ঢাকাঃ তাপমাত্রা ও বাতাসে সিসার পরিমাণ বৃদ্ধি, জনজীবনে ধাতব পদার্থের ব্যবহারের আধিক্য, মোবাইল ফোন ব্যবহার ও এর টাওয়ারের সংখ্যা বৃদ্ধি, বনভূমি বা গ্রামাঞ্চলে উঁচু গাছের সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে হ্রাস, জলাভূমি ভরাট ও নদী শুকিয়ে যাওয়াসহ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে দেশে বজ্রপাতের ঘটনা আশঙ্কাজনকভাবে বাড়ছে বলে বিশেষজ্ঞরা বলছেন।
জানা গেছে, বিশ্বে বজ্রপাতে মৃতের এক চতুর্থাংশই বাংলাদেশের।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে, গত ১০ বছরে বজ্রপাতে প্রাণ হারিয়েছেন প্রায় আড়াই হাজার মানুষ। এক যুগ ধরে ধাপে ধাপে এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। হতাহতের এই বিপুল সংখ্যা নিয়ে উদ্বিগ্ন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়।
বজ্রপাতে হতাহতের এত অধিক সংখ্যা নিয়ে গবেষণায় নেমেছে মন্ত্রণালয়ের জাতীয় দুর্যোগ সাড়াদান সমন্বয় কেন্দ্র (এনডিআরসি)। কারণ খতিয়ে দেখতে আজ রোববার দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. মহসীনের সভাপতিত্বে সভা হওয়ার কথা। এনডিআরসি এই দুর্যোগের সম্ভাব্য কারণ নিয়ে একটি কার্যপত্র তৈরি করেছে। খবর মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট সূত্রের।
দেশীয় গবেষণরা বলছেন, বিশ্বে বজ্রপাতে নিহতের এক-চতুর্থাংশই বাংলাদেশের। হাওর, বাঁওড় ও বিল এলাকার জেলাগুলোয় বজ্রপাতে মৃত্যু হয় বেশি। ঝড়-বৃষ্টির সময় খোলা মাঠ, নৌকা ও পথঘাটে যারা চলাচল করেন, তারাই এর শিকার হন। দেশে কয়েক বছরে বজ্রপাতের ঘটনা ১৫ শতাংশ বেড়েছে।
২০২০ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বজ্রপাতে সরকারি হিসাবে মারা গেছেন ২৩৯ জন আর বেসরকারি হিসেবে মারা গেছেন ৩৮২ জন। আহত হয়েছেন ১২৫ জন। ২০১৯ সালে সরকারি হিসাবে মারা গেছেন ১৯৮ জন আর বেসরকারি হিসাবে ৩৬০ জন। আহত হয়েছেন ১৭৯ জন। ২০১৭ সালে সারাদেশে বজ্রপাতে ৩৩৭ জন মানুষ মারা যান।
বেশির ভাগ মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে হাওরাঞ্চলে। এর মধ্যে কিশোরগঞ্জ জেলায় ১৯, সিলেটে ২৬, নেত্রকোনায় ১৮ ও দিনাজপুরে ৮ জন মারা যান। এছাড়া বজ্রপাতে গবাদিপশুরও মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে অনেক। চলতি বছরের ৩১ মার্চ কালবৈশাখি ঝড়, শীলাবৃষ্টি ও বজ্রপাতে একদিনে দেশের আট জেলায় মৃত্যুবরণ করেছেন ১২ জন, আহত হয়েছেন ৫৭ জন।
ডিজাস্টার ফোরাম নামে একটি সংগঠনের গণমাধ্যম পর্যবেক্ষণ তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ১৯ মে পর্যন্ত বজ্রাঘাতে ৭৩ জনের মৃত্যু ও ২৮ জন আহত হয়েছেন। ২০১৮ সালে নিহত হয়েছেন ২৭৭ জন। মৃত্যু বেড়ে যাওয়ায় ২০১৬ সালের ১৭ মে বজ্রপাতকে দুর্যোগ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে।
বুয়েটের পানি ও বন্যা ব্যবস্থাপনা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক জলবায়ু বিশেষজ্ঞ ড. এ কে এম সাইফুল ইসলাম বলেন, বাংলাদেশে প্রতি মৌসুমে প্রতি বর্গকিলোমিটারে অন্তত ৪০টি বজ্রপাত হয় বলে আন্তর্জাতিক গবেষণায় উঠে এসেছে। বিশ্বে বজ্রপাতে নিহতদের এক-চতুর্থাংশই বাংলাদেশের। বিগত বছরগুলোয় অন্তত ১৫ শতাংশ বেড়েছে বজ্রপাত। প্রযুক্তির ব্যবহার করে বজ্রপাতে মৃত্যু নিয়ন্ত্রণে আনা যেতে পারে।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্তি সচিব শাহ মোহাম্মদ নাছিম (এনডিসি) বলেন, কেন এই দুর্যোগে মানুষের মৃত্যু ঘটছে তা খতিয়ে দেখা ও উপায় বের করতে রোববার একটি সভা আহ্বান করা হয়েছে। এ সভায় আলোচনার পর কীভাবে দুর্যোগ প্রশমনে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া যায়, সেটিই ভাবছে মন্ত্রণালয়।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে বজ্রপাতের সংখ্যা ও প্রাণহানির দিক দিয়ে সর্বোচ্চ ঝুঁকিতে আছে বাংলাদেশ। এ জন্য কাজের বিনিময়ে খাদ্য ও কাজের বিনিময়ে টাকা কর্মসূচির নীতিমালা পরিবর্তন করে সারা দেশে ১০ লাখ তাল গাছ রোপণের উদ্যোগ নিয়েছিল দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়।
এনডিআরসি শাখার এক কর্মকর্তা বলেন, বজ্রপাতে প্রাণহানি ঠেকাতে সারা দেশে তালগাছ লাগানো প্রকল্প চলমান রয়েছে। এর পাশাপাশি বজ্রপাতের পূর্বাভাস জানাতে ৭২৩টি এলাকায় সেন্সর বসানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। যাতে বজ্রপাতের ৪০ মিনিট আগে—ওই যন্ত্রের সহায়তায় মানুষ জানতে পারবে। ওই কর্মকর্তা আরো বলেন, বজ্রপাতের হাত থেকে বাঁচার কৌশল সম্পর্কে গণসচেনতা সৃষ্টির মাধ্যমে মৃত্যুর হার কমানো যেতে পারে। হাওর এলাকায় তালগাছের পাশাপাশি টাওয়ার নির্মাণের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে বলেও জানান তিনি।
আর আবহাওয়া অধিদফতরের প্রকল্প পরিচালক মজিদুল ইসলাম বলেন, বজ্রপাতের সতর্কতামূলক তথ্য পাওয়ার পর তা তাৎক্ষণিকভাবে আবহাওয়া অধিদফতরের ওয়েবসাইটের রিয়েল টাইমে প্রচার করা হবে। মোবাইলে ওয়েদার অ্যাপের মাধ্যমে যে কেউ সেই তথ্য পাবেন। তবে এই সতর্কবার্তার ব্যাপারে খুদে বার্তা পাঠানোর কোনো পরিকল্পনা নেই। ডিটেকটিভ সেন্সরটির কোথাও ক্রটি বিচ্যুতি রয়েছে কিনা তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
বজ্রপাতের মৃতের সংখ্যা কমিয়ে আনতে আরও কার্যকরী পদক্ষেপ নেওয়া যায় বলে জানালেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্যোগ বিজ্ঞান ও ব্যবস্থাপনা বিভাগের অধ্যাপক ড. এ এস এম মাকসুদ কামাল। তিনি বলেন, বিশ্বে বজ্রপাতে সবচেয়ে বেশি মৃত্যু বাংলাদেশে। ‘আর্লি ওয়ার্নিং সিস্টেম’ (প্রাক-সতর্কীকরণ ব্যবস্থা) ও লাইটেনিং অ্যারেস্টর (বজ্রপাত নিরোধক) স্থাপনের মাধ্যমে মানুষকে রক্ষার পদক্ষেপ নেওয়া যায়।
বজ্রপাতের কারণ: বজ্রপাতে মৃত্যুর একক কোনো কারণ চিহ্নিত করতে পারছেন না বিশেষজ্ঞরা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বুয়েট, আবহাওয়া অধিদফতর (বিএমডি) সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, তাপমাত্রা ও বাতাসে সিসার পরিমাণ বৃদ্ধি, জনজীবনে ধাতব পদার্থের ব্যবহারের আধিক্য, মোবাইল ফোন ব্যবহার ও এর টাওয়ারের সংখ্যা বৃদ্ধি, বনভূমি বা গ্রামাঞ্চলে উঁচু গাছের সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে হ্রাস, জলাভূমি ভরাট ও নদী শুকিয়ে যাওয়া ইত্যাদি বজ্রপাত বৃদ্ধির কারণ। আর এসব কয়েকটির সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তন ও উষ্ণায়নের সম্পর্ক আছে। বুয়েটের অধ্যাপক সাইফুল ইসলাম বলেন, বিশ্বখ্যাত সায়েন্স পত্রিকার নিবন্ধে ১ ডিগ্রি তাপমাত্রা বেড়ে গেলে বজ্রপাতের আশঙ্কা ১২ শতাংশ বেড়ে যায় বলে উল্লেখ করা হয়েছে। বাংলাদেশে সাধারণত এপ্রিল থেকে জুন মাসে বজ্রপাত বেশি হয়ে থাকে।
আর দুর্যোগ অধিদফতরের এক কর্মকর্তা দেশীয় প্রচলিত রীতির উদাহরণ টেনে বলেন, বজ্রপাত থেকে মৃত্যু এড়াতে আশপাশে যদি কোন উঁচু গাছ থাকে সেখান থেকে দূরে থাকা। টিনের ছাদ এড়িয়ে চলা। ওপরে ছাদ আছে এমন জায়গায় চলে আসা। পাশাপাশি বজ্রপাতের সময় বিদ্যুতের খুঁটি ও টাওয়ার থেকে দূরে থাকতে প্রচলিত মত পাওয়া যায়।
আগামীনিউজ/এএইচ