে নিতে।
কিন্তু মালিক জানতে পারলেন, মার্বেলটি মহানবী (সা.)-এর মসজিদের জন্য ব্যবহার করা হবে। তিনি বলেন, ‘নবীর মসজিদে মার্বেল ব্যবহার করার জন্য আমি কোনও রিয়াল নেব না’। পরে এই মার্বেল রাসূল (সা.)-এর মসজিদে বসান স্থপতি ইসমাইল।
স্থপতি ইসমাইলের মৃত্যু:
জীবনের শেষদিন পর্যন্ত এই মহান স্থপতি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান সংস্কার এবং আল্লাহর ইবাদত বন্দেগিতে সময় কাটান। ২০০৮ সালের ২ আগস্ট ইন্তেকাল করেন তিনি।
আগামীনিউজ/প্রভাত