Dr. Neem on Daraz
Victory Day

গ্রামীণ জীবনে নাগরিক স্বস্তি এনেছে ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টার


আগামী নিউজ | ডেস্ক রিপোর্ট প্রকাশিত: আগস্ট ৫, ২০২১, ০৪:৫৫ পিএম
গ্রামীণ জীবনে নাগরিক স্বস্তি এনেছে ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টার

ছবিঃ সংগ্রহিত

রংপুর: সারাদেশে ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টার (ইউডিসি)গুলো গ্রামীণ জীবনে এনেছে নাগরিক স্বস্তি। জেলার সদর থানার সদ্যপুস্করিনী ইউনিয়নের ইউডিসি তারই এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। এই কেন্দ্রটি শহরের ডিজিটাল সেবাসমূহকে গ্রাম পর্যায়ের মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে অনন্য ভূমিকা রাখছে। 

এই ইউডিসি’র উদ্যোক্তা আরিফুজ্জামান মুন বাসসকে বলেন, সদ্যপুস্করিনী ইউডিসি থেকে ১২০টি’র ও বেশি অনলাইন বা অফলাইন সেবা দেয়া হয়ে থাকে। আগে যেসব সেবার জন্য মানুষকে উপজেলা বা জেলা সদরে যেতে হতো এখন সেসব সেবা এখান থেকেই পাওয়া যাচ্ছে। তিনি জানান, প্রতিদিন গড়ে প্রায় ১০০ জন লোক এই সেন্টার থেকে সেবা নিয়ে থাকেন।  

সেবা নিতে আসা বিভিন্ন গ্রামের বাসিন্দা রত্না বেগম, আব্দুস সোবাহান, মিজানুর রহমান এবং রহিমা বেগম। বাসস প্রতিনিধির সাথে আলাপকালে তারা জানান, নিজেদের হারিয়ে যাওয়া জাতীয় পরিচয়পত্রের অনুলিপি নিতে তারা ইউডিসিতে এসেছেন। কিন্তু তাদের কাছে জাতীয় পরিচয়পত্র সম্পর্কিত কোন কাজপত্রই নেই। এজন্য তারা ইউডিসির উদ্যোক্তা আরিফুজ্জামান মুন-এর কাছে এসেছেন, হারিয়ে যাওয়া জাতীয় পরিচয়পত্রের অনুলিপি সংগ্রহের জন্য। ইউডিসি থেকে হয়রানিমুক্তভাবে ও দ্রুততার সাথে নিজেদের হারানো পরিচয়পত্রের ‘সার্টিফায়েড কপি’ পেয়ে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলেন এসব সাধারণ মানুষ।  

মুন বলেন, “আমার কাছে সদ্যপুস্করিনী ইউনিয়নের পুরো ভোটার তালিকা আছে। আমি ভোটার তালিকা অনুযায়ী অনলাইনে তাদের পরিচয়পত্র খুঁজে বের করে কয়েক মিনিটের মধ্যেই অনুলিপি দিতে পারি। 

দেওডোবা গ্রামের অজয় রায়, পালিছাড়ার সাজু মিয়া ও ফিরোজ মিয়া এবং উত্তরপাড়ার মনোয়ারা বেগম এসেছিলেন জমির ‘পড়চা’র জন্য। তারা জানালেন, ১১০ টাকা করে ফি জমা দিয়ে সাত কার্যদিবসের মধ্যেই জমির পড়চার অনুলিপি হাতে পেয়েছেন। সাজু মিয়া বলেন, “ইউডিসি না থাকলে আমাকে আগের মতো জেলা সদরের অফিসে দৌড়াতে হতো। আমি এত সহজে জমির পড়চা পেয়ে নিশ্চিন্ত হলাম।”  

প্রতিবেদকের সাথে কথা হয় হজ্জ্ব নিবন্ধন করতে আসা আব্দুর রাজ্জাক, আব্দুল আউয়াল, জরিনা বেগম, রবিউল ইসলাম ও মোকসেদ মিয়ার সাথে। কম সময়ে এবং সহজে হজ¦ নিবন্ধন করতে পেরে সন্তোষ প্রকাশ করেন তারা। 
আদর্শপাড়া গ্রামের সাবিত্রি রায় এসেছিলেন বয়স্ক ভাতার টাকা নিতে। তিনি বলেন, “ইউডিসি আমাদের ইউনিয়নের মানুষের জন্য আর্শিবাদ। এটা সরকারি সেবাগুলিকে আমাদের ঘরের দুয়ারে নিয়ে এসেছে। আমি বাড়ি থেকে হেঁটে আসি। ভাতা নিয়ে আবার হেঁটেই বাড়ি ফিরি। আমার কোন যাতায়াতের খরচও লাগেনা।” 
অতিদরিদ্রদের জন্য কর্মসংস্থান প্রকল্পের সুবিধাভোগী ভেলু গ্রামের আশরাফ আলী, ভেলুবাওড় গ্রামের সেলিমা খাতুন ও জমিদারপাড়া গ্রামের বিশু চন্দ্র ইউডিসি’তে এসেছিলেন বাঁধ তৈরীর কাজের মজুরী নিতে। নিজের ইউনিয়ন থেকে মজুরীর টাকা সংগ্রহ করতে পেরে খুশি সেলিনা। তিনি বলেন, “আমরা এজেন্ট ব্যাংকিং এর মাধ্যমে খুব সহজেই মজুরীর টাকা ইউডিসি থেকে তুললাম।”  

একইরকম ভাবে মাতৃত্বকালীন ভাতা, অনলাইনে চাকুরীর আবেদনপত্র পূরণ ও জমা দেয়া, ভর্তির আবেদনপত্র জমা দেয়া, পরীক্ষার প্রবেশপত্র সংগ্রহ, ইমেইল করা, জরুরী কাগজপত্রের প্রিন্ট ও ফটোকপি, বিদ্যুত বিল জমা দেয়ার মতো দৈনন্দিন গুরুত্বপূর্ণ  সেবাগুলো এই ইউডিসি থেকে দেয়া হয়।    

কেশবপুর গ্রামের বিপ্লব মিয়া বলেন, “অনেকের মতো আমিও প্রতি মাসের বিদ্যুত বিল সহজেই ইউডিসিতে এসে পরিশোধ করি।” 

সদ্যপুস্করিনী ইউনিয়নের আওয়ামীলীগ সভাপতি এবং স্থানীয় ব্যবসায়ী মোকসেদুর রহমান দুলু বলেন, “আমি নিয়মিত আমার সকল ব্যবসায়িক কাগজপত্র ও আবেদনপত্র স্থানীয় ইউডিসি থেকে পাঠিয়ে থাকি।” 

চট্টগ্রাম মেরিন একাডেমির ছাত্র পালিছাড়া গ্রামের সাখাওয়াত হোসেন সাহিদ জানান, করোনায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় তিনি নিয়মিত এই ইউডিসি থেকেই ইমেইলের মাধ্যমে সব এ্যাসাইনমেন্ট জমা দিয়ে দেন।   

পোড়াগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক আব্দুর রাজ্জাক বলেন তিনি সম্প্রতি ইউডিসি থেকে ‘বেসরকারি শিক্ষক ও কর্মচারি কল্যাণ ট্রাস্টের সদস্য ফর্ম জমা দিয়েছেন। 

সচেতন কৃষক হাজিপাড়া গ্রামের মজিবর রহমান ও কেশবপুর গ্রামের তরিকুল ইসলাম ইউডিসি থেকে শস্য উৎপাদন, বালাইনাশক ব্যবহার, কৃষি প্রযুক্তি, বীজ, সার, বীজ বপন ও ফসল কাটার তথ্য জানতে এসেছেন। তাদের মতে, ইউডিসি তাদের কষ্ট ও খরচ অনেকটাই কমিয়ে দিয়েছে।  

সদ্যপুস্করিনী ইউডিসির উদ্যোক্তা আরিফুজ্জামান মুন জানান, অনলাইন ও অফলাইন ডিজিটাল সেবা দিয়ে বর্তমানে সব খরচ বাদ দিয়ে প্রতি মাসে এখান থেকে ৭০,০০০ টাকা আয় করছেন।

তবে মুনের সাফল্যের পথটা একেবারেই মসৃন ছিলো না। তাকে পেরুতে হয়েছে অনেক প্রতিবন্ধকতা। দুই ভাইয়ের মধ্যে বড় মুনের জন্ম প্রত্যন্ত গ্রাম কেশবপুরে এবং ছোট বেলা থেকে তাকে চরম দারিদ্র্যের মধ্যে লেখাপড়া চালিয়ে যেতে হয়েছে। ২০০৬ সালে এইচএসসি পাশ করে ১৬ বছর বয়সেই চার সদস্যের পরিবারের জীবিকার দায়িত্ব কাঁধে নেন তিনি। 

আরিফুজ্জামান মুন আজ জেলায় ‘ইনফো লিডার’ হিসেবে পরিচিত। এটুআই’য়ের র‌্যাংকিংএ বর্তমানে তিনি সারা দেশের সেরা দশ ইউডিসি উদ্যোক্তাদের একজন। আধুনিক তথ্য প্রযুক্তির প্রতি আগ্রহ থেকেই মুন প্রথম স্বেচ্ছাশ্রম দিতে শুরু করেছিলেন নিজ গ্রামের একটি স্টুডিওতে। উদ্দেশ্য একটাই, হাতে কলমে কম্পিউটার শিখতে হবে। কিন্ত তার একাগ্রতা, উদ্ভাবনী ক্ষমতা ও দক্ষতা দেখে স্টুডিওর মালিক তাকে অল্প কিছুদিনের মধ্যেই চাকুরিতে নিযুক্ত করেন এবং মাসিক বেতন দিতে শুরু করেন। এতেই আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠেন উচ্ছাভিলাষী এই তরুণ। 

এদিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশ নির্মাণে “ ভিশন ২০২১” বাস্তবায়নে এটুআই-এর গৃহিত বিভিন্ন কর্মসূচির সাথে পরিচয় ঘটে তার।  মুন নিজ উদ্যোগে এটুআই পরিচালিত বিভিন্ন কর্মসূচির আওতায় জাতীয় স্থানীয় সরকার ইন্সটিটিউট থেকে কম্পিউটার, আইসিটি, ইন্টারনেট এবং অন্যান্য ডিজিটাল কাজের প্রশিক্ষণ নন। পাশাপাশি পড়ালেখাও চালিয়ে যান। রংপুর কারমাইকেল কলেজ থেকে ২০১২ সালে  স্নাতক পাশ করেন।  

মুন বলেন, “২০১০ সালে হঠাতই আমি জানতে পারি যে প্রত্যেক ইউডিসিতে একজন ছেলে ও একজন মেয়ে নিয়োগ করা হবে। আমি আবেদন করি। সে বছরই নভেম্বর মাসে সদ্যপুস্করিনী ইউডিসিতে উদ্যোক্তা হিসেবে যোগ দেই।”  

মুন জানান, শুরুতে সহ-উদ্যোক্তা তাজনুর বেগমকে সাথে নিয়ে একটি মাত্র কম্পিউটার, একটি সাদাকালো প্রিন্টার এবং একটি মডেম দিয়ে সাধারণ মানুষকে ডিজিটাল সেবা  দিতে শুর করেন। কিন্তু এখন এই ইউডিসিতে রয়েছে বারোটি ডেস্কটপ, চারটি ল্যাপটপ কম্পিউটার, পাঁচটি লেজার ও দুটি রঙিন প্রিন্টার, ডিজটাল স্টিল ও ভিডিও ক্যামেরা, স্ক্যানার, ব্রডব্যান্ড সংযোগ, প্রোজেক্টর, জেনারেটর, আইপিএস, সোলার প্যানেল, পজ মেশিন ও সাউন্ড সিস্টেম ছাড়াও আরো যন্ত্রপাতি।” 

ডিজিটাল সেবার ক্রমবর্ধমান চাহিদা বিবেচনায় নিয়ে তিনি পালিছাড়া বাজারে ও নওয়াপুকুর এলাকায় আরো দুটি উপ-সেবাকেন্দ্র চালু করেছেন। এখন তিনি আট নয় হাজার টাকা বেতনের পাঁচজন কর্মচারিও রাখছেন। এই তিনটি সেবাকেন্দ্র থেকেই সাধারণ মানুষকে প্রায় ১২০ টি সেবা দেয়া হয়ে থাকে। 

তিনি জানান, ইউডিসি ও দুটি উপ-সেবাকেন্দ্রে অন্যসেবা সমূহ ছাড়াই শুধুমাত্র এজেন্ট ব্যাংকিং যেমন- বিকাশ, রকেট, সিওর ক্যাশ, নগদ, মাইক্যাশ, এনআরবিসি ও বিদ্যুত বিল থেকেই প্রতিমাসে গড়ে দেড় কোটি টাকার মতো লেনদেন হয়। এ পর্যন্ত তিনি ১,০৫০ জন শিক্ষিত ছেলে ও মেয়েকে কম্পিউটার প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। এছাড়াও তিনি সরকারি কর্মচারিদের বেসিক কম্পিউটার প্রশিক্ষকের কাজ করছেন।  

রংপুর সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ইসরাত সাদিয়া সুমি বলেন, সদ্যপুস্করিনী ইউডিসি ডিজিটাল সেবা প্রদানের মাধ্যেমে ইউনিয়নের প্রতিটি গ্রামকে শহরে রূপান্তরিত করার জন্য কার্যকর অবদান রাখছে। 

তিনি বলেন, “ইউডিসি উদ্যোক্তা আরিফুজ্জামান মুন ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার কাজে জেলার ৭৬ জন উদ্যোক্তার মধ্যে ‘আইকন’ ।  মুন তার নিজের সামাজিক মর্যাদা ও ভাগ্যও নিজেই অর্জন করেছেন।” 

আগামী নিউজ এর সংবাদ সবার আগে পেতে Follow Or Like করুন আগামী নিউজ এর ফেইসবুক পেজ এ , আগামী নিউজ এর টুইটার এবং সাবস্ক্রাইব করুন আগামী নিউজ ইউটিউব চ্যানেলে