Dr. Neem on Daraz
Victory Day

যতবড় বন্ধুই হোক কারো ওসিগীরি স্বাধীনচেতা বঙ্গবন্ধুর অপছন্দনীয়


আগামী নিউজ | সোহেল সানি প্রকাশিত: মার্চ ২৬, ২০২০, ০৯:০৮ পিএম
যতবড় বন্ধুই হোক কারো ওসিগীরি স্বাধীনচেতা বঙ্গবন্ধুর অপছন্দনীয়

ঢাকা: স্বাধীনতাযুদ্ধে ভারতীয় সেনাবাহিনীর অবদান অনস্বীকার্য এবং গৌরবোজ্জ্বল। কৃতজ্ঞতা প্রকাশে বাংলাদেশ কখনও কার্পণ্য করে না। কিন্তু সেই সুবাদে নানা অবিমৃষ্যকারীতা নীরবে সহ্য করে যেতে হবে এটাও একটি আত্মমর্যাদাশীল জাতির কাম্য হয় কি করে? গুজব ছিল দেশ থেকে সোনা, রূপা, তামা, পীতলসহ তৈজসপত্র, গাড়ি ও বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম বিপুলাকারে সীমান্তের ওপারে চলে যাচ্ছে। বঙ্গবন্ধু এসব অভিযোগ শুনছিলেন। উভয় সংকটে পড়লেন তিনি।

ভারতীয় বাহিনীকে স্বদেশে ফেরানো কোন সহজ ব্যাপার ছিল না। বাস্তবতার সঙ্গে চক্ষুলজ্জা বলেও তো কথা। সরকারের ও দলের নেতারা বিচলিত, কীভাবে সেনাবাহিনী ফেরাবেন তা বোধগম্য হচ্ছিল না কারোরই।

অথচ, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু সরাসরি ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে তাগিদ দিয়ে বসলেন, 'ভারতীয় সেনাবাহিনীকে ফেরত নিতে হবে।' ইন্দিরা গান্ধী বললেন, 'আপনার আগামী জন্মদিনের আগেই ফিরিয়ে নেয়া হবে। ঠিকই সম্মানের সঙ্গে তারা তাদের মাটিতে চলে গেলো। দেশের মানুষ স্বস্তি পেলো।

'ইন্দিরা গান্ধী তাঁর এক ঝানু আমলা শ্রী ডিপি ধরকে বাংলাদেশে প্রেরণ করেছিলেন, সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের প্রশাসন কাঠামো গঠনে সহায়তা করার জন্য। বিষয়টি স্পর্শকাতর ঠেকলো বঙ্গবন্ধুর কাছে। এখানকার প্রশাসনও ডি পি ধরের খবরদারি মানতে চাচ্ছিল না। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে রাষ্ট্রদূত ডি পি ধর আনুষ্ঠানিক সাক্ষাৎ করতে গেলেন এক রাতে সমভিব্যাহারে।

সৌজন্যমূলক কুশলাদি বিনিময়ের পরে বঙ্গবন্ধু হঠাৎ করেই বলে বসলেন, মি. ধর, কবে দিল্লী ফিরে যাচ্ছেন? এসেছেন মাত্র, কয়েকটা দিন আমাদের এখানে কাটান। বাংলাদেশ মাছের দেশ। এখানকার পদ্মার ইলিশ খুবই উপাদেয় ও মজাদার। কয়েকদিন থেকে মাছ-টাছ খান, তারপর যাবেন। ডি পি ধর হতবাক, প্রথম দিবসেই তাঁকে ফিরে যাওয়ার তাগিদ দেয়া হলো, কেন? সরকার প্রশাসন কাঠামো গঠনের কোন ইঙ্গিতও নেই। তাহলে?  রাষ্ট্রদূত ডি পি ধর ওদিনই বার্তা পাঠালেন দিল্লিতে। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী যা বুঝার বুঝলেন। তিনি দ্রুত ঢাকা ত্যাগের নির্দেশ দিলেন মি. ধরকে।

এ সম্পর্কে বাংলাদেশ  প্রধানমন্ত্রীর সচিব রফিকউল্লাহ চৌধুরীর বরাত দিয়ে তৎকালীন আওয়ামী লীগ নেতা শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন তাঁর একটি গ্রন্থে এ ঘটনার বর্ণনা করে লিখেছেন, বঙ্গবন্ধু ব্যতীত অন্য কারো পক্ষে এভাবে সরাসরি ডি পি ধরকে অপ্রস্তুত করে ফেলে দিল্লিতে ফেরানোর পথনির্দেশ দিতে পারতেন না। শাহ মোয়াজ্জেম লিখেছেন, 'স্বাধীনতার তেজ ছিল বঙ্গবন্ধুর মজ্জাগত। তিনি মনে করেছেন, হ্যাঁ, প্রয়োজনে ওদের সাহায্য নিয়েছি, সে জন্য কৃতজ্ঞচিত্তে সর্বদা স্বীকার করব।

কিন্তু তাই বলে, আমরা কারো মাখা তামাক খাই না।'শাহ মোয়াজ্জেম লিখেছেন, কেউ অহেতুক অভিভাবক হয়ে দাঁড়াবে এটা বঙ্গবন্ধুর কাছে বাঞ্ছনীয় ছিল না। মিঃ ধরের প্রস্তাবগুলোও তাঁর মনপুত হয়নি। দেশ শাসনে বঙ্গবন্ধুর মস্তিষ্কের চাইতে হৃদয়ের প্রভাবই কাজ করেছে অধিকতর। কিন্তু একটি বিষয়ে মতান্তর ছিল না যে বঙ্গবন্ধু একজন সত্যিকারের স্বাধীনচেতা মানুষ ছিলেন এবং যতবড় বন্ধুই হোক ভিনদেশের অছিগিরি তাঁর অত্যন্ত অপছন্দনীয় ছিল।

১৯৭৪ সালে পাকিস্তানের রাজধানী ইসলামাবাদ মুসলিম দেশসমূহের ইসলামিক সম্মেলন এলো। গণভবনে বৈঠক বসলো। বঙ্গবন্ধুর যোগদান প্রশ্নে সরকারের একটি অংশ 'না' যাওয়ার পক্ষে মত দিল। 'না' এর পক্ষে ছিলেন,অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ, পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুস সামাদ আজাদ এবং আইনমন্ত্রী ডঃ কামাল হোসেন প্রমুখ। তারা বলছিলেন, ধর্মনিরপেক্ষ দেশ হিসাবে ইসলামি সম্মেলনে যোগদান ঠিক হবে না। যাওয়ার পক্ষে যারা অবস্থান নিলেন, তাঁদের যুক্তি ছিল যে, দেশের শতকরা ৯০ জন মুসলিম এবং পৃথিবীতে দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম রাষ্ট্র।।

ইসলামিক সম্মেলনে না যাওয়া হবে দেশের মানুষের  ধর্মানুভূতির প্রতি উপেক্ষা প্রদর্শনেরই নামান্তর। কেউ কেউ বললেন, এজন্য অনেক খেসারতেরও আশঙ্কা করলেন। বঙ্গবন্ধু যখন যাওয়ার পক্ষে মত দিতে চলছিলেম, তখন না যাওয়ার পক্ষে যাঁরা ছিলেন, তাঁরা প্রস্তাব দিলেন, ঠিক আছে যেতে চান, যান, কিন্তু যাত্রাপথে দিল্লিতে নেমে ওদের সঙ্গে একটু কথা বলে গেলে সবদিক রক্ষা হয়।

তৎকালীন জাতীয় সংসদের চিফ হুইপ শাহ মোয়াজ্জেম হোসেনের মতে, বঙ্গবন্ধু টেবিল চাপড়িয়ে রীতিমতো ক্রুদ্ধ কণ্ঠে চিৎকার করে উঠলেন, বললেন, 'আমি কারো মাখা তামাক খাই যে, আমাকে মাঝপথে নেমে কারো মত নিতে হবে? তোমরা ভেবেছো কী? আমাদের সার্বভৌম দেশ। কী করব, না করব আমরা সাব্যস্ত করব। কাউকে ট্যাক্স দিয়ে চলার জন্য দেশ স্বাধীন হয়নি। পিন্ডির গুহা থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে আমরা দিল্লির গর্তে ঢুকব - আমার জীবদ্দশায় তা হবে না। তোমরা যে যা মনে কর, কর, আমি ইসলামাবাদ যাব, সরাসরি যাব।'শাহ মোয়াজ্জেম গ্রন্থে লিখেছেন, এ না হলে নেতা!  কেউ আর উচ্চবাচ্য করতে সাহসী হল না।

বঙ্গবন্ধুর অনেক ত্রুটি বিচ্যুতির মধ্যেও তাঁর তীব্র স্বকীয়তার জন্য এবং এ পরনির্ভরহীনতা সবাইকে আকৃষ্ট করতো। দোষে গুণেই মানুষ। কিন্তু এমন এক একটি গুণ থাকে যার জন্য শত দোষও খণ্ডিত হতে পারে।শাহ মোয়াজ্জেম লিখেছেন, বঙ্গবন্ধুর সান্নিধ্য ভালো লাগতো। তাঁর ছিল অমোঘ আকর্ষণীয় শক্তি - যা বারবার কাছে টানতো। আমরা ছিলাম অনেকটা মন্ত্রমুগ্ধ। Personal charisma যাকে বলে, তা ছিল তুলনাহীন।

আমরা ছিলাম অন্ধভক্ত - মুজিবঅন্তপ্রাণ। মানুষকে খুব সহজে আপন করে নিতে পারতেন। সবসময় ভাবতাম তাঁর স্নেহ আছে, আর আমাকে পায় কে? রাজনীতিতে যোগ্যতা কাজ করে তা নয়, দরকার Friend, philosopher and guide, আমি তা পেয়েছি - বললেন শাহ মোয়াজ্জেম। ছাত্রলীগের সভাপতি আবদুল মমিন তালুকদারের মাধ্যমে পরিচয়ের কথা জানিয়ে শাহ মোয়াজ্জেম লিখেন, ছাত্রাবস্থায় বাসায় গেলে মুজিব ভাই ভাবীকে বলতেন, ওকে দু'পয়সা দামের চা দিও না। পাঁজিটা হয়ত সারাদিন ভাত না খেয়েই চরকির মত ঘুরে বেড়াবে - ওকে ভাত খাইয়ে দাও। কখনও ভাবী বলতেন, এখনও তরকারি নামেনি।

 তিনি বলতেন, একটা ডিম ভেজে ওকে খাইয়ে দাও - ও সারাদিনে আর খাবে! শাহ মোয়াজ্জেম লিখেছেন, ১৯৬২ সালের দিকেই শেখ মুজিবুর রহমান নিজহাতে মুসাবিদা করে নিজে প্যাডেল চালিয়ে পূর্ব বাংলার স্বাধীনতার সপক্ষে লিফলেট ছেপে আনতেন, তা গভীর রাতে সাইকেলে চড়ে আমি, শেখ ফজলুল হক মনি, সিরাজুল আলম খান ও আবদুর রাজ্জাক সেগুলো বিলি করতাম।

অনেক নেতার ভিড়ে একটি সাহসী কণ্ঠস্বর, তাঁর (বঙ্গবন্ধু) আপসহীন মনোভাব আর দেশপ্রেম ও মানুষের জন্য অকৃত্রিম ভালোবাসা নিয়ে ত্যাগ তিতিক্ষার পথে যখন যাত্রা শুরু করলেন, তখন বিধাতাও তাঁর হাত উজাড় করে তাঁকে বরমাল্য দিলেন। শেখ সাহেব আওয়ামী লীগের নেতা, একটি দলের নেতা, সেখানে অচিরেই জাতীয় নেতায় রূপান্তরিত হলেন। ৬ দফার বিরুদ্ধে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দিলো। শেখ মুজিব বঙ্গবন্ধু হয়ে গেলেন। হলেন জাতির পিতা। তারপর তাঁর স্বপ্নের বাংলাদেশ।

লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট

আগামী নিউজ/ডলি/ নাঈম

আগামী নিউজ এর সংবাদ সবার আগে পেতে Follow Or Like করুন আগামী নিউজ এর ফেইসবুক পেজ এ , আগামী নিউজ এর টুইটার এবং সাবস্ক্রাইব করুন আগামী নিউজ ইউটিউব চ্যানেলে