ঢাকাঃ বলা হয়, "তুমি যেখানে আছো সেখানে থাকতে চাইলেও দ্রুত দৌড়াও"( if you want to stay where you are, run faster)। ধরুন, আপনি দৌড়ের ট্রাকে দ্বিতীয় অবস্থানে আছেন, প্রথম হতে চাইলে তো আরো জোরে দৌড়াতে হবেই, এমনকি প্রথম যদি নাও হন, দ্বিতীয় স্থানে থাকার জন্য হলেও জোরে দৌড়াতে হবে। কারণ আপনার স্বল্প পিছনে যারা আছে তাদের মধ্যে দুইজন জোরে দৌড়ে যদি আপনার সামনে চলে যায়, আপনার অবস্থান তখন চতুর্থ হয়ে যাবে। তৃতীয় স্থানটিও আপনার কপালে জুটবে না।
একটা ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান টানা ১০ বছর যাবত প্রতিবছর ১০ কোটি টাকা করে ব্যবসা করছে। এই প্রতিষ্ঠানের অবস্থা কেমন? নিশ্চিত করেই বলা যায়, খুবই খারাপ। ব্যবসায় প্রবৃদ্ধি থাকতেই হবে এবং সেটা হতে হবে লাভজনক প্রবৃদ্ধি। ব্যবসা সম্প্রসারণের জন্য যে কনসেপ্টগুলোকে আজকাল সবচেয়ে বেশি জোর দেয়া হচ্ছে তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে "কাস্টমার শেয়ার"(customer share)।
মার্কেট শেয়ার শব্দগুচ্ছ সর্বসাধারণের মধ্যে ব্যাপক পরিচিত হলেও কাস্টমার শেয়ার সম্পর্কে অনেকের ধারণা স্পষ্ট নয়। দৈবচয়িত ভাবে (randomly) বাজারে একশোটা মোবাইল সিম পরীক্ষা করে দেখা গেল ৬০টা গ্রামীনফোনের সিম । তাহলে অনেকটা নিশ্চিত করেই বলা যায় মোবাইল ফোন সার্ভিসের ৬০% বাজার অংশ গ্রামীণফোনের দখলে ।
অন্যদিকে কাস্টমার শেয়ার হচ্ছে একজন কাস্টমার যত টাকা খরচ করে তার কত শতাংশ আমার কোম্পানির পণ্যের পিছনে খরচ করে অর্থাৎ প্রত্যেক ব্যক্তির মোট ব্যয়ের কত শতাংশ আমার কোম্পানিতে আসে। সেটা যত কমই হোক। কোম্পানিগুলো ক্রমাগত চেষ্টা করছে তাদের কাস্টমার শেয়ার বাড়ানোর জন্য । গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজগুলো একটার পর একটা সিস্টার কনসার্ন তৈরি করে চলছে (অন্যান্য প্রাণহীন অবজেক্টের ন্যায় কোম্পানিকে সব সময় স্ত্রীলিঙ্গ ধরে একই মালিকানায় থাকা কোম্পানিগুলোকে সিস্টার কোম্পানি বা সিস্টার কনসার্ন বলা হয়। এই শব্দটি নৌ বাহিনী থেকে ধার নেয়া। একই নৌবহরে থাকা জাহাজগুলোকে বলা হয় sister ship)।
যাতে প্রত্যেক ক্রেতার মোট খরচের একটা বড় অংশ তার গ্রুপের হাতে চলে আসে। এটা করা হয় ক্রেতাদের আনুগত্য(customer loyalty) বাড়ানোর জন্য। ক্রেতাকে কেবল সন্তুষ্ট রাখলে হবে না, তাকে প্রতিযোগীর হাত থেকে রক্ষাও করতে হবে। সেজন্য যতটা সম্ভব তার প্রয়োজনীয় সব পণ্যের যোগান দিতে পারলে ক্রেতার সাথে প্রতিযোগী কোম্পানীর যোগাযোগের সম্ভাবনা কমে যাবে।
এক মহিলা কলেজের অধ্যক্ষের কথা জানি, সাবেক শিক্ষার্থীরা যখন বিয়ের দাওয়াত দিতে আসত তখন তিনি শিক্ষার্থীদের বলে দিতেন, " স্বামীকে কেবল ভালোবাসবে এটাই যথেষ্ট নয়, প্রত্যেক স্ত্রীই তার স্বামীকে ভালোবাসে। স্বামীকে বান্ধবীদের হাত থেকে নিরাপদে রাখার দায়িত্বও তোমার । বিশেষ করে দুষ্টু বান্ধবীরা যাতে তোমার স্বামীর সাথে বিবাহের প্রথম কয়েক বছর বেশি যোগাযোগ করতে না পারে সেই ব্যবস্থাটা তোমাকেই নিশ্চিত করতে হবে"।
একসময় নিউ মার্কেটে যখন বাজার করতে যেতাম এক দোকান থেকেই প্রয়োজনীয় প্রায় সব জিনিস কিনতাম। আমার মনে আছে সেই সময় আমি "ইম্পেরিয়াল লেদার" সাবান ব্যবহার করতাম। নির্দিষ্ট দোকানে গিয়ে একটার পর একটা আইটেম বলতে থাকতাম, আর দোকানদার একটা সরু লম্বা কাগজের মধ্যে সে নামগুলো লিখতে থাকতো (চোতা)। একপর্যায়ে বলতাম , "লিখুন, ইম্পেরিয়াল লেদার সাবান দুইটা" । ওই দোকানে ইম্পেরিয়াল লেদার সাবান নাই নিশ্চিত জেনেও দোকানদার তাও লিখতো। এবং স্পষ্ট দেখতে পেতাম দোকানে কয়েকজন ক্ষুদে কর্মী থাকতো, এদের একজনকে নগদ টাকা দিয়ে অন্য এক দোকান থেকে ইম্পেরিয়াল লেদার সাবান কিনে এনে আমাকে দিত। এর কারণ ছিল, সে জানতো ইম্পেরিয়াল লেদার ছাড়া অন্য কোন সাবান আমি কিনবো না। সে যদি ইম্পেরিয়াল লেদার সাবান আমাকে না দেয় তাহলে আমি পাশের দোকান থেকে সেটা কিনতে যাব। আর সেটাই ছিল এই দোকানদারের আশঙ্কার কারণ। সে মনে করত ইম্পেরিয়াল লেদার সাবান সে দিতে না পারলে আমি সাবানের জন্য অন্য দোকানে যাব। পাশের দোকানে গেলে যদি ওই দোকানদারের সাথে আমার ভাব হয়ে যায় । অতএব যতটা সম্ভব কাস্টমারদের যাতে অন্য দোকানে যেতে না হয় আজকাল দোকানদাররা সেই চেষ্টাই করছে। অনেকটা 'বান্ধবীদের হাত থেকে স্বামীকে রক্ষা করার মত।'
কোম্পানিগুলো কাস্টমার শেয়ার বাড়ানোর জন্য দুইটা কৌশল গ্রহণ করতে পারে "ক্রস-সেলিং"(cross selling) এবং "আপ- সেলিং"(up selling)। ক্রস সেলিং এর অর্থ হচ্ছে ক্রেতাকে দেয়া পূর্ববর্তী পণ্যের কাছাকাছি অথবা সম্পূরক পণ্য অর্পণ করা। যেমন "রান্ধবী" প্রথমে গুঁড়া মসলা দিয়ে শুরু করলেও আস্তে আস্তে সন্তুষ্ট ক্রেতার নিকট রান্ধবী ক্ষীর মিক্স, সেমাই, জর্দা, আটা, চিনি, কাঁচা মরিচ, লাউ, ধনেপাতা, কৈ মাছ, অর্থাৎ রান্ধবী নাম দিয়ে রান্নাঘরের যত সফটওয়্যার লাগে সবই সরবরাহ শুরু করবে। পণ্যের পারফরমেন্স এবং কনফরমেন্স কোয়ালিটি একই রকম হলে যারা রান্ধবীর মরিচের গুড়া খেয়ে সন্তুষ্ট হয়েছে তারা রান্ধবীর অন্যান্য রান্না উপকরণগুলোও কিনবে। সকল সফটওয়্যার সরবরাহ হয়ে গেলে রান্ধবী বটি, বাটি, তাওয়া, চুলা, অর্থাৎ রান্নার হার্ডওয়্যারগুলোর সরবরাহ শুরু করতে হবে। রান্নাঘর পুরো দখল হয়ে গেলে দরজায় একটা আকর্ষণীয় সাইনবোর্ড লাগিয়ে আসতে হবে, "রান্ধবী রান্নাঘর"।
বাংলাদেশে আনুমানিক ৭০%পরিবার তাদের পারিবারিক খরচের ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ রান্নাঘরেই খরচ করে। রান্নাঘরে ক্রস সেলিং শেষ হলেই যেতে হবে শোবার ঘরে, "ঘুমানী" চাদর, বালিশ, মশারি সরবরাহের মধ্য দিয়ে আপ-সেলিং এর কাজটি শুরু করতে হবে। এরপর এক পর্যায়ে ভিন্ন নামে "আয়েসী" খাট, সোফা , ড্রেসিং টেবিল; এবং তারও পরে "বিলাসী"এয়ার কন্ডিশনার, ফ্রিজ, ওয়াশিং মেশিন, একটার পর একটা পণ্য দিয়ে পুরো বাড়ি দখল করতে হবে। প্রাণ কোম্পানির স্লোগান হচ্ছে A to Z পণ্য সরবরাহ করা। প্রাণ, এসিআই, বসুন্ধরা , মেঘনা শিল্প পরিবার এই কাজটা ইতোমধ্যেই শুরু করেছে। সব পণ্যের একটা ব্র্যান্ড নাম ব্যবহারের সুবিধা আছে, সহজেই ক্রেতা চিনতে পারে। আবার সবসময় এটা কাজ নাও করতে পারে। "বৌরানী" শাড়ি বা মসলার নাম হিসাবে যতটা জুৎসই 'বৌরানী রড', 'বৌরানী কলম' ততটা মানানসই হবে না বা শুনতেও ভালো লাগবে না। যেমন মেঘনা গ্রুপের খাদ্য সামগ্রী ও টিস্যুর নাম "ফ্রেশ" যতটা মানায় ফ্রেশ খাতা বা ফ্রেশ সিমেন্ট ততটা মানায় না। তাছাড়া একই নামে সব পণ্যের নাম রাখলে যেকোনো কারণে এর একটির ব্যাপারে কোন বদনাম বাজারে ছড়ালে অন্যগুলোর ওপর এর প্রভাব পড়ে। এর উল্টো সুবিধাও হতে পারে , একটি ব্র্যান্ডের একটি পণ্য কিনে সন্তুষ্ট হলে, সন্তুষ্ট ক্রেতা এই ব্র্যান্ডের অন্যান্য পণ্যও কিনে।
যে সকল মার্কেটিং নির্বাহী কোম্পানি পরিবর্তনের জন্য অন্য কোম্পানির বোর্ডে চাকরির ইন্টারভিউ দিতে যান তাদের প্রত্যেককেই একটি সাধারণ প্রশ্ন করা হয়। সেটি হচ্ছে, "আমাদের কোম্পানির প্রবৃদ্ধি কমে যাচ্ছে অথবা প্রবৃদ্ধি এক জায়গায় স্থির হয়ে আছে, আপনি আমাদের প্রতিষ্ঠানে যোগ দিলে, ব্যবসায় প্রবৃদ্ধির জন্য কি কি পদক্ষেপ নিবেন? ব্যবসায় প্রবৃদ্ধি বাড়ানোর কাজটি কোম্পানির কৌশলগত পরিকল্পনার অংশ। বর্তমান বিক্রি ও প্রবৃদ্ধি প্রবনতার সাথে প্রত্যাশিত বিক্রি ও প্রবৃদ্ধি প্রবণতার মধ্যে সবসময়ই একটা গ্যাপ থাকে, যেটাকে কৌশলগত পরিকল্পনা গ্যাপ বলে(strategic planning gap)। এই গ্যাপ পূরণ করার জন্য তিন ধরনের প্রবৃদ্ধি কৌশল গ্রহণ করা যেতে পারে- নিবিড় প্রবৃদ্ধি, সমন্বিত প্রবৃদ্ধি, ভিন্ন পথে প্রবৃদ্ধি।
প্রথমটি হচ্ছে নিবিড় প্রবৃদ্ধি (Intensive Growth)। কোম্পানির বর্তমান ব্যবসায় পারফরম্যান্স আরো ভালো করার সুযোগ আছে কিনা সেটা বিবেচনা করা। ধরা যাক, এক কৃষক গতবছর ১০ বিঘা জমিতে ধান চাষ করে ৫০০ মণ ধান উৎপাদন করেছে, এ বছর যদি সে ২০ বিঘা জমিতে ধান চাষ করে তবে স্বভাবতই ধানের উৎপাদন বেড়ে যাবে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে জমির পরিমাণ বাড়ানোর কোন সুযোগ নাই। অতএব তার ১০ বিঘা জমিতে বেশি করে ধান উৎপাদনের চেষ্টা করতে হবে। এটাকে বলা হয় নিবিড় প্রবৃদ্ধি প্রচেষ্টা। কৃষিতে আমাদের যে অসামান্য সাফল্য সেটা নিবিড় চাষ পদ্ধতির কারণে সম্ভব হয়েছে। প্রতি বছর আমাদের কৃষি জমি ১ শতাংশ হারে কমে যাচ্ছে, কিন্তু আমাদের কৃষি উৎপাদন ক্রমান্বয়ে বাড়ছে।
ধান উৎপাদনে আমরা পৃথিবীতে এখন তৃতীয় অবস্থানে, সবজি উৎপাদনে তৃতীয়, আলু উৎপাদনে সপ্তম , আম উৎপাদনে সপ্তম, পাট উৎপাদনে দ্বিতীয়, মিঠা পানির মাছ উৎপাদনে দ্বিতীয় এবং ইলিশ মাছ উৎপাদনে আমরা বিশ্বে প্রথম। এসব সম্ভব হয়েছে নিবিড় পরিচর্যার কারণে। নিবিড় প্রবৃদ্ধির প্রথম চেষ্টা করা যেতে পারে বাজারের আরো গভীরে প্রবেশের মাধ্যমে(market penetration strategy)। সেটা হচ্ছে নতুন কোনো পণ্য তৈরি না করে এবং নতুন কোন বাজারে প্রবেশের চেষ্টা না করে আগে পণ্যটি যারা কিনত তাদের নিকট পণ্যটি আরও বেশি পরিমাণে কিভাবে বিক্রি করা যায় সে চেষ্টা করা, অর্থাৎ পণ্যটির বর্তমান ব্যবহারকারীরা যাতে পণ্যটি একই কাজে আরো বেশি পরিমাণে ব্যবহার করে তার জন্য উদ্বুদ্ধ করা(more usage)। যেমন টুথপেস্ট উৎপাদনকারী নতুন কোন টুথপেস্ট উৎপাদন না করে বর্তমান ব্যবহারকারীদেরকে বাজারে বিদ্যমান কোম্পানির টুথপেস্টটি দিয়ে দিনে দুইবার দাঁত মাজার পরামর্শ দিতে পারে। অথবা বলতে পারে, "প্রত্যেকবার দাঁত মাজার সময় দুইবার টুথপেস্ট নিবেন।
প্রথমে টুথপেস্ট নিয়ে দাঁত মেজে কুলি করে ফেলবেন। তারপরে আবার টুথপেষ্ট নিয়ে দাঁত মাজলে আপনার দাঁত ও মারি আরো মজবুত হবে, দাঁত আরো ঝকঝকা হবে"। বর্তমান ক্রেতাদের এক-চতুর্থাংশও যদি এই পরামর্শ শুনে তা হলেও কোম্পানির বাজারে বিদ্যমান টুথপেস্টের বিক্রি ২৫ শতাংশ বেড়ে যাবে। ক্রেতারা যাতে তার পণ্যটি বর্তমানের চেয়ে আরো বেশী পরিমাণে ব্যবহার করে তার জন্য চেষ্টা অব্যাহত রাখছে কোম্পানিগুলো। যেমন 'ট্যাং' বানানো হয়েছিল শরবত হিসেবে খাওয়ার জন্য যা মূলত গরমের সময় মানুষ খেয়ে থাকে। শীতকালেও যাতে মানুষ খায় সেজন্য কোম্পানিগুলো গরম পানিতে গুলিয়ে ট্যাং খাওয়ার পরামর্শ দিচ্ছে, এমনকি ইফতারির সময়ও ট্যাং খেতে বলছে।
সবচেয়ে মজার কাজটি করেছিল একটি ফরাসি টায়ার কোম্পানি। ম্যাকমিলান নামের টায়ার কোম্পানিটি যখন দেখল তাদের বিক্রি স্থির হয়ে গিয়েছে তখনই পত্রিকায় একটি বিজ্ঞাপনে একটি বড় ডাইনিং টেবিলে কতগুলো অত্যন্ত লোভনীয় খাবারের(Boeuf bourguignon, Salmon en papillote, Bouillabaisse, Quiche Lorraine) ছবি দিয়ে নিচে লিখেছিল, 'এই খাবারগুলো যারা সাশ্রয়ী দামে খেতে চান তারা সুইজারল্যান্ড সীমান্তে অবস্থিত একটি রেস্টুরেন্টে গিয়ে এগুলো খেতে পারেন। টায়ার কোম্পানীটির কোন রেস্টুরেন্টের ব্যবসায় ছিল না। যে রেস্টুরেন্টের কথা বলা হয়েছিল সেটির অবস্থান ছিল ফ্রান্স এবং সুইজারল্যান্ড সীমান্তে এক পাহাড়ি এলাকায় (তবে অবশ্যই সেটা Restaurant De L'Hotel De Ville ছিল না, কারণ De Ville হচ্ছে বিশ্বের সবচেয়ে ব্যয়বহুল রেস্টুরেন্টগুলোর একটি, পৃথিবীর সবচেয়ে ব্যয়বহুল রেস্টুরেন্ট মালদ্বীপে অবস্থিত, নাম হচ্ছে- "Ithaa Undersea", রাঙ্গালি দ্বীপের সমুদ্রের তলদেশে অবস্থিত এই রেস্টুরেন্টে একবেলা খেতে মাথাপিছু কমপক্ষে ৩২০ ডলার ব্যয় করতে হয়)।
প্যারিস থেকে সেখানে যাওয়ার পথে সীমান্তবর্তী অংশে অন্তত ৫০০ কিলোমিটার ছিল কাকড় বিছানো পাহাড়ি রাস্তা। ফরাসীরা সপ্তাহান্তে ছুটির দিনে গাড়ি নিয়ে ছুটলো ওই লোভনীয় খাবারের রেস্টুরেন্টের দিকে। যাওয়া-আসায় পথে এক হাজার কিলোমিটার কাকড় বিছানো রাস্তায় চলার পরে গাড়ির টায়ার এমনভাবে ক্ষয়ে গেল যে, গাড়ির মালিকদের টায়ার বদল করা ছাড়া আর কোন উপায় থাকল না। গাড়ির টায়ার বদলের ঝামেলা এবং খরচের কথা জেনেও ভোজনবিলাসী ফরাসিরা ছুটলো ওই রেস্টুরেন্টের দিকে। এই বিজ্ঞাপনটি প্রচারের এক বছরের মধ্যেই ম্যাকমিলান কোম্পানির টায়ার বিক্রি ২৫ শতাংশ বেড়ে গিয়েছিল।
আশির দশকে আমরা যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রত্বের শেষ পর্যায়ে তখন মার্গারেট থ্যাচার ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী (১৯৭৯-১৯৯০) ছিলেন। আয়রন লেডি খ্যাত মার্গারেট থ্যাচারের চুল ছিল 'বব কাটিং' । তাঁর দেখায় দেখায় অনেক মেয়েই তাদের চুল ছোট করতে লাগলো। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজির ম্যাডাম ছিলেন সুরাইয়া খানম, যিনি মোস্তফা মনোয়ার পরিচালিত 'রক্তকরবী' নাটকের নায়িকা ছিলেন। সকল শিক্ষার্থীদের আইকন ছিলেন। কথিত আছে লেখক ও দার্শনিক আহমদ ছফা সুরাইয়া খানমকে একতরফাভাবেই অনেক পছন্দ করতেন। সুরাইয়া খানমের চুলও বব কাটিং ছিল। সুরাইয়া খানমকে অনুসরণ করে পুরো বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদের মধ্যে চুল ছোট করার হিড়িক পড়ে গেল। টেলিভিশনে মরুভূমির মেয়েদের দেখে দেখে এখন যেমনটা হিজাব পরার হিড়িক পড়েছে।
এটা বাংলাদেশের একটা উদাহরণ দিলাম। আসলে সারা পৃথিবীতেই তখন মেয়েদের চুল বব কাটিং করার একটা ফ্যাশন চলছিল। এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হলো শ্যাম্পু বিক্রেতারা। তাদের বিক্রি কমে গেল। এই বিক্রি কমার প্রবণতা রোধ করতে শ্যাম্পু বিক্রেতারা যা করলো সেটা হচ্ছে, তারা বিজ্ঞাপন দিতে শুরু করলো, "লম্বা চুলের মধ্যেই নারীর সৌন্দর্য লুকিয়ে থাকে। নারীর সৌন্দর্যের বাহন হচ্ছে লং অ্যান্ড স্ট্রং চুল"। একই সাথে সাথে বিভিন্ন দেশে লম্বা চুলের প্রতিযোগিতা আয়োজন শুরু করলো। আস্তে আস্তে চুল আবার লম্বা হতে লাগলো। শ্যাম্পু বিক্রিও বাড়লো, আর এখনো তা চলছে। যদিও ঢাকা শহরের বেশিরভাগ মেয়েদের চুল এখন হিজাবে ঢেকে গেছে, কিন্তু শ্যাম্পুওয়ালারা থেমে থাকেনি। হিজাব পরলে মাথার চাদনী গরম হওয়ার সম্ভাবনা থাকে, সেটা যাতে না হয় তার জন্য তারা এখন "হিজাব স্পেশাল" শ্যাম্পু বাজারে ছেড়েছে।
মার্কেট পেনিট্রেশন কৌশলের আরেকটা উপায় হতে পারে পণ্যের নতুন(new use) ব্যবহার উদ্ভাবন করা। পণ্যটি যে পারপাসে প্রথম বাজারে এসেছিল এর বাইরে এটাকে নতুন আর কোন পারপাসে ব্যবহার করার সুযোগ আছে কিনা সেটা দেখা। নাইলন যখন প্রথম আবিষ্কৃত হয় (১৯৩৫ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি DuPont কোম্পানি নাইলন আবিষ্কারের ঘোষণা দেয়), শুরুতে সেটা কেবলমাত্র প্যারাসুটের কাজেই ব্যবহৃত হতো, আর এখন নাইলনের ব্যবহার অসংখ্য ক্ষেত্রে হচ্ছে। আমাদের দেশে যখন প্রথম শ্যালো ইঞ্জিন আসে সেটা কেবল নদী অথবা পুকুর থেকে পানি সেচ করার কাজেই ব্যবহৃত হতো। আর এখন সেই শ্যালো ইঞ্জিন ব্যবহৃত হয় নৌকা চালাতে, জেনারেটর হিসেবে, রিকশা চালাতে,ধান ভানতে, ইট ভাঙতে, নসিমন-করিমন-ভটভটি চালাতে; অর্থাৎ অসংখ্য কাজ করা হয় এখন এই শ্যালো ইঞ্জিন দিয়ে। এক্ষেত্রে বিদ্যমান পণ্যটির সাথে কারিগরি কারণে কিছু কিছু অতিরিক্ত বৈশিষ্ট্য যোগ করা লাগতে পারে। যেমন মোবাইল ফোন প্রথমে কেবলমাত্র টেলিফোন হিসেবে ব্যবহৃত হতো কিন্তু প্রতিদিন মোবাইল ফোনে একটির পর একটি নতুন ফিচার এমন ভাবে যুক্ত হচ্ছে সম্ভবত আর অল্প কাজই বাকি থাকবে যা মোবাইল দিয়ে করা যাবে না।
মোবাইল এখন ঘড়ির কাজ করছে, কম্পিউটারের কাজ করছে, মানিব্যাগের কাজ করছে, ব্যাংকিং কাজ করছে, থার্মোমিটার এর কাজ করছে, দিকদর্শন যন্ত্রের কাজ করছে, প্রজেক্টর এবং মিউজিক্যাল ইন্সট্রুমেন্ট হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে, ইত্যাদি শত রকমের নতুন কাজে এখন মোবাইল ব্যবহৃত হচ্ছে। প্রযুক্তির অগ্রগতি এবং বাজারের চাহিদার কথা বিবেচনা করে পণ্যটির নতুন নতুন ব্যবহার আবিষ্কার করতে হবে। পণ্যের নতুন ব্যবহারের একটি ক্লাসিক উদাহরণ হচ্ছে আমেরিকার 'আরম এন্ড হ্যামার'(Arm & Hammer) কোম্পানির বেকিং পাউডার।
যখন বেকিং পাউডারের বিক্রির স্থবিরতা নেমে আসছিল তখনই কোম্পানির কাছে খবর আসলো কেউ কেউ বেকিং পাউডারকে রিফ্রেজারেটরের দুর্গন্ধনাশক হিসেবে ব্যবহার করছে। তারপরই কোম্পানিটি তাদের বেকিং পাউডারের এই দ্বিতীয় ব্যবহারের কথা উল্লেখ করে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়েছিল। ফল হয়েছিল, আমেরিকান পরিবারগুলো তখন থেকে দুইটা করে বেকিং পাউডারের কৌটা কিনতে লাগলো। একটি রুটি বানানোর কাজে ব্যবহার করবে, আরেকটি ফ্রিজে রেখে দিবে ফ্রিজের দুর্গন্ধনাশক হিসাবে। এতে করে কোম্পানিটির বেকিং পাউডারের বিক্রি ৩০ শতাংশ বেড়েছিল।
নিবিড় প্রবৃদ্ধি অর্জনের দ্বিতীয় উপায়টি হচ্ছে বাজার উন্নয়ন অর্থাৎ বিদ্যমান পণ্যের জন্য নতুন বাজার(new user) খুঁজে বের করা(Market Development Strategy)। এক্ষেত্রে অনেক দূরবর্তী এবং বিদেশে অবস্থিত ক্রেতাদের খুঁজতে হবে না। বর্তমান ক্রেতাদের আত্মীয়-স্বজন বন্ধু-বান্ধব যারা এখনো পণ্যটি ব্যবহার করেনা, তাদেরকে পণ্য ব্যবহারে শামিল করা। Johnson & Johnson Company যে কাজটি করেছিল, তা হচ্ছে তাদের কাছে যখন খবর আসলো মাঝেমধ্যে বাসায় শ্যাম্পু না থাকলে বাচ্চাদের মা-বাবারও বেবী শ্যাম্পু ব্যবহার করে এবং অনেকেই এটি ব্যবহারে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। তখনই তারা বিজ্ঞাপন দিয়ে বলল, "জনসন বেবী শ্যাম্পু পরিবারের সবাই ব্যবহার করতে পারেন"। এখন প্রায়ই দেখা যায় যাদের ঘরে বেবী নেই তাদের ঘরেও বেবি শ্যাম্পু (বেবি পাউডারও ) ব্যবহৃত হচ্ছে। এক্ষেত্রে দূরবর্তী কাস্টমারদের না খুঁজে বিদ্যমান বাজারের বাদপড়া (left out) কাস্টমারদেরকে পণ্য ব্যবহারে উদ্বুদ্ধ করতে পারলেই পণ্য বিক্রি বেড়ে যাবে।
আগামীনিউজ/জেহিন