ঢাকাঃ ব্যবসায়ীদের আন্দোলনের মুখে অবশেষে লকডাউনের মধ্যেই খুলে দেখা হলো রাজধানীর বিপণিবিতান। প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত স্বাস্থ্যবিধি মেনে মার্কেট খোলা রাখার নির্দেশনা দিয়েছে সরকার। চলমান লকডাউনে চার দিন বন্ধ থাকার পর শুক্রবার মার্কেট খুলতেই কেনাকাটায় ঈদের ভিড় লেগে যায়। তাতে বালাই ছিল না স্বাস্থ্যবিধি মানার।
শুক্রবার রাজধানীর নিউমার্কেট, গাউছিয়া, চাঁদনি চক, ইস্টার্ন মল্লিকাসহ আশপাশের মার্কেট, বসুন্ধরা শপিং মল ও টোকিও স্কয়ার ঘুরে এমন চিত্র দেখা গেছে।
গত সোমবার থেকে দেশে এক সপ্তাহের লকডাউন ঘোষণা করে সরকার। অন্যান্য বিধিনিষেধের সঙ্গে বিপণিবিতান বন্ধ থাকবে বলেও জানানো হয় নির্দেশনায়। তবে শুরু থেকেই এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে আসছেন দোকানিরা। মার্কেট খোলা রাখার দাবিতে তারা আন্দোলনও করেন। একপর্যায়ে সরকারের পক্ষ থেকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে শুক্রবার থেকে দিনে আট ঘণ্টা মার্কেট খোলা রাখার অনুমতি দেয়া হয়।
আজ নিউমার্কেট এলাকা গিয়ে দেখা যায়, এলাকাটি লোকে লোকারণ্য। নিউমার্কেট ও গাউছিয়া মার্কেটে ক্রেতাদের উপচেপড়া ভিড়। এখানকার ফুটপাতে আগের মতোই পোশাক-পরিচ্ছদের পসরা সাজিয়ে বসেছেন বিক্রেতারা। আর এসব পোশাক কিনতে ক্রেতারও কোনো কমতি নেই। বরং স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে অনেক বেশি ভিড় চোখে পড়ল।
মাস্ক অনেকে পরলেও সামাজিক দূরত্বে কোনো বালাই ছিল না মার্কেটগুলোতে। মার্কেটের বিক্রেতাদের কাছে সামাজিক দূরত্বের বিষয়ে জানতে চাইলে, ‘দেশে করোনাভাইরাস বলে কিছু নেই’, ‘সবকিছুই মানুষের মনগড়া’ বলে মন্তব্য করেন কেউ কেউ। আবার কেউ স্বাস্থ্যবিধির গুরুত্ব বুঝলেও তা মানতে পারছেন না বলে জানান।
নিউ সুপার মার্কেটের সামনের ওভারব্রিজে নারীদের চুলের ক্লিপ বিক্রি করেন সোহেল রানা। গত চার দিন দোকান বন্ধ থাকায় তার বিশাল ক্ষতি হয়েছে বলে জানান তিনি। সোহেল বলেন, ‘এক লকডাউনেই তো খবর হইয়া গেছে। চাইর দিনে একটা টাকাও ইনকাম নাই। আমরা কী খাই, ক্যামনে চলি কেউ খবর রাখে?’
দেশে করোনার প্রকোপ মারাত্মক আকার ধারণ করায় ভাইরাসটির সংক্রমণ রোধে আগামী ১৪ এপ্রিল থেকে এক সপ্তাহের কঠোর লকডাউনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। ঘোষিত লকডাউনের সময় জরুরি সেবা ছাড়া সরকারি-বেসরকারি সব অফিস বন্ধ থাকবে বলে শুক্রবার জানিয়েছেন জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন।
এমন সিদ্ধান্তে কপালে হাত ব্যবসায়ীদের। সোহেলের প্রত্যাশা, লকডাউন যেন না দেয়া হয়। বলেন, ‘আবার যদি লকডাউন দেয়া হয় তাহলে আমার ফ্যামিলি নিয়ে না খেয়ে মরতে হবে। কীভাবে চলমু? চুরিও তো করতে পারমু না। তাইলে চলমু ক্যামনে?’
অপর এক ব্যবসায়ী আকবর হোসেন বলেন, ‘সামনে রমজান, এবার যদি আমরা ব্যবসা করতে না পারি তাহলে আমাদের পথে বসা ছাড়া কোনো উপায় থাকবে না।’
চার দিন বন্ধ থাকার পর দোকান খুলতে পারায় আনন্দ প্রকাশ করেছেন চাঁদনি চক মার্কেটের ব্যবসায়ী রহমত মিয়া। তিনি বলেন, ‘বন্ধের পর দোকান খুলে কাস্টমারের সংখ্যা মোটামুটি ভালো। তবে জীবন এবং জীবিকা দুইটাই দেখার বিষয়। এখন জীবন যদি বাঁচে তবে জীবিকা হবে।’
নিউ সুপার মার্কেটের নিউ ঢাকা ফ্যাশনের মালিক আবু সুফিয়ান জানান, লকডাউন দেয়া হবে তাদের ওপর সরকারের এক রকম নির্যাতন। স্বাস্থ্যবিধি মেনে দোকান খোলা রাখার দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, ‘সরকার যেন পর্যাপ্ত স্বাস্থ্যবিধি মেনে মার্কেট খোলা রাখার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। মার্কেট কমিটি আমাদেরকে নিয়ম-শৃঙ্খলার মধ্যে নিয়ে আসছেন। আমরা নিয়ম মেনে বেচাবিক্রি করছি। আমাদের তো বাঁচতে হবে।’
শুক্রবারও স্বাস্থ্যবিধি মেনে দোকান খোলার কথা ছিল ব্যবসায়ীদের। কিন্তু সরেজমিনে সে স্বাস্থ্যবিধি খুব একটা চোখে পড়েনি। গাউছিয়া ও চাঁদনি চক মার্কেটের মূল ফটকে বসানো হয়েছে জীবাণুনাশক টানেল। কিন্তু কাছে গিয়ে দেখা যায়, টানেলটি অকেজো। এছাড়া ফটকের সামনে দাঁড়ানো নিরাপত্তা কর্মীর হাতে হ্যান্ডস্যানিটাইজার দেখা গেলেও মার্কেটে ঢুকছে এমন ক্রেতাদের তা দেয়া হচ্ছে না। এ বিষয়ে নিরাপত্তাকর্মীর দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি মার্কেট থেকে বেরিয়ে যাচ্ছেন, এমন ক্রেতাদের হ্যান্ডস্যানিটাইজার দিতে শুরু করেন। এর কারণ জানতে চাইলে ওই কর্মী এক গাল হেসে বলেন, ‘একভাবে দিলেই তো হয়।’
মার্কেটগুলো ঘুরে প্রায় ৮০ শতাংশ ক্রেতা-বিক্রেতাকে মাস্ক পড়া অবস্থায় দেখা গেলেও প্রায় ২০ শতাংশ মানুষ মাস্ক পড়েননি। আবার অনেকে মাস্ক পরলেও তা সঠিক জায়গায় পরেননি। মাস্ক ব্যবহার করছেন না এমন ব্যক্তিদের মধ্যে বেশির ভাগই তরুণী ও ফুটপাতের ব্যবসায়ী।
এদিকে নিউমার্কেট এলাকার আশপাশের প্রায় সব খাবার হোটেল ও রেস্তোরাঁ খোলা ছিল। এমনকি সরকারি নির্দেশনা উপেক্ষা করেই এসব হোটেল ও রেস্তোরাঁয় টেবিলে খাবার পরিবেশ করতে দেখা গেছে।
বিকাল পাঁচটায় মার্কেট ও দোকান বন্ধের কথা থাকলেও তা বন্ধ হয়েছে সাড়ে পাঁচটার পরে। আর ফুটপাতের দোকান বন্ধ হয়েছে ৬টা নাগাদ। দোকান বন্ধের পরেও নিউ মার্কেট এলাকায় ক্রেতারে ভিড় যেন কমতেই চায় না।
বাড়তি ক্রেতার চাপ পড়ে নিউমার্কেটের আশপাশের সড়কে। শুক্রবার বিকাল থেকে সন্ধ্যা নাগাদ পুরো এলাকায় গাড়ির চাপ ছিল স্বাভাবিকের তুলনায় অনেক বেশি। আর সন্ধ্যার পর পর্যন্ত যানজট ছিল নিউমার্কেট, এলিফ্যান্ট রোড এলাকায়।
এলিফ্যান্ট রোড এলাকার সব মার্কেট ও জুতার দোকানেও ক্রেতার প্রচুর ভিড় ছিল। এখানে অধিকাংশ মার্কেটের সামনে নিরাপত্তাকর্মীদের হাতে হ্যান্ডস্যানিটারজার থাকলেও ক্রেতাদের মাত্রাতিরিক্ত ভিড় থাকার কারণে সবাইকে স্যানিটাইজার দেয়া সম্ভব হচ্ছে না বলে জানান দোকানিরা। আবার ক্রেতাদের অনেকেই মাস্ক ছাড়াই প্রবেশ করছেন মার্কেট ও দোকানগুলোতে। বেশি কিছু দোকানের বিক্রেতাদের মুখেও মাস্কের দেখা মেলেনি।
ক্রেতাদের ভিড় চোখে পড়ার মতো ছিল বসুন্ধরা সিটি শপিং কমপ্লেক্সে। শুক্রবার সকালের দিকে মার্কেটটিকে ক্রেতার আনাগোনা কিছুটা কম থাকলেও দুপুরের পর তা বাড়তে থাকে। বিকাল বাড়তে বাড়তে মার্কেটে ক্রেতার আনাগোনা ছিল অনেকটা ঈদের সময়ের মতোই।
একই চিত্র দেখা গেছে রাজধানীর মোহাম্মদপুরের টোকিও স্কয়ারে। মার্কেটের অন্যান্য তলায় ক্রেতা সমাগম কম থাকলেও মার্কেটের প্রথম ও ষষ্ঠ তলায় ক্রেতা ছিল অনেক। সামাজিক দূরত্ব ও স্বাস্থ্যবিধি এখানে ছিল না থাকার মতোই।
মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেটে স্বাস্থ্যবিধি ও সামাজিক দূরত্বের আরেক দুরবস্থা চোখে পড়েছে। মার্কেটটিতে মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত ক্রেতার সংখ্যা বেশি। মার্কেটটির অর্ধেকের বেশি বিক্রেতাকে দেখা গেছে মাস্ক ছাড়া। ক্রেতাদের মধ্যে মাস্ক পরার প্রবণতা অনেকটাই কম। এছাড়া সামাজিক দূরত্ব পালনের সুযোগই নেই এই মার্কেটে। কেননা মার্কেটটির প্রতিটি গলির প্রস্থ তিন ফুটের মতোই। দোকানগুলোও ছোট ছোট হওয়ায় স্বাস্থ্যবিধির মানার প্রবণতা চোখে পড়েনি।
এছাড়া বিকাল পাঁচটার পরেও দোকান খোলা ছিল কৃষি মার্কেটের মূল মার্কেটের বাইরে অংশে। ফুটপাতের দোকান বন্ধ করা হয়েছে অনেক পরে। কেউ দোকান সামান্য খোলা রেখে বেচাকেনা করেছেন। আর কৃষি মার্কেটের পেছনের অংশে বিহারি ক্যাম্প লাগোয়া দোকানগুলোতে পাত্তাই দেয়া হয়নি স্বাস্থ্যবিধির।
আগামীনিউজ/প্রভাত