Dr. Neem on Daraz
Victory Day

জেনেভা ক্যাম্পে অনিশ্চিত জীবনের শেষ কবে?


আগামী নিউজ প্রকাশিত: ডিসেম্বর ১২, ২০২০, ০৬:০৫ পিএম
জেনেভা ক্যাম্পে অনিশ্চিত জীবনের শেষ কবে?

ছবি: সংগৃহীত

ঢাকাঃ মুক্তিযুদ্ধের পর ৪৯ বছর পেরিয়ে গেলেও বাংলাদেশে ‘আটকে পড়া পাকিস্তানি’ বা ‘ভারতীয় উদ্বাস্তু’ ইস্যুটির আজ পর্যন্ত কোনো সমাধান হয়নি। দেশ জুড়ে বিভিন্ন জেলায় ছড়িয়ে থাকা ক্যাম্পগুলোতে যারা বাস করছেন তারা আইন অনুযায়ী বাংলাদেশের নাগরিক হলেও এই ক্যাম্পে থাকা মানুষদের সম্পর্কে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি পালটায়নি। ‘আটকে পড়া পাকিস্তানিরা’ মূলত ‘বিহারি’ হিসাবে পরিচিত। এদের সম্পর্কে সমাজের ধারণা, তারা বাংলাদেশ সৃষ্টির বিরোধিতা করেছিল। ভারত-পাকিস্তান বিভক্তি এবং মহান মুক্তিযুদ্ধের পর ইতিহাসের ফাঁদে আটকে কয়েক প্রজন্ম ধরে জীবন দিয়ে তার মূল্য চুকিয়ে যাচ্ছেন এই উর্দুভাষী জনগোষ্ঠী।
 
সরেজমিনে ঘুরে ক্যাম্পের বিভিন্ন মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এতদিন পরে এসে উর্দুভাষী জনগোষ্ঠীর আর কেউই পাকিস্তানে ফিরতে চান না। তবে এর আগে একদিকে পাকিস্তানে ফিরে যাবার আকুতি অন্যদিকে প্রতিদিনের জীবনসংগ্রাম— এই টানাপোড়েনে পার হয়ে গেছে কয়েক দশক। ক্যাম্পের অমানবিক জীবনযাপনই তাদেরকে পাকিস্তানে সুন্দর জীবনের অলীক স্বপ্ন দেখাচ্ছিল। সেই ঘোর এতদিনে কেটে গেছে তাদের। যারা মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রাপ্তবয়স্ক ছিলেন তাদের অনেকেই মারা গেছেন। যারা বেঁচে আছেন সারা জীবনের অস্থির ও অনিশ্চয়তায় ভরা জীবনের দিকে তাকিয়ে হতাশার নিঃশ্বাস ফেলেন। পাকিস্তান সরকার বারবার নেবার আশ্বাস দিয়েও তাদের ফিরিয়ে নেয়নি। এদিকে, আর্থিক দুরবস্থার কারণে সবাই বাংলাদেশের মূল জনগোষ্ঠীর সঙ্গে মিশতেও পারেননি। যাদের আর্থিক অবস্থা ভালো তাদের মূল জনস্রোতে মিশতে কষ্ট হয়নি।

উর্দুভাষী জনগোষ্ঠীর বিশিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, তাদের লোকজন বাংলাদেশের নাগরিক হবার আইনি স্বীকৃতি পেয়েছে। এখন তাদের সামনে চ্যালেঞ্জ মূলস্রোতে মিশে যাবার। তবে অবশ্যই সরকারকে এ বিষয়ে সহযোগিতা করতে হবে। সরকারের দারিদ্র্য বিমোচন কর্মসূচির আওতায় এদের নিয়ে এসে আর্থিক দুরবস্থা কাটানোর সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে।

আওয়ামী লীগ সরকার ২০০৮ সালে ক্ষমতায় আসার পর ঢাকার ক্যাম্পগুলোতে থাকা জনগোষ্ঠীকে ঢাকার অদূরে বিভিন্ন স্থানে পুনর্বাসনের উদ্যোগ নিয়েছিল। বিভিন্ন স্থানে প্রাথমিকভাবে জায়গা দেখা হয়েছিল। কিন্তু সেই উদ্যোগ আর এগোয়নি। এদিকে কালের নিয়মে ঢাকার ক্যাম্পগুলোর জমির দাম বেড়েছে। ফলে ভূমিদস্যুদের নজর এখন এসব জায়গার ওপরে। নানা স্থানে জমি দখল করতে পেশিশক্তি ব্যবহার করতেও দেখা যাচ্ছে।মুক্তিযুদ্ধের পর স্বাধীন বাংলাদেশে প্রায় দুটি প্রজন্ম পেরিয়ে গেছে কিন্তু বাংলাদেশের নাগরিক হিসাবে পূর্ণ মর্যাদা, সম্মান ও সহযোগিতা পাচ্ছেন না তারা। দেশের কয়েকটি জেলায় অবস্থিত ক্যাম্পগুলোতে মানবেতর জীবন কাটাচ্ছেন। আইনগত দিক থেকে আটকে পড়া পাকিস্তানিরা বাংলাদেশের নাগরিক হওয়ার পূর্ণ স্বীকৃতি পেলেও মূলত রাজনৈতিক সিদ্ধান্তহীনতার কারণেই এই সমস্যার সমাধান হচ্ছে না। সামাজিকভাবে বাংলাদেশের উন্নতির মূলস্রোত থেকে বিচ্ছিন্ন অবস্থানে বসবাস করতে বাধ্য হচ্ছেন। প্রায় ৩ লাখ উর্দুভাষী মানুষ দেশ জুড়ে বিভিন্ন ক্যাম্পে অশিক্ষা, আর্থিক সংকটে জর্জরিত হয়ে বাংলাদেশ রাষ্ট্র ও মানুষের প্রতি এক অদ্ভুত দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে প্রজন্মের পর প্রজন্ম কাটিয়ে চলেছে।

এখন বাংলাদেশে ১১৬টি ক্যাম্পে প্রায় ৩ লাখ উর্দুভাষী অবস্থান করছেন। মুক্তিযুদ্ধের পরপরই পাকিস্তান বাংলাদেশ থেকে মোট ১ লাখ ২৬ হাজার ৯৪৩ জন পাকিস্তানি নাগরিককে ফিরিয়ে নিয়ে যায়। এরপর ১৯৮৩ থেকে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত পরবর্তী ১০ বছরে বাংলাদেশ থেকে পাকিস্তান মাত্র ৬৩টি পরিবারকে গ্রহণ করে।

আইনি স্বীকৃতি লাভ, নতুন চ্যালেঞ্জ

আইন অনুযায়ী বাংলাদেশে এখন কোনো আটকে পড়া পাকিস্তানি নেই। আইনগতভাবে আটকে পড়া পাকিস্তানিরা বাংলাদেশের নাগরিকত্ব পেয়েছে। তাদের জাতীয় পরিচয়পত্র দেওয়া হয়েছে। এখন আর এটা কোনো ইস্যু নয়, বলছিলেন ক্যাম্পের মানুষদের ভোটাধিকারের পক্ষে মামলা পরিচালনাকারী আইনজীবী এম আই ফারুকী।

মোহাম্মদপুরের জেনেভা ক্যাম্পে বসবাসকারী ১০ ব্যক্তি ভোটার হওয়ার অধিকার চেয়ে আদালতে মামলা করেন। উচ্চ আদালত ২০০৩ সালের ৫ মে তাদের ভোটার হওয়ার অধিকার প্রদান করে। এরপর ২০০৮ সালে জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরির সময়ও ভোটার করার দাবিতে আরেকটি মামলায় উচ্চ আদালত ক্যাম্পে অবস্থানরত সব নাগরিককে ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার আদেশ প্রদান করেন। বাদী পক্ষে এ মামলা পরিচালনাকারী অ্যাডভোকেট এম আই ফারুকী বলেন, এই জনগোষ্ঠীর সামনে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে তাদের মূল জনস্রোতে মিশে যাবার চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করা। তাদের ভাবতে হবে বাংলাদেশ তাদেরই দেশ।

এ প্রসঙ্গে প্রাবন্ধিক, গবেষক মফিদুল হক বলেন, বাংলাদেশের উর্দুভাষী মানুষ ইতিহাসের ফাঁদে আটকে গেছেন। দেশ জুড়ে বিভিন্ন ক্যাম্পে অমানবিক জীবনযাপন করা এই মানুষদের স্বাভাবিক জীবনযাপনে নিয়ে আসার দায় আমাদের—রাষ্ট্রের, সমাজের ও দেশের মানুষের। উর্দুভাষী মানুষদের অনেকেই বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ভাষা আন্দোলন করেছেন, পাকিস্তান আমলে প্রগতিশীল বামপন্থি আন্দোলনের সঙ্গেও তাদের অনেকেই যুক্ত ছিলেন।

তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধে যারা বিরোধিতা করেছেন ও হত্যার সঙ্গে জড়িত ছিলেন তাদের খুঁজে বের করে শাস্তি দিতে হবে এটা যেমন ঠিক, তেমনি যুদ্ধাপরাধের সঙ্গে যুক্ত নন এমন সাধারণ উর্দুভাষীদের সঙ্গে শত্রুভাবাপন্ন হওয়াটাও ঠিক হবে না। আমরা মানবিক হব। আর উর্দুভাষী তরুণ প্রজন্মের সঙ্গে বাঙালি তরুণ প্রজন্মের সেতুবন্ধ রচনায় কার্যকরী উদ্যোগ নিতে হবে।

‘না হলাম পাকিস্তানের, না হতে পারলাম বাংলাদেশের’

‘ভারতের বিহার ও উত্তর প্রদেশ থেকে উদ্বাস্তু হয়ে এখানে এসে আমরা না হলাম বাংলাদেশের না হতে পারলাম পাকিস্তানের। ৬৪ বছর ধরে আমরা উদ্বাস্তুই থেকে গেলাম। আমাদের জীবনটা বরবাদ হয়ে গেল’—বলছিলেন মিরপুরের কুর্মিটোলা ক্যাম্পের বাসিন্দা জব্বার।

ক্যাম্পের ঘরের ভেতর ঢুকলে মন খারাপ হয়ে যায়। মনে হয় যেন ঘর নয় কোনো গুদাম। আলমারির বদলে বস্তায় কাপড়-চোপড় ভরে রাখা। ভাবতে কষ্ট হয় এভাবেও মানুষ থাকে! আট ফুট বাই আট ফুটের ঘরে তিন প্রজন্ম এক সঙ্গে বাস করছে। ঢাকার মোহাম্মদপুরের ছয়টি ক্যাম্পের ঘরগুলো পাকা হলেও মিরপুরের ২৪টি বা ঢাকার বাইরের আরো ১২টি জেলা শহরের ক্যাম্পগুলোর পরিস্থিতি আরো নাজুক।

উর্দুভাষী জনগোষ্ঠীর পুনর্বাসন প্রসঙ্গে সাংবাদিক ও আল ফালাহ বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক আহমেদ ইলিয়াস বলেন, ‘পূর্ব পাকিস্তানে মূলত বিহারিরা এসেছিল অর্থনৈতিক কারণে। দাঙ্গায় উদ্বাস্তু হয়েও এসেছে অনেকে। এদের এক শতাংশও কিন্তু ইসলামি রাষ্ট্র পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার কারণে আসেনি। এটা রাজনীতিবিদদের ভাষা। এই রাজনীতিবিদদের কারণেই আজকের বাংলাদেশে উর্দুভাষী জনগোষ্ঠী ও বাঙালিদের মধ্যে দূরত্বের সৃষ্টি হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘এ জনগোষ্ঠীর কেউই মৌলবাদী সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত নয়। এরা মূলত ধর্মভীরু এবং খুব অভাবী। এই অভাবকে জয় করতে এবং ভারত পাকিস্তান বিভক্তির পর এরা জন্মস্থান ছেড়ে এদেশে এসেছিল ভাগ্যান্বেষণে। একবার দেশ ছাড়ার পর পুনরায় মুক্তিযুদ্ধের পর এ জনগোষ্ঠী বাংলাদেশেও উদ্বাস্তু হয়ে পড়ে।’

অভাবের সঙ্গে লড়াই করতে থাকা ক্যাম্পে থাকা উর্দুভাষী মানুষদের মধ্যে কোনো নেতৃত্ব গড়ে ওঠেনি। ফলে তাদের দাবি ও সমস্যা নিয়ে বলার মতো কেউ নেই। সে কারণেই বাংলাদেশের নাগরিক হবার আইনগত বৈধতা পাবার পরেও তাদের অবস্থার কোনো উন্নতি হয়নি। এছাড়া বিভিন্ন সংগঠন এখানে কাজ করলেও সেসব সংগঠনগুলোর মধ্যে সমন্বয় নেই। এমন অনেক ভুঁইফোড় সংগঠন রয়েছে যারা বিভিন্ন দেশে উর্দুভাষী জনগোষ্ঠীর উন্নয়নের নামে নানা দেশ থেকে চাঁদা, ঈদুল আজহায় কোরবানির নামে টাকা সংগ্রহ করে চলেছে। স্ট্র্যান্ডেড পাকিস্তানি জেনারেল রিপার্টিশন কমিটির (এসপিজিআরসি) সাধারণ সম্পাদক শওকাত আলী বলেন, ক্যাম্পে বসবাসকারী সব জনগোষ্ঠীর মৌলিক চাহিদা পূরণ করা হোক, পুনর্বাসন করা হোক।

এ প্রসঙ্গে গবেষক, প্রাবন্ধিক মফিদুল হক বলেন, একটা ওয়েলফেয়ার ফান্ড করা যেতে পারে। যার আওতায় সারা দেশের সব ক্যাম্পে অবস্থানরত মানুষদের একমুখী উন্নয়ন কার্যক্রমের আওতায় আনা যায়। সবচেয়ে বড় প্রয়োজন শিশুদের শিক্ষা নিশ্চিত করা এবং যারা কিশোর থেকে প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে উঠছে তাদের জন্য কর্মমুখী প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা। তবে, যাই করা হোক না কেন তাদের মতামত নেওয়া হোক। কারণ, উর্দুভাষীরা আমাদের জীবনের সঙ্গে রয়েছে। তাদের খাবারশৈলী সর্বমহলে প্রশংসিত, নরসুন্দর হিসেবে সমাজে তাদের অবদান রয়েছে।

বাঙালি উর্দুভাষী দূরত্ব

মানুষের সাধারণ একটি ধারণা গড়ে উঠেছে যে, উর্দুভাষী মানেই তিনি মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী ব্যক্তি। উর্দু কবি ও সাংবাদিক আহমেদ ইলিয়াস বলেন, উর্দুভাষী সব মানুষ তো মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেনি। যেমন, সব বাঙালি মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন না। বাঙালিদের মধ্যেও রাজাকার আলবদর বাহিনীর সদস্য ছিলেন।

ভারত বিভক্তির পর যখন থেকে পূর্ব পাকিস্তানে বিহারিরা এসে বসবাস শুরু করেন তখন থেকে বাঙালি ও উর্দুভাষীদের মধ্যে যে সাংস্কৃতিক ব্যবধান, তা আর কমেনি। সেসময় পূর্ব পাকিস্তানে গ্রহণযোগ্য কোনো দৈনিক উর্দু সংবাদপত্র প্রকাশিত হতো না। ফলে তারা পাকিস্তান থেকে আসা দৈনিক সংবাদপত্র পড়তেন। সেখানে বাঙালিদের আন্দোলন ও তাদের জীবনযাত্রার প্রতিফলন ছিল না। ফলে পূর্ব পাকিস্তানে পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর প্রতি যে অসন্তোষ দানা বেঁধে উঠছিল তার আঁচ বা বাঙালিদের শোষণ যন্ত্রণার কথা উর্দুভাষী জনগোষ্ঠী বোঝেনি। মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর প্ররোচনা ও বিভেদ নীতি বাঙালি অবাঙালিদের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়। উর্দুভাষী উদ্বাস্তু জনগোষ্ঠীকে তারা রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করে বাঙালিদের বিরুদ্ধে। সূত্র: ইত্তেফাক।

আগামীনিউজ/প্রভাত

আগামী নিউজ এর সংবাদ সবার আগে পেতে Follow Or Like করুন আগামী নিউজ এর ফেইসবুক পেজ এ , আগামী নিউজ এর টুইটার এবং সাবস্ক্রাইব করুন আগামী নিউজ ইউটিউব চ্যানেলে