1. প্রচ্ছদ
  2. জাতীয়
  3. সারাবাংলা
  4. রাজনীতি
  5. রাজধানী
  6. আন্তর্জাতিক
  7. আদালত
  8. খেলা
  9. বিনোদন
  10. লাইফস্টাইল
  11. শিক্ষা
  12. স্বাস্থ্য
  13. তথ্য-প্রযুক্তি
  14. চাকরির খবর
  15. ভাবনা ও বিশ্লেষণ
  16. সাহিত্য
  17. মিডিয়া
  18. বিশেষ প্রতিবেদন
  19. ফটো গ্যালারি
  20. ভিডিও গ্যালারি

সন্দ্বীপের খেজুর রস ও গাছিদের গল্প

মহিউদ্দীন টিপু প্রকাশিত: জানুয়ারি ১৬, ২০২০, ১০:০৪ এএম সন্দ্বীপের খেজুর রস ও গাছিদের গল্প

চট্টগ্রামের দ্বীপ উপজেলা সন্দ্বীপে একসময় চাষিদের অন্যতম প্রধান আবাদ ছিল খেজুরের রস। তাই শীতকালে ওদিকের জীবনযাত্রা ছিল খেজুর গাছকেন্দ্রিক।

হাটে-মাঠে-ঘাটে-পথে সব জায়গায় সাজ সাজ রব ছিল এ মৌসুমে। শীতকালে হাটের আনাচে-কানাচে ছেয়ে যেত গুড়ের লাল লাল ভাঁড়ে।

চট্টগ্রামসহ আশপাশের পাইকাররা আসত গুড় কিনতে। আড়তদাররা বড় বড় পাল্লা বসিয়ে তাই বিকিকিনি করত। ছিল বড় বড় সব খেজুরবাগান। দুপুর গড়িয়ে বিকাল হলেই গাছিরা দল বেঁধে বাঁশ-সরপার তৈরি ঠোঙা কাঁধে চলত মাঠপানে।

এখন আগের মতো বড় বড় খেজুরবাগান আর নেই। রস-গুড়ের আবাদ বাদ দিয়ে অন্য ফসল চাষের দিকে ঝুঁকছেন চাষিরা। তাই রস-গুড়ের সেই রমরমা যুগ ম্লান হয়ে গেছে। তবু কিছু কিছু খেজুরবাগান এখনো আছে। গাছিরাও এখনো গাছ কাটেন। এখনো ওসব এলাকায় শীতের সকাল ম-ম করে তাঁতরস আর গরম গুড়ে গন্ধে শীতের কুয়াশামাখা সকালে কাঁধে কলসিভরা খেজুর রস বয়ে নিয়ে যাচ্ছেন গাছি। শীতকালে দুপুরটা বড্ড ছোট। বেলার সঙ্গে পেরে ওঠা কঠিন। তাছাড়া বিকালে হাট। গুড় বেচতে হবে। তার আগেই গাছ কাটা চাই। গাছিরা তাই দুপুরের ভাতটা কোনো রকমে নাকেমুখে গুঁজে বেরিয়ে পড়েন মাঠে।

বাঁশ-সরপার তৈরি ঠোঙা নিয়ে খেজুরগাছ বাইতে চলেছেন এক গাছি। পিঠে বাঁশ আর খেজুরগাছের সরপা দিয়ে তৈরি ঠোঙা থাকে গাছির। সেই ঠোঙার ভেতর কয়েক রকমের দা, নলি, দড়ি, সুচালো কাঠি, গোঁজ ইত্যাদি থাকে। কোমরে বাঁধা একটা মোটা দড়ি। এই দড়ির সাহায্যেই গাছি নিজেকে গাছের সঙ্গে আটকে রাখেন। এছাড়া থাকে তালগাছের ফালি দিয়ে তৈরি বালিধারা। বালিধারার ওপর বালু দিয়ে দা ঘষা হয়। দা ধার করা বা শানানোর জন্য।

গাছির একজন সহযোগী থাকে। সে রসের ভাঁড়গুলো মুখোমুখি দুই সারিতে সাজায়। তারপর এর মাঝখানে গুঁজে দেয় খড়বিচালি। তারপর তাতে ধরিয়ে দেয় আগুন। আগের দিনের রসের গন্ধ ভাঁড়ের গায়ে লেগে থাকে। শুধু পানি দিয়ে ধুয়ে তা যায় না। কিন্তু আগুন দিয়ে এভাবে ভাঁড় পোড়ালে গন্ধটা চলে যায়।

শীতের শুরুতেই গাছের মাথার এক পাশের পাতা ও সরপা পরিষ্কার করে ফেলা হয়। তারপর সেখানে দা দিয়ে চেঁছে মানুষের চোখের আদলে দুটো চোখের মতো তৈরি করা হয়। দুই গর্তের নিচে নাক বরাবর বসিয়ে দেয়া হয় বাঁশের নলি। নলির ঠিক নিচে গাছের গায়ে তির্যকভাবে পোঁতা হয় বাঁশের গোঁজ। এই গোঁজ পেরেকের মতো কাজ করে। গোঁজের সঙ্গে দড়ির সাহায্যে আটকে দেয়া হয় কলসি। যশোর-কুষ্টিয়া এলাকায় রসের কলসিকে ভাঁড় বলে।

দুদিন পরপর সেই চোখের ওপর ধারালো দা দিয়ে চাঁছেন গাছি। চাঁছার সঙ্গে সঙ্গে বাঁশের নলি বেয়ে ঝরতে শুরু করে রস। বাঁশের এই নলিগুলো সবসময় গাছে লাগানো থাকে।

বিকাল-সন্ধ্যা-রাত মিলিয়ে প্রায় ১৫ ঘণ্টা নলি বেয়ে রস পড়ে ভাঁড়ে। তবু সারা রাতে এক ভাঁড় রস পাওয়া যায় না একটা গাছ থেকে। দু-তিন গাছ মিলিয়ে এক ভাঁড় রস হয়।

ভোরে উঠে গাছিরা মাঠে চলে যান। তখন ঘন কুয়াশায় ঢেকে থাকে প্রকৃতি। গাছির পিঠে থাকে বাঁক। বাঁক হলো চেরা বাঁশের তৈরি একধরনের লাঠি। এর দুই মাথায় দুটো আংটা থাকে। সেই আংটায় দড়ি দিয়ে ঝোলানো হয় রসের ভাঁড়। বাঁকের দুপাশে সমানসংখ্যক ভাঁড় ঝোলানো হয়। তাতে দাড়িপাল্লার মতো ভারসাম্য তৈরি হয়। ভাঁড় বহন করতে সুবিধা হয় এতে। কখনো কখনো ভাঁড়ের সংখ্যা অনেক বেশি। তখন রসের ভারে বেঁকে যায় বাঁক, বেঁকে যায় গাছির শরীর।

রস জ্বালাতে দরকার হয় প্রচুর জ্বালানি। এ জ্বালানির বেশিরভাগটাই জোগান দেয় খেজুরগাছ। মৌসুমের শুরুতেই গাছ কাটার উপযোগী করতে ছেঁটে ফেলতে হয় প্রচুর খেজুরপাতা। সেই পাতাগুলোই শুকিয়ে রস জ্বালানোর কাজে ব্যবহার করা হয়। এছাড়া মাঠের ঝোপজঙ্গল কেটে শুকিয়েও রস জ্বাল দেয়া হয়। অনেক সময় ব্যবহার করা হয় খড়বিচালিও।

জ্বালা হাঁড়িতে রস ঢালার আধঘণ্টা পর ফুটতে শুরু করে। জ্বালা হাঁড়ির ওপর তখন ঘন কুয়াশার মতো জলীয় বাষ্প দেখা যায়। গুড় জ্বালানো দীর্ঘ প্রক্রিয়া। প্রায় তিন-চার ঘণ্টা লেগে যায়। মাঝে মাঝে রসের ভেতরে থাকা ময়লা একত্র হয়ে সাদা ফেনা জমে। উড়কি মালা দিয়ে ফেনা ফেলে দেন গাছি।

ঘণ্টা দুয়েক পর রস অনেকটা লাল হয়ে ওঠে। চারদিকে সুবাস ছড়ায়। সারা গ্রামের বাতাস তখন ভরে ওঠে মিষ্টি গন্ধে। ছোট ছোট ছেলেমেয়ে উড়কিমালা দিয়ে খানিকটা তাঁতরস তুলে নেয় গ্লাসে। ফুঁ দিয়ে চায়ের মতো করে খায় তাঁতরস। ঘণ্টা তিনেক পরে আসে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। রস পুরোপুরি লাল হয়ে ওঠে। গুড় নামানোর জোগাড়যন্ত্র করেন গাছি কিংবা গাছির সহযোগী। গুড় নামানো হয়। গন্ধটা তখন আরো মিষ্টি হয়।

উড়কিমালা দিয়ে কিছুক্ষণ নাড়া হয় গরম গুড়। এরপর আসল কাজ। ‘বীজ মারা’। জ্বালা হাঁড়ির গায়ে খেজুরপাতার ডাঁটা ঘষে ঘষে বীজ মারা হয়। এর ফলে হাঁড়ির গায়ে সাদাটে পেস্ট তৈরি হয়। বীজ মারার ওপরই নির্ভর করে গুড়ের মান। বীজ মারা যত ভালো হবে, গুড়ও তত ঘন হবে। গুড় জমিয়ে পাটালি করতে হলে অনেক বেশি সময় ধরে বীজ মারতে হয়। মেঘলা দিনে শত চেষ্টা করেও বীজ মেরে পেস্ট তৈরি সম্ভব নয়। তাই মেঘলা দিনে একেবারে ঝোলা গুড় ছাড়া জমাট গুড় পাওয়া অসম্ভব। বীজ মারা শেষ হলে উড়কিমালা দিয়ে সাদা পেস্ট গুড়ের সঙ্গে মেশানো করা হয়।

সবশেষে গুড় ঢালা হয় মাটির ভাঁড়ে। এরপর ভাঁড়ের মুখটা ঘন জমাট গুড় দিয়ে বন্ধ করা হয়। তারপর গুড়সহ সেই ভাঁড় চলে যায় হাটে, সেখান থেকে ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে।

আগামী নিউজ/এমটি/এসএম/এনএনআর

আগামী নিউজ এর সংবাদ সবার আগে পেতে Follow Or Like করুন আগামী নিউজ এর ফেইসবুক পেজ এ , আগামী নিউজ এর টুইটার এবং সাবস্ক্রাইব করুন আগামী নিউজ ইউটিউব চ্যানেলে
Small Banner