নেত্রকোণাঃ জেলার খালিয়াজুরীসহ হাওরাঞ্চলে আফালের (ঢেউয়ের) তাণ্ডবে বেশিরভাগ গ্রামে ভাঙন দেখা দিয়েছে। এসব এলাকার লোকজন পরিবার-পরিজন নিয়ে এক ধরনের আতঙ্ক মধ্যে সময় কাটাচ্ছেন। হাওরে ঝড়ো বাতাসে বড় বড় যে ঢেউয়ের সৃষ্টি হয় স্থানীয় লোকজন তাকে ‘আফাল’ বলে। বাতাস যত বাড়ে আফালের তাণ্ডব তত ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করে। তিন থেকে চার ফুট উঁচু উঁচু ঢেউ আছড়ে পড়ে হাওর পাড়ের গ্রামগুলোতে। ভাঙ্গনের কবলে পড়ে সর্বশান্ত হয়েছেন হতদরিদ্র শতাধিক পরিবার। এমতাবস্থায় জরুরী ভিত্তিতে স্থায়ী ব্যবস্থা না হলে নদী গর্ভে বিলীন হবে শত বছরের পুরনো গ্রাম। যদিও ভাঙ্গনরোধে প্রতি বছরের ন্যায় এবারও বালু ভর্তি বস্তা ফেলার উদ্যোগ নিয়েছে স্থানীয় পানি উন্নয়ন বোর্ড।
স্থানীয় সূত্র জানায়, এরইমধ্যে বিলীন হয়ে যাওয়া গ্রামগুলো হচ্ছে- জগদীশপুর, মাগনপুর, বিক্রমপুর, কানাইনগর, সুলতানপুর, আমীনপুর, খুরশীগঞ্জ, কালিপুর, হ্যামনগর, আছানপুর, নূরপুর, কাছারীবাড়ী, হাবিবপুর, দূর্গাবাড়ী, নগর, শিবপুর, কামারবাড়ী, নরসিংহপুর, নয়ানগর ও সঁওতাল গ্রাম। ভূমি মানচিত্রে ও ভূমি রেকর্ডে এ গ্রামগুলো উল্লেখ থাকলেও এগুলো আর নেই।
হাওরের বুক ছিড়ে দিনরাত বড় বড় কার্গো, লঞ্চ ও ট্রলার চলাচল করায় এ থেকে সৃষ্ট ঢেউ ও ধনু নদীর তীব্র স্রোতে হারিয়ে যাচ্ছে গ্রামের পর গ্রাম। এ ছাড়া এই ঢেউয়ের থাবা থেকে রক্ষা পাচ্ছে না হাট-বাজারগুলো। খালিয়াজুরী উপজেলা সদরের বেশ কয়েকটি সরকারি ভবন ঢেউয়ের তাণ্ডবে যেকোনো সময় হাওরের পানিতে বিলীন হয়ে যেতে পারে।স্থানীয়দের আশংকা, আফাল মোকাবিলায় কার্যকর পদক্ষেপ না নেওয়ায় জগন্নাথপুর, রসুলপুর, লক্ষ্মীপুর, মুজিব নগর, বল্লভপুর ও পাঁচহাট চরপাড়াসহ বিভিন্ন গ্রাম নিশ্চিহ্ন হওয়ার আশঙ্কা করছে এলাকাবাসী।
গাজীপুর ইউনিয়নের একাধিক গ্রামের বাসিন্দা বলেন, ‘হাওরে ঢেউ শুরু হলে রাতে সন্তানদের নিয়ে ঠিকমতো ঘুমাতে পারি না। আতঙ্কে থাকি কখন কী হয়। হাওরাঞ্চলে পানি সহিষ্ণু হিজল, করচ ও চাইল্যা বন আশঙ্কাজনকহারে কমে গেছে। এ কারণে প্রতি বছরই আফালের তাণ্ডবে বাড়িঘর ভেঙে যাচ্ছে।’
খালিয়াজুরীর ধনু নদীর তীরে বসবাসকারী বেশ কয়েকজন আবেগের সহিত বলেন- ‘ধনু নদীর ভাঙ্গনে ঘরবাড়ি হারিয়ে বর্তমানে গ্রামের পাথরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দোতলায় বসবাস করছেন। সবকিছু হারিয়ে তারা এখন দিশেহারা। সন্তান-সন্তোতি নিয়ে সংসার চালানোই এখন দায় হয়ে পড়েছে। সরকারি সহযোগিতার দাবী তাদের।’
স্থানীয় ইউপি সদস্য সুবিন্দু কান্তি সরকার বলেন, ‘দীর্ঘদিন যাবত ধনু নদীর ভাঙ্গনে আমাদের গ্রামটি এখন বিলীনের পথে। ইতিমধ্যে সবকিছু হারিয়ে পথে বসেছে গ্রামের অনেকেই। গ্রামটি রক্ষা করা না হলে এখানকার হাওরের একমাত্র ফসলী জমি রক্ষা করাও কঠিন হয়ে যাবে। দ্রুত স্থায়ী বাঁধ নির্মাণ না করা হলে সর্বশান্ত হয়ে যাবে এলাকার মানুষ। এছাড়াও নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে গ্রামের সব টিউবওয়েল ও স্যানিটারি ল্যাট্রিন। ফলে দেখা দিয়েছে তীব্র পানির সংকট। এতে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে শিশু ও বৃদ্ধরা। দ্রুত ব্যবস্থা নেয়ার দাবী ভোক্তভুগীদের।’
খালিয়াজুরী উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান সামছুজ্জামান তালুকদার সোয়েব সিদ্দিকী মুঠোফোনে জানান, ‘হাওরবাসীর দুঃখ-দুর্দশা লাঘবে নদী খননসহ গ্রামগুলো রক্ষার জন্য প্রতিরক্ষা দেয়াল নির্মাণ করতে হবে। হাওরের মাছ ও ধান থেকে সরকার বিপুল পরিমাণ রাজস্ব পায়। সরকারের উচিত প্রতিটি গ্রামে প্রতিরক্ষা দেয়াল নির্মাণ করা। কারণ হাওরে উঁচু জায়গা নাই এ কারণে হাওরে গ্রামগুলোতে খুব অল্প জায়গায় অনেক লোক বসবাস করে।’
নেত্রকোণা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মোহনলাল সৈকত বলেন, ইতিমধ্যে নদীতে জিও ব্যাগ দিয়ে একটি গ্রাম রক্ষায় কাজ করা হচ্ছে। এছাড়াও নতুন প্রকল্প হাতে নিয়ে স্থায়ী বাঁধ নির্মাণের আশ্বাস প্রদান করেছেন।
নেত্রকোণা জেলা প্রশাসক কাজি মো.আবদুর রহমান জানান, ‘ক্ষতিগ্রস্থ পরিবারগুলোর মাঝে খাদ্য ও আর্থিক সহায়তা করা হবে। এছাড়াও বিশুদ্ধ পানিসহ পরিবেশ রক্ষায় কাজ করার জন্য সংশ্লিষ্ট ইউএনওকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। তবে গৃহহীনদের আশ্রয়ন প্রকল্পে পুনর্বাসন করা হবে।’
আগামীনিউজ/নাসির