ঢাকাঃ দেশে বেড়েই চলেছে পেশাদার ভিক্ষুকের সংখ্যা। গত দুই বছর করোনা প্রকোপে তালিকায় যোগ হয়েছে হাজার হাজার নতুন ভিক্ষুক। যা সামাজিক এ সঙ্কট দিন দিন আরও প্রকট হচ্ছে। ভিক্ষুকের সংখ্যা নিরুপনে হালনাগাদ সমন্বিত কোনো জরিপ নেই।
গত বছর সমাজকল্যাণমন্ত্রী জাতীয় সংসদে জানিয়েছিলেন, দেশে ভিক্ষুকের সংখ্যা আড়াই লাখ। অর্থাৎ মোট জনসংখ্যার শূন্য দশমিক ১৭ শতাংশ মানুষ ভিক্ষাবৃত্তিতে নিয়োজিত। কিন্তু বিভিন্ন সংস্থার জরিপ বলছে, প্রকৃত সংখ্যা ২০ লাখের কাছাকাছি। এর মধ্যে শুধু রাজধানীতেই রয়েছে ৫০ হাজারের বেশি পেশাদার ভিক্ষুক।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো বলছে, করোনার প্রভাবে শহর থেকে গ্রামে এখন দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বেড়েইে চলেছে। দেশের বেকারের সংখ্যা ২১ শতাংশে নেমে এলেও বর্তমানে তা প্রায় ৪২ শতাংশ। ভয়াবহ বেকারত্ব থেকেই সৃষ্টি হচ্ছে নিত্য নতুন ভিক্ষুক।
সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণে ভিক্ষাবৃত্তি :
সরকারি পুনর্বাসনের আওতায় কেন ভিক্ষুকরা আসতে চায় না-এর কারণ অনুসন্ধানে মিলেছে বেশকিছু চাঞ্চল্যকর তথ্য। অন্য সাধারণ পেশা থেকে ভিক্ষাবৃত্তিতে আয় বেশি। ভিক্ষাবৃত্তি পেশা হিসেবে স্বীকৃত না হলেও এটির সামাজিকভিত্তি বেশ মজবুত। কোনো প্রকার ঝুঁকি নেই। মর্যাদা এবং সামাজিক লাজলজ্জ্বা বিসর্জন দিয়ে হাত বাড়াতে পারলেই হলো মিলতে থাকে ভিক্ষা। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর নাকের ডগায়ই চলে ভিক্ষাবৃত্তি।
হালে ভিক্ষাবৃত্তি চলে গেছে সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণে। প্রভাবশালী ব্যক্তিরা নিয়ন্ত্রণ করছে ভিক্ষুক-বিচরণ এলাকা।
অনুসন্ধানের তথ্য মতে, গ্রামাঞ্চল থেকে থেকে বিকলাঙ্গ, শিশু-কিশোরসহ হতদরিদ্র ও বয়োবৃদ্ধ নারী-পুরুষ রাজধানীতে এনে ভিক্ষাবৃত্তিতে নিয়োগ করছে এ সিন্ডিকেট। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর ছত্রছায়ায় চলে এই সিন্ডিকে। সিন্ডিকেটভুক্ত না হয়ে কেউ নির্বিঘ্নে ভিক্ষা করতে পারে না। সিন্ডিকেট অবুঝ শিশুদের কোলে নিয়ে, কখনওবা শারীরিক প্রতিন্ধীদের কাজে লাগিয়ে হাতিয়ে নিচ্ছে বিপুল অর্থ। এমনকি সুস্থ মানুষকেও কৃত্রিম উপায়ে প্রতিবন্ধিত্বের কবলে ফেলে ভিক্ষা-ব্যবসা। সরকারি হিসেবে ঢাকায় ভিক্ষুকের সংখ্যা ৫০ হাজার বলে দাবি করা হলেও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের হিসেবে এ সংখ্যা ৩ লাখের বেশি। সারা দেশে ভিক্ষুকের সংখ্যা আড়াই লাখ দাবি করা হলেও এ সংখ্যা ২০ লাখের কাছাকাছি।
রাজধানীতে দৈনিক অন্তত ২০ কোটি টাকার ভিক্ষা-বাণিজ্য হয়। এ হিসেবে মাসে লেনদেন হয় ৬শ’ কোটি টাকা। বিপুল এই ‘অর্থনৈতিক লেনদেন’র খাত বন্ধ কিংবা নিয়ন্ত্রণে সর্বশেষ অর্থ বছরে জাতীয় বাজেটে বরাদ্দ রাখা হয়েছে মাত্র ৪ কোটি টাকা।
নগণ্য পরিমাণ এ অর্থ দেশের ভিক্ষাবৃত্তি বন্ধ কিংবা নিয়ন্ত্রণে হাস্যকর বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।
ব্যর্থ সরকারি উদ্যোগ :
রাজধানীতে ভিক্ষুকের উৎপাত দিন দিন বাড়ছে। তবে এ বাস্তবতার কথা মানে না, রাজ-সমাজসেবা অধিদফতর। সংস্থাটি জানায়, রাজধানীর ভিক্ষাবৃদ্ধি রোধে সরকার নগীরর বেশ কিছু এলাকা ‘ভিক্ষুকমুক্ত’ ঘোষণা করেছে। বিমানবন্দরে প্রবেশপথে পূর্ব পাশের চৌরাস্তা, বিমানবন্দর পুলিশ ফাঁড়ি ও এর আশপাশ এলাকা, হোটেল রেডিসন সংলগ্ন এলাকা, ভিআইপি রোড, বেইলী রোড, হোটেল সোনারগাঁও ও হোটেল রূপসী বাংলা সংলগ্ন এলাকা ও কূটনৈতিক জোনসমূহ। এলাকাগুলোকে ভিক্ষুকমুক্ত রাখার লক্ষ্যে নিয়মিত মাইকিং, বিজ্ঞাপন, লিফলেট বিতরণ এবং বিভিন্ন স্থানে নষ্ট হয়ে যাওয়া প্লাগস্ট্যান্ড মেরামত/নতুন স্থাপন করার কাজ চলমান রয়েছে। ২০২০-২১ অর্থ বছরে ঢাকা শহরের ভিক্ষুকমুক্ত ঘোষিত এলাকাগুলোতে ১৮টি মোবাইল কোর্ট পরিচালনার মাধ্যমে ১৮০ জন পেশাদার ভিক্ষুককে আটক করা হয়। এর মধ্যে ৭২ জনকে সরকারি আশ্রয় কেন্দ্রে বিভিন্ন মেয়াদে আটক রেখে প্রশিক্ষণ প্রদান ও পুনর্বাসন করা হয়। অবশিষ্ট ১০৮ জনকে পরিবারে পুনর্বাসন করা হয়। ভিক্ষুক পুনর্বাসনের কাজটি পদ্ধতিগতভাবে করার জন্য একটি নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়েছে।
সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, ভিক্ষাবৃত্তি রোধ এবং ভিক্ষকুদের পুনর্বাসনের মাধ্যমে কর্মমুখী করার লক্ষ্যে একাধিকবার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এর মধ্যে ২০১৩ সালে নেয়া একটি উদ্যোগ ‘এক্সপেরিমেন্ট’ পর্যায়েই ব্যর্থ হয়েছে। ভিক্ষুকদের বিকল্প কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে রাজধানীর অন্তত ২ হাজার ভিক্ষুককে জরিপের আওতায় আনা হয়। পাইলট কর্মসূচি বাস্তবায়ন পর্যায়ে ১০টি এনজিওকে দায়িত্ব দেয়া হয়। এনজিওগুলো রাজধানীকে ১০টি জোনে ভাগ করে। ১০ হাজার ভিক্ষুকের ওপর জরিপ পরিচালনা করে তাদের ডাটাবেজ তৈরি করা করে।
কর্মসূচির পাইলটিং পর্যায়ে ভিক্ষুক পুনর্বাসনে সংখ্যা বিবেচনায় প্রাথমিকভাবে ময়মনসিংহ, ঢাকা, বরিশাল ও জামালপুর জেলাকে নির্বাচন করে জেলাওয়ারি ৫শ’ জন করে ২ হাজার ভিক্ষুক পুনর্বাসনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। কর্মসূচির অংশ হিসেবে সেবছর সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী, স্থানীয় সংসদ সদস্যের উপস্থিতিতে ময়মনসিংহের ৩৭ জন ভিক্ষুকের মধ্যে ১২ জনকে ১২টি রিকশা, ১৭ জনকে ১৭টি ভ্যান ও ক্ষুদ্র ব্যবসা পরিচালনার জন্য ৫ হাজার করে টাকা করে দেয়া হয়। ৮ জনকে ৫ হাজার করে টাকা দিয়ে কর্মসূচির উদ্বোধন হয়।
পরবর্তী সময়ে দেখা যায়, ভিক্ষুকরা রিকশা এবং ভ্যানগুলো বিক্রি করে দেয়। নগদ টাকাও খরচ করে ফেলে। তারা অন্য এলাকায় গিয়ে ফের ভিক্ষাবৃত্তিতে লিপ্ত হয়। ফলাফলে ব্যর্থ হয় ভিক্ষুক পুনর্বাসন প্রকল্প।
আইন কি বলছে? :
ভিক্ষাবৃত্তি বিরোধী সরাসরি কোনো আইন এখনও প্রণীত হয়নি। তবে এটি নিয়ন্ত্রণ কিংবা পুনর্বাসনের চেষ্টা চলছে ‘ভবঘুরে নিয়ন্ত্রণ আইন’র আওতায়। যদিও ভিক্ষাবৃত্তি বন্ধে কাজে আসছে না ভবঘুরে নিয়ন্ত্রণ আইনও। প্রণয়নের একদশক অতিবাহিত হলেও এর কোনো সুফল মেলেনি। ২০১১ সালে প্রণীত হয় ‘ভবঘুরে পুনর্বাসন আইন’। অত্যন্ত প্রয়োজনীয় এ আইনটি এখন পর্যন্ত কার্যকর করা যায়নি।
আইনটির পর্যালোচনায় দেখা যায়, ভবঘুরে নিয়ন্ত্রণে আইন থাকলেও পুনর্বাসনের প্রশ্নে রয়েছে অস্পষ্টতা। পেশাদার ভিক্ষুক সংখ্যা বৃদ্ধির এটি বড় একটি কারণ। বিশ্লেষকরা বলছেন, আইনের খসড়া প্রণয়নকারীদের অদূরদর্শিতা, আইন কার্যকরে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার সদিচ্ছা এবং বিধি না হওয়ার কারণেই আইনটির সুফল মিলছে না।
ভবঘুরে ও নিরাশ্রয় ব্যক্তি (পুনর্বাসন) আইন, ২০১১ তে বলা হয়েছে, যে নিজে বা কারও প্ররোচনায় ভিক্ষাবৃত্তিতে লিপ্ত, সে ভবঘুরে হিসেবে বিবেচিত হবে। এতে ভবঘুরেদের আটক করার বিধান রাখা হয়েছে। আইনে আরও বলা হয়েছে, ভবঘুরেকে আটকের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে হাজির করতে হবে। আর আটককৃত ব্যক্তি ভবঘুরে হলে ম্যাজিস্ট্রেট যেকোনো আশ্রয়কেন্দ্রে কমপক্ষে ২ বছর তাকে আটক রাখার জন্য অভ্যর্থনা বা আশ্রয়কেন্দ্রে পাঠানোর নির্দেশ দেবেন।
আইনে ভাসমান জনগোষ্ঠীকে ‘ভবঘুরে’ এবং ‘আশ্রয়হীন’ হিসেবে চিহ্নিত করা হলেও তাদের সামাজিকভাবে পুনর্বাসনে স্পষ্ট কোনো বিধান রাখা হয়নি। ২০১১ সালে প্রণীত ‘ভবঘুরে ও নিরাশ্রয় ব্যক্তি পুনর্বাসন আইন’র ১০(৩)(খ) ধারায় বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি ভবঘুরে হিসেবে প্রমাণিত হলে, তাকে অনধিক ২ বছরের আটকাদেশ দেওয়া যাবে। কিন্তু পুনর্বাসনের বিষয়ে আইনটির ১৮(১) ধারায় সংক্ষেপে বলা হয়েছে, আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থানরত ভবঘুরে ব্যক্তির পুনর্বাসনের লক্ষ্যে সরকার নির্ধারিত পদ্ধতিতে পরিকল্পনা প্রণয়নপূর্বক তা বাস্তবায়নের উদ্দেশে যথাযথ ব্যবস্থা প্রহণ করবে।’ এখানে ‘নির্ধারিত পদ্ধতি’ বলা হলেও আইনের কোথাও কোনো পদ্ধতির উল্লেখ নেই। এছাড়া ধারায় উল্লেখিত ‘যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ’ বলতে কি ব্যবস্থা নেয়া হবে সেটিও স্পষ্ট নয়। আইনের দৃষ্টিতে ‘যথাযথ ব্যবস্থা’ শব্দটি অনির্ধারিত ও অস্পষ্ট বলেই বিবেচিত। আইনে আটককালিন মেয়াদে তার শিক্ষা, প্রশিক্ষণ, বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণের কোনো বিধান রাখা হয়নি। এমনকি আটকের মেয়াদ শেষ হওয়ার পর তাকে সরকারি বা বেসরকারি সহায়তায় পুনর্বাসনের কোনো বিধান রাখা হয়নি। ফলে আটককৃত ভবঘুরেদের আটকের মেয়াদ শেষে বৈধ কাজকর্ম করে জীবিকা নির্বাহের সুযোগ নেই। এতে আটককৃত ভিক্ষুকরা তাদের আটকের মেয়াদ শেষে আবারো ভিক্ষাবৃত্তিতেই ফিরে যায়। মোবাইল কোর্ট তাদের বারবার আটক করলেও ভিক্ষাবৃত্তি বন্ধ হচ্ছে না। ফলে ভবঘুরে নিয়ন্ত্রণ ও পুনর্বাসনের লক্ষ্যে বিদ্যমান আইন ভিক্ষাবৃত্তি বন্ধে কার্যকর কোনো ভূমিকাই রাখছে না।
‘হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ’র চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ বলেন, আইনটি জনগুরুত্বপূর্ণ অথচ অসম্পূর্ণ। খসড়ায় অদূরদর্শিতা রয়েছে। বিধান করা না হলে শুধু আইন কখনো সফলতা আনতে পারে না। নগরবাসী ভিক্ষুকদের যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ। অথচ সরকার নাকি কোনো ভিক্ষুকই খুঁজে পাচ্ছে না। কর্তৃপক্ষীয় এ ধরনের দৃষ্টিভঙ্গির কারণেই অসাধু ব্যক্তিরা ভিক্ষাবৃত্তিতে নিত্যনতুন মাত্রা যোগ করছে।
ঢাকা স্কুল অব ইকোনমিক্সের সভাপতি অর্থনীতিবিদ কাজী খলীকুজ্জামান আহমদের মতে, করোনাকালে প্রচুর মানুষ কাজ হারিয়েছে। বাসা-বাড়িতে যারা কাজ করত, করোনায় আর তাদের সে কাজটিও নেই। আবার তারা যে সরকারি সেফটি নেট প্রোগ্রামের আওতায় আসবে তাও সম্ভব হয়নি। কারণ, এদের নির্দিষ্ট ঠিকানা নেই, অনেকেই রাত কাটায় রাস্তাঘাটে। কেউ বা বস্তি এলাকায় কয়েকটি ফ্যামিলি মিলে থাকে। সরকারি আর্থিক সমর্থন না পাওয়া এবং সাম্প্রতিক দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির ফলেও ভিক্ষক সংখ্যা বাড়বে। ভিক্ষুকের সংখ্যা ক্রমবর্ধিষ্ণু। ভিক্ষাবৃত্তির মতো সামাজিক সঙ্কট থেকে মুক্ত হতে হলে, তাদের জন্য কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে।
আগামীনিউজ/বুরহান