ঢাকাঃ লাল টিপ আর বাসন্তী রঙের শাড়িতে সেজে আসা মেয়েটির খোঁপায় উঠেছে হলুদ গাঁদার মালা। আবির এসে ছুঁয়ে যায় তার মৃদু হাসিতে টোল পড়া গাল। সেই পরিবেশে দূর থেকে কোকিলের সুরের মতো ভেসে আসে ‘বসন্ত এসে গেছে’। সত্যিই তাই, সব স্বপ্ন আর অপেক্ষা পূর্ণ করে অবশেষে বসন্ত এলো।
দিন ক্ষণ মেপে, অনেকটা উচ্ছ্বলতা নিয়ে বসন্ত এলো নগরে। তারপর বাদ্যযন্ত্র এ রাজ্যের সুরে সে ধরা দিয়েছে নাগরিক জীবনের চঞ্চলতায়।
ফাগুনকে বরণ করে নিতে প্রতি বছরের মতো এবারও উৎসবের আয়োজন করেছে জাতীয় বসন্ত উৎসব উদযাপন পরিষদ। ‘এসো মিলি প্রাণের উৎসবে’ স্লোগানকে সামনে রেখে এ উৎসবের আয়োজন করা হয়।
সোমবার (১৪ ফেব্রুয়ারি) সকাল সাড়ে সাতটা থেকে পরিষদের আয়োজনে রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের মুক্ত মঞ্চে শুরু হয় বসন্ত আবাহন। লাল, হলুদ, বাসন্তী রঙের শাড়ি, পাঞ্জাবি এবং রঙিন ফুলে সেজে নানা বয়সের মানুষ হাজির হন। তাতে জীবনের সীমাবদ্ধ বৃত্তকে পেরিয়ে গাওয়া হলো মলয় বাতাসের গান।
আয়োজনে প্রথমেই বেঙ্গল মিউজিকের শিল্পীরা সমবেত এসরাজ বাদ্যযন্ত্রে পরিবেশন করেন বাসন্তী রাগ। এরপর বসন্তের আবাহন পাঠ করেন বাচিকশিল্পী আহকাম উল্লাহ। সম্মেলক নৃত্য পরিবেশন করেন স্বপ্নবিকাশ কলা কেন্দ্র। ফাল্গুন আর ভালোবাসার মিশ্রণে আবৃত্তি করেন বাচিকশিল্পী ভাস্বর বন্দ্যোপাধ্যায়। ফাগুনের মোহনায় ততক্ষণে দর্শক সারি পরিপূর্ণ হয়েছে বসন্ত ভালোবাসা মানুষের লাল আর বাসন্তী রঙের সাজে। শিল্পীদের সঙ্গে গুণগুণিয়ে সুর ওঠে..বসন্ত জাগ্রত দ্বারে!
সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মধ্যে অনুষ্ঠিত হয় বসন্তকথন পর্ব। এই পর্বে উদযাপন পরিষদের সভাপতি স্থপতি শফি উদ্দিন আহমেদ বলেন, এবছর করোনাকালের বছর। তবু বসন্ত তার কাল নিয়মে চলে এসেছে। আমরাও সবাই এই বসন্ত উদযাপন করে সেই করোনার যাতনা দূর করতে চাই।
প্রতি বছর নানা আয়োজন-উৎসবে বসন্তকে বরণ করে নিত নগরবাসী। সবচেয়ে বড় উৎসব হতো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলার বকুলতলায়, তবে করোনাভাইরাস মহামারিতে গতবারের মতো এবারও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলার বকুলতলায় বসন্তবরণ উৎসব হচ্ছে না। শুধু সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের মুক্ত মঞ্চে কেন্দ্রীয়ভাবে এই বসন্ত উৎসবের আয়োজন হয়েছে।
জাতীয় বসন্ত উৎসব উদযাপন পরিষদ গত ২৮ বছর ধরে নাগরিক জীবনে বাসন্তী আনন্দ আর ফাগুনের আবির ছড়িয়ে আসছে। গত দুই বছর ধরে বসন্তের সঙ্গে মিলেছে ভালোবাসা দিবসও।
একটি বাঙালি সংস্কৃতি, অন্যটি সংস্কৃতির সঙ্গে মিশে গেছে। একটি প্রকৃতিকে বরণ করার আর অন্যটি আত্মার সঙ্গে সম্পর্কিত হওয়ার দিন। এবার দুইই মিলেমিশে একাকার। আর এ কারণে অনেকের কাছে আনন্দও আজ দ্বিগুণ।
শ্বশুর-শাশুড়ি ও ছেলেমেয়েদের নিয়ে মিরপুর থেকে বসন্ত উৎসবে আসেন চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য। তিনি বলেন, ‘প্রতি বছর পরিবারসহ আমরা বসন্ত উৎসবে আসি। ঈদ ও পূজার ন্যায় আমরা নতুন জামাকাপড় পড়ে বসন্ত উৎসবে আসি।
‘আজকের দিনটা আমার কাছে গুরুত্ব বহন করে। সারা দিন আনন্দ-উল্লাস করে দিনটি অতিবাহিত করতে চাই।’
ভালোবাসা দিবস এবং বসন্ত উৎসব কোনটিকে প্রাধান্য দেবেন জানলে চাইলে উৎসবে আসা নুরুল্লাহ নামের একজন বলেন, ‘ভালোবাসা দিবস বিদেশ থেকে ধার করা একটি সংস্কৃতি। তাই ভালোবাসা দিবস নিয়ে আমার আগ্রহ নেই, তবে বসন্ত উৎসব নিয়ে আমার আগ্রহ আছে ব্যাপক। তাই এটি উদযাপন করতে এখানে এসেছি।’
সাধারণ সম্পাদক মানজার চৌধুরী সুইট বলেন, আমরা আপনাদের নিয়ে বসন্তের অবগাহনে মেতে উঠতে চাই। বসন্তের যে রঙের ছটা, তা সবার ঘরে ঘরে পৌঁছে যাক, বর্ণিল যে আনন্দ, সেটিই আমাদের কাম্য।
সহ-সভাপতি কাজল দেবনাথ বলেন, আমরা বাংলাদেশের মানুষ অত্যন্ত ভাগ্যবান। পৃথিবীর কোথাও কিন্তু ষড়ঋতু নেই। আর এই ছয় ঋতুর মধ্যে বসন্ত একেবারে ঋতুরাজ। তরুণ প্রজন্মের জন্য বলতে চাই- প্রকৃতি আমাদের আসল জায়গা। আমাদের যে অর্জন তার সবকিছুই প্রকৃতির কাছ থেকে। আসুন আমরা নিজেদের প্রকৃতির মধ্যে বিলিয়ে দিই।
বসন্ত কথন শেষে শুরু হয় আবির মাখার পর্ব। তারপর একে একে মঞ্চে উঠে আসে বসন্তের গান, নৃত্য। তা থেকে বাদ পড়ে না আদিবাসী নৃ-গোষ্ঠী সংস্কৃতিও।
আগামীনিউজ/এমবুইউ