আইনের কাজ হচ্ছে শৃঙ্খলা বিধান এবং সুবিচার নিশ্চিত করা। যা সার্বভৌম বা রাষ্ট্র কর্তৃক প্রণীত এবং প্রয়োগকৃত। তাই, আধুনিক কল্যানমুখী রাষ্ট্রে আইনের ভূমিকা অপরিসীম। কেন না যে রাষ্ট্র যত উন্নত সে রাষ্ট্রের আইন-শৃঙ্খলা (Law and order) তত উন্নত। ঠিক তেমনি যে রাষ্ট্র যত উন্নত সে রাষ্ট্রের পর্যটনও তত উন্নত। তার অর্থ দাঁড়াচ্ছে যে রাষ্ট্রের আইন-শৃঙ্খলা যত উন্নত সে রাষ্ট্রের পর্যটনও তত উন্নত।
কারণ, পর্যটনের মত এত বিশাল ও বিস্তৃত একটি শিল্পের শৃঙ্খলা বিধানে আইনের কোন বিকল্প নেই। যে জন্য একমাত্র আইনই পারে পর্যটনে শৃঙ্খলা বিধানের মাধ্যমে উন্নত ব্যবস্থাপনা ও সঠিক পরিকল্পনার পাশাপাশি সুবিচার নিশ্চিত করে পর্যটক বা ভোক্তার অধিকার রক্ষা করতে। যা কি না পর্যটন শিল্পের উন্নয়নের জন্যও একান্ত অপরিহার্য বটে। তাই, পর্যটন উন্নয়নের স্বার্থেই ‘সাধারণ আইন’ (General Laws) এর পাশাপাশি ‘সুনির্দিষ্ট পর্যটন আইন‘ (Special Tourism Laws) প্রণয়ন আজকাল অতিব গুরুত্বপূর্ণ একটি ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।
পর্যটন আইনের এই যে দু’টি ভাগ তার মধ্যে সাধারণ আইনকে আমরা প্রচলিত আইনও বলতে পারি। এগুলোর মধ্যে রয়েছে চুক্তি আইন, ফৌজদারী আইন, দেওয়ানী আইন, সাক্ষ্য আইন, সাংবিধানিক আইন, কোম্পানী আইন, পরিবেশ আইন, অভিবাসন আইন, মানি লন্ডারিং আইন ইত্যাদি। এসব সাধারণ বা প্রচলিত আইনও পর্যটনের জন্য সরাসরি কাজে লাগে এবং উপযোগীতাও আছে। বিশেষ করে চুক্তি আইনতো পর্যটন শিল্পের জন্য অনেকটা সার্বক্ষণিক ব্যাপার। কেন না পর্যটন শতভাগ সেবা নির্ভর একটি শিল্প ও ব্যবসা যার প্রায় সবকিছুই চুক্তি-ভিত্তিতে সম্পন্ন হয়ে থাকে।
তারপরও পর্যটনের মত একটি বিশাল ও বিস্তৃত শিল্পের শৃঙ্খলা এবং স্বার্থ রক্ষার প্রয়োজনে অনেক বিষয়েই একেবারে নিজস্ব তথা সুনির্দিষ্ট পর্যটন আইন একান্ত অপরিহার্য। কেন না সুনির্দিষ্ট পর্যটন আইন প্রণয়নের কিছু সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যও রয়েছে। এসব লক্ষ্যের মধ্যে থাকছে - (১) ভ্রমণার্থী এবং পর্যটন শিল্প সম্পৃক্ত লোকবলের অধিকার সংরক্ষণ করা; (২) পর্যটন সম্পদের সংরক্ষণ ও উন্নয়ন নিশ্চিত করা যাতে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম তা ব্যবহার বা উপভোগ করতে পারে; (৩) উন্নত পর্যটন সেবা প্রদান করা এবং (৪) পর্যটন শিল্পের প্রবৃদ্ধিকে অগ্রসরমান করা।
সেই বিবেচনায় পর্যটন উন্নয়ন প্রত্যাশী একটি দেশ হিসেবে বাংলাদেশেও সুনির্দিষ্ট পর্যটন আইনের অপরিহার্যতা অপরিসীম। কেন না এই পর্যটন আইনের দিক থেকে আমরা অনেকটাই পিছিয়ে বলে হয়তোবা পর্যটন উন্নয়নের প্রত্যাশা পূরণেও অনেকটা ব্যর্থ। অথচ দেশ স্বাধীনের পরপর একটি সুনির্দিষ্ট পর্যটন আইনের মাধ্যমেই আমাদের পর্যটন তার যাত্রা শুরু করেছিল। কিন্তু আজ অবধি এই এত বছর পর পর্যন্ত আমরা পর্যটনের জন্য মাত্র হাতেগুনা কয়েকটি সুনির্দিষ্ট পর্যটন আইনের জন্ম দিতে পেরেছি। এগুলোর মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন, বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ড, হোটেল এন্ড রেষ্টুরেন্ট, ট্র্যভেল এজেন্সি, বাংলাদেশ ট্যুরিজম প্রোটেক্টেড এরিয়াজ এন্ড স্পেশাল ট্যুরিজম জোন এবং সর্বশেষ ট্যুর অপারেটর এন্ড ট্যুর গাইড আইন।
তারপরও এই আইনগুলো প্রায়োগিক ও কার্যকরিতার দিক থেকে অনেকটা নাজুক অবস্থার মধ্যে রয়েছে। কেন না আইন তৈরীকালীন সময়ে স্বার্থসংশ্লিষ্ট সব পক্ষগুলোর সাথে প্রয়োজনীয় আলোচনা না করা এবং বিষয়জ্ঞানের ঘাটতির ফলে নানান ফাকফোকর সমেত আইনি দুর্বলতাতো রয়েছেই। তার উপর সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে আইন সময়োপযোগীকরণ, প্রয়োজনীয় ও যথাযথ বিধি-প্রবিধি কিংবা আচরণ-বিধি প্রণয়ন এবং আইনের যথাযথ ব্যবহার বা প্রয়োগের অনুপস্থিতি ইত্যাদি এসব আইনগুলোকে অনেকটাই অকার্যকর করে রেখেছে। তার সাথে স্রেফ নিজেদের স্বার্থে কোনো কোনো আইনের অপব্যাখ্যা ও অপব্যবহারতো রয়েছেই।
অন্যদিকে পর্যটন শিল্পের স্বাভাবিক গতি-প্রকৃতি, শৃঙ্খলা, স্বার্থ রক্ষা, ব্যবস্থাপনা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার জন্য যেসব বিষয়ে আইন প্রণয়ন অপরিহার্য সেসব বিষয়ে কোন পদক্ষেপ গ্রহণ না করার ফলে এই শিল্পের যেমনি স্থবিরতা কাটছে না তেমনি শৃঙ্খলাও বজায় থাকছে না। এমন অপরিহার্য বিষয়গুলোর মধ্যে রয়েছে ট্র্যাভেল এন্ড ট্যুর অপারেশন, প্যাকেজ ট্যুর বা হলিডে ট্যুর, কোয়ালিটি ট্যুরিজম সার্ভিস, ট্যুরিস্ট ভেহিকল, ট্যুরিস্ট এন্টারটেইনমেন্ট, ট্যুরিস্ট সেফটি এন্ড সিকিউরিটি, ট্যুরিজম এজুকেইশন, ট্যুরিজম ট্রেইনিং, ট্যুরিজম রিসার্স, ট্যুরিজম ইনভেষ্টমেন্ট, ট্যুরিস্ট/কনজিউমার প্রটেকশন, এনভায়রনমেন্টাল প্রোটেকশন এন্ড প্রিজারভেশন, কালসারেল প্রটেকশন এন্ড রেস্টোরেশন ইত্যাদি।
তাছাড়াও প্রয়োজনীয় আইনের অভাবে আমাদের পর্যটনের প্রশাসনিক কাঠামো নিয়ে সৃষ্ট যে সমস্যা তা আজো দূর হয়নি। তার বড় প্রমান বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন (বিপিসি) এবং বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ড (বিটিবি) এর মধ্যেকার কার কি করণীয় তা নিয়ে অস্পষ্টতা। কেন না বিপিসি পর্যটনের জন্মলগ্ন থেকে এখন পর্যন্ত তার জনবল, অভিজ্ঞতা এবং সহায়-সম্পদের দিক থেকে যে শক্তিমত্তা অর্জন করেছে সে মোতাবেক পর্যটন উন্নয়নের কাজ থেকে তাকে দূরে রাখা হয়েছে। অপরদিকে বিটিবি এসব দিক থেকে এখনো দাঁড়াতেই পারেনি অথচ তাকে কাগুজে বাঘ বানানোর চেষ্টা এবং প্রশাসনিক মন্ত্রণালয়ের আধিপত্য সবকিছুকে লেজেগোবরে করে ফেলেছে। এতে কাজের কাজ কিছু হচ্ছেনা শুধু ব্যস্ততা বাড়ছে।
অথচ এই রাশভারি প্রশাসনের কোন দরকারই ছিলোনা; শুধু একটি কর্তৃপক্ষ গঠনই যথেষ্ট ছিলো। কিন্তু কথা হলো এই কাজটা কি এতই সহজ যে চাইলেই হয়ে যাবে। মোটেই তা নয় যদিও বিগত সরকারগুলো চাইলে এবং উদ্যোগ নিলে এগুলো সব না হলেও অনেকটাই আইনের আওতায় চলে আসতো। অবশ্য অনেক ক্ষেত্রে রাজনৈতিক সরকার চাওয়ার পরও প্রশাসনিক সরকার বা আমলাতন্ত্র তা হতে দেয়নি। এসব কারণে এবং এই ঘাটতি পূরণ হওয়া দরকার এমন উপলব্দি থেকেই দাবী উঠেছিল পর্যটন শিল্প সম্পৃক্ত যাবতীয় বিষয়গুলোর সমন্বয় করে একটি একক বা সমন্বিত (Unitary or Integrated Tousim Law) পর্যটন আইন প্রণয়নের।
তাই, বহু বছরের এই দাবীর যৌক্তিকতা নিরূপনের পর ২০০৭ সালে তৎকালীন তত্বাবধায়ক সরকার একটি একক পর্যটন আইনের খসড়া প্রণয়নের জন্য কমিটি গঠন করে। খসড়া প্রণয়নের পর সরকার এটিকে আইনে পরিণত করার যাবতীয় প্রস্তুতি গ্রহণ এবং বারবার ঘোষণা দেয়ার পরও কোন এক অদৃশ্য শক্তির কবলে পড়ে সেটি আলোর মুখ দেখতে পারে নি। এমনকি ২০১৪ সালে পুনরায় আইনটি জাতীয় সংসদে পাশ করানোর উদ্যোগ গ্রহণ করা হয় এবং এ লক্ষে একটি রিভিউ কমিটিও গঠন করে দায়িত্ব দেয়া হয়। কিন্তু ঐ কমিটি যথা সময়ে তাদের দায়িত্ব পালন করে খসড়া আইনটি মন্ত্রণালয়ে জমা দিলেও আবার এটিকে কে বা কারা হিমঘরে পাঠিয়ে দেয়। এমনকি আমি নিজে উভয় কমিটিতে একজন সক্রিয় সদস্য থেকেও সুনামি শুধু প্রত্যক্ষ করেছি ঠেকাতে পারিনি।
সেই প্রেক্ষাপটে যত সময় যাচ্ছে একটি একক পর্যটন আইনের প্রয়োজনীয়তা ও উপযোগীতা প্রচণ্ডভাবে অনুভূত হচ্ছে। অবশ্য আমাদের পর্যটন শিল্পের এই দীর্ঘ পথপরিক্রমায় সময়ে সময়ে প্রয়োজনীয় আইন প্রণয়ন করা হয়ে গেলে আজকের এই আইনি শূন্যতা দেখা দিতনা। অথচ এই শূন্যতা পূরণের জন্য পর্যায়ক্রমিক কোন উদ্যোগও অন্তত আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে অনেকটাই অবাস্তব। কারণ, এজন্য যে দীর্ঘসূত্রীতা দেখা দেবে তাতে কাজের কাজ কিছু হওয়ার পরিবর্তে আবারো নির্ঘাত আইনী জটের সৃষ্টি হবে।
তার বড় প্রমাণ প্রায় আটচল্লিশ বছর পর ২০২১ সালে “ট্যুর অপারেটর ও ট্যুর গাইড” এর মত গুরুত্বপূর্ণ আইনটির জন্য মহান জাতীয় সংসদে হ্যাঁ জয়যু ক্ত হয়েছিলো বটে। কিন্ত এটিকে কার্যপোযোগী করার জন্য প্রয়োজনীয় বিধি-বিধান তৈরীর কাজ সম্পন্ন হয়েছে ২০২৪ সালের মধ্যভাগে এসে। এমনকি এখন পর্যন্ত এটির ব্যবহারই শুরু হয়নি। এসব কারণে তথা বাস্তবতার নিরিখে আমাদের পর্যটন দায়কগোষ্ঠী বা ট্যুরিজম স্টেকহোল্ডাররা তাদের প্রয়োজনে এবং সময়ে সময়ে সুনির্দিষ্ট পর্যটন আইন প্রণয়নকে একটি চলমান প্রক্রিয়া হিসেবে চালু রাখতে চেয়েছিলো। কিন্ত আমলাতন্ত্র সৃষ্ট নানা অজুহাতে পড়ায় তা ঐ কালক্ষেপণের অক্টোপাস থেকে মুক্ত হতে পারছিলনা।
এমতাবস্থায় আমাদের সম্ভাবনাময় পর্যটন শিল্পের শুধু উন্নয়নই নয় এটিকে টিকিয়ে রাখার স্বার্থে এবং বাস্তবতার নিরিখে একটি একক পর্যটন আইন প্রণয়ন একান্ত অপরিহার্য বটে। লক্ষণীয় যে, উন্নত বিশ্ব হোক আর উন্নয়নশীল বা স্বল্প উন্নত দেশ হোক পৃথিবীর কোন দেশই তার সাধারণ বা প্রচলিত আইনের উপর নির্ভর করে পর্যটন উন্নয়নের কাজ সম্পন্ন করতে পারে না। কেন না পর্যটন একটি গতিশীল ও বহুমাত্রিক শিল্প হওয়ায় এর উন্নয়নের প্রয়োজনেই যথা সময়ে সুনির্দিষ্ট পর্যটন আইন প্রণয়ন অনেকটাই বাধ্যবাধকতার মধ্যে চলে আসে। অথচ আমাদের মত পিছিয়ে পড়া একটি দেশ যেখানে উন্নয়নের রোল মডেল হওয়ার স্বপ্ন দেখছে সেখানে সে তার অতি সম্ভাবনাময় একটি খাত পর্যটনের উন্নয়ন চাইবে কিন্তু প্রয়োজনীয় আইন প্রণয়নে সর্বোত সহায়তা দেবে না তাতো হতে পারেনা এবং মেনেও নেয়া যায় না।
অতএব, পর্যটনের প্রশাসনিক কাঠামোর লেজেগোবরে অবস্থা এবং ব্যবসায়ীক দূরাবস্থা থেকে বেরিয়ে এসে পর্যটন উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করার জন্য জট-পাকানো সুনির্দিষ্ট পর্যটন আইনগুলোর সুসমন্বয় করে একটি একক পর্যটন আইন প্রণয়ন শুধু যে স্বার্থসংশ্লিষ্টদের ও সময়ের দাবী তাই নয়। তার সাথে যোগ হয়েছে অভিভাবক হিসেবে সম্ভাবনাময় পর্যটন শিল্পের উন্নয়নে অঙ্গীকারাবদ্ধ সদাশয় সরকারের সঠিক দায়িত্ব পালনের মত বিষয়টি। মনে রাখতে হবে, সার্বিক বিচারে এবং বাস্তবতার নিরিখে পর্যটন উন্নয়নের স্বার্থেই এই মুহুর্তে আমাদের জন্য একটি একক পর্যটন আইনের কোন বিকল্প নেই।
জামিউল আহমেদ, চেয়ারম্যান: সেন্টার ফর ট্যুরিজম স্টাডিজ (সিটিএস)
zamiulahmed54@gmail.com