ঢাকাঃ মহামারি করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে গেলো বছরের ১৭ মার্চ থেকে বন্ধ রয়েছে দেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। দীর্ঘ ১১ মাস ধরে প্রাথমিক থেকে উচ্চ শিক্ষা পর্যন্ত রীতিমতো থমকে আছে।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হওয়ায় শিক্ষার্থী, বেসরকারি স্কুলের শিক্ষক ও অভিভাবকদের প্রতিনিয়ত পড়তে হচ্ছে বিড়ম্বনায়।
শিক্ষাখাতে হচ্ছে বহুমুখী ক্ষতি। স্বাস্থ্যবিধি মেনে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার অনেক দিন তারিখ শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে ঠিক হলেও শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্য সচেতনতার কথা চিন্তা করে এখনও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার সিদ্ধান্ত হয়নি।
একদিকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হওয়াতে শিক্ষার্থীদের পড়ালেখার ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে, অন্যদিকে সরকারি স্কুল-কলেজগুলোর শিক্ষকদের সরকার যথারীতি বেতন ভাতা দিলেও বেতন ভাতা বন্ধ রয়েছে অধিকাংশ বেসরকারি স্কুল কলেজের শিক্ষকদের। একই সঙ্গে বন্ধ রয়েছে প্রাইভেট টিউটরদের বেতন। এতে করে কর্মহীন হয়ে পড়ছে শিক্ষা সংশ্লিষ্ট অধিকাংশ মানুষ।
শিক্ষকতা পৃথিবীর সবচেয়ে মানসিক চাপ সৃষ্টিকারী পেশা। শুনতে অবাক লাগলেও এটাই বাস্তব এবং গবেষণায় প্রমাণিত। ২০২০ সালের শিক্ষক মঙ্গল সূচক অনুযায়ী ৭২ শতাংশ শিক্ষক মানসিক চাপের মধ্যে কাজ করেন। ৭৮ শতাংশ শিক্ষকের মধ্যে কোনো না কোনো আচরণগত, মানসিক বা শারীরিক সমস্যা দেখা যায়। জাতি গঠনে এরূপ গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালনকারী শিক্ষকদের প্রকৃত মর্যাদা কি আমরা নিশ্চিত করতে পেরেছি? যুক্তরাজ্যের এক সরকারি গবেষণায় দেখা গেছে, করোনাকালে শিক্ষকদের মানসিক স্বাস্থ্যের আরও অবনতি ঘটেছে, যা আমাদের শিক্ষকদের নিয়ে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করছে। শিক্ষক যদি ঠিক না থাকেন, তবে শিক্ষাব্যবস্থাও ঠিক থাকবে না। এ কারণে হার্ভাড বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্প্রতিক এক গবেষণায় শিক্ষকদের মানসিক অবস্থার উন্নতিতে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণের সুপারিশ করা হয়েছে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কেন শিক্ষকদের মর্যাদা অক্ষুণ্ন রাখার পদক্ষেপ জরুরি? প্রকৃতপক্ষে শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষকের চেয়ে উত্তম কিছু নেই। জাতি গড়ার সুনিপুণ কারিগর এই শিক্ষকদের সম্পর্কে বলতে গিয়ে আমেরিকার বিখ্যাত ইতিহাসবিদ হেনরি এডামস বলেছিলেন, ‘একজন শিক্ষক সামগ্রিকভাবে প্রভাব ফেলে, কেউ বলতে পারে না তার প্রভাব কোথায় গিয়ে শেষ হয়।’ ১৯৬৬ সালে ইউনেস্কো আয়োজিত শিক্ষকের মর্যাদা ও অধিকারবিষয়ক সম্মেলনে সমাজের প্রতি শিক্ষকদের অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তাদের বেতন, পদোন্নতি, চাকরির নিরাপত্তাসহ সব সুযোগ-সুবিধা স্বাভাবিক সময়ের মতো যে কোনো দুর্যোগেও নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে।
একটা সময় পর্যন্ত আমাদের দেশের শিক্ষকদের অবস্থা ছিল খুবই করুণ। ভগ্ন কুটির, অর্ধাহারে-অনাহারে থেকে শীর্ণ দেহে শিক্ষার আলো ছড়ানোয় ব্যস্ত শিক্ষক সমাজের এই চিত্র ছিল স্বাভাবিক বিষয়। এজন্যই আশরাফ সিদ্দিকী তার ‘তালেব মাস্টার’ কবিতায় লিখেছেন, ‘আমি যেন সেই ভাগ্যাহত বাতিওয়ালা/ পথে পথে আলো দিয়ে বেড়াই/ কিন্তু নিজের জীবনেই অন্ধকার মালা।’
করোনায় শিক্ষা খাতে সর্বোচ্চ বিপর্যয় ঘটেছে বলছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. তানজিমুদ্দীন খান। তিনি আগামী নিউজকে বলেন, প্রযুক্তিগত বিকাশের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মূল ধারার পড়ালেখায় আনা সম্ভব হয়নি।
শিক্ষার্থীরা ঘরে থাকার কারণে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে শিক্ষা থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। মূল্যায়ন পদ্ধতি না থাকায় শিক্ষার্থীরা পড়ালেখার বাইরে চলে গেছে। তাই এখন অনেককেই অটোপাশের জন্য আন্দোলনে ব্যস্ত থাকতে দেখা যায়।
তিনি আরও বলেন, সবচেয়ে করুণ অবস্থার মধ্যে নিদানিপাত করছে বেসরকারি স্কুল কলেজের শিক্ষকরা, এই জাতীর সূর্য সন্তানেরা করোনাকালে অনেকেই চাকুরি হারিয়েছেন আবার অনেকেই বাধ্য হয়ে শিক্ষকতার পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় কনর্ভাট হয়েছেন, এটা খুবই ভয়াবহ দিক।
আজিমপুরের বেসরকারি রায়হান স্কুল অ্যান্ড কলেজের সহকারী শিক্ষক ওমর ফারুক আগামী নিউজকে বলেন, করোনার বেসরকারি স্কুল কলেজের শিক্ষকরা আর্থিকভাবে ব্যাপক সমস্যার সম্মুখীন হয়েছেন। অনেক শিক্ষক এ দুর্বিপাকে পড়ে অন্য পেশার প্রতি ঝুঁকে পড়েছেন।
ওমর ফারুক বলেন, শিক্ষকদের চেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে শিক্ষার্থীদের। করোনায় অনলাইনে শ্রেণি কার্যক্রম চালালেও শিক্ষার্থীরা প্রকৃত বাস্তব শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। শুধু তাই নয় অনলাইন ক্লাসের উপর নির্ভরশীল হয়ে যাওয়ার ফলে ছোট ছোট বাচ্চাদের মোবাইলের প্রতি আসক্তি মারাত্মকভাবে বেড়ে গেছে।
করোনাভাইরাস মহামারিকালে শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে এক বেসরকারি গবেষণায় উঠে এসেছে যে দেশের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে ৬৯.৫ শতাংশ শিক্ষার্থী দূরশিক্ষণে অংশই নিতে পারেনি। স্কুল বন্ধ থাকায় ক্লাস পরীক্ষা আর মূল্যায়নের যে বিকল্প ব্যবস্থা করা হয়েছে, সেটি নিয়েও নানা রকম অভিজ্ঞতা
হয়েছে শিক্ষা সংশ্লিষ্ঠ সবার। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে শিক্ষক, শিক্ষার্থী আর অভিভাবকরাও চান ভবিষ্যতের প্রস্তুতি হিসেবে শিক্ষা ব্যবস্থা তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহারে আরো আকর্ষণীয়, আনন্দদায়ক আর সবার সাধ্যের আনা হোক।
বাংলাদেশে প্রায় চার কোটি শিক্ষার্থীর মধ্যে প্রাক-প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক স্তরেই সবচেয়ে বেশি শিক্ষার্থী পড়াশোনা করে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় গত শিক্ষাবর্ষেও ক্লাস-পরীক্ষা এবং মূল্যায়ন হয়েছে বিকল্প পদ্ধতিতে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের সাথে কথা বলে জানা যায়, তারা অনেকেই ক্লাসে অংশ নিতে পারেনি। তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহার করে অনলাইনে ক্লাস-পরীক্ষায় যারা অংশ নিয়েছে, তারাও বলছে যে বহুরকম সমস্যায় তাদের পড়তে হয়েছে।
আগামীনিউজ/প্রভাত