ঢাকাঃ আনুষ্ঠানিকভাবে বঙ্গভবন ছাড়লেন দেশের ২১তম রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ। বঙ্গভবন থেকে রাজকীয় বিদায়ের পর নিরাপত্তা বলয়ে সদ্য সাবেক রাষ্ট্রপতিকে গাড়িযোগে রাজধানীর নিকুঞ্জে নিজ বাসা ‘রাষ্ট্রপতি লজে’ নিয়ে যাওয়া হয়।
সোমবার (২৪ এপ্রিল) নবনির্বাচিত রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের শপথগ্রহণের মধ্য দিয়ে ২১তম রাষ্ট্রপতি হিসেবে আবদুল হামিদের দায়িত্ব শেষ হয়। পরে দুপুর ১টা ৪০ মিনিটে বঙ্গভবন থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে বিদায় নেন তিনি। গতকাল (রোববার) ছিল রাষ্ট্রপতি হিসেবে আবদুল হামিদের শেষ কার্যদিবস।
এদিকে বঙ্গভবন ছাড়ার আগেই তার নিকুঞ্জের বাসায় পরিবারের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ও অন্যান্য সামগ্রী স্থানান্তর করা হয়। রাস্তায় ফুলের পাপড়ি ছিটিয়ে আবদুল হামিদকে বিদায় জানান বঙ্গভবনের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। বাংলাদেশের ৫২ বছরের ইতিহাসে এই প্রথম কোনো রাষ্ট্রপতির বিদায়ে এমন সংবর্ধনার আয়োজন করা হলো।
এর আগে কোনো রাষ্ট্রপতিকে নিজেদের আয়োজনে বিদায় জানানোর সুযোগ হয়নি বঙ্গভবনের। এবার সেই সুযোগ পেয়ে আগেই বিশাল আয়োজনের প্রস্তুতি নেন কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা। বঙ্গভবনের প্রতিটি বিভাগের পক্ষ থেকে তাকে জানানো হয় ফুলের শুভেচ্ছা। নতুন রাষ্ট্রপতির শপথ ও আবদুল হামিদের বিদায়ী অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন এক হাজারের বেশি অতিথি।
বিদায় অনুষ্ঠানের শুরুতেই আবদুল হামিদকে বঙ্গভবনের ক্রেডেনশিয়াল গ্রাউন্ডে গার্ড অব অনার দেওয়া হয়। পরে বঙ্গভবনের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের উপস্থিতিতে ফুলে সজ্জিত একটি খোলা জিপে ফোয়ারা এলাকা থেকে প্রধান ফটকের দিকে যাত্রা করেন আবদুল হামিদ। এসময় তার গাড়ির সামনে ছিল পুলিশের বিশেষ অশ্বারোহী দল।
তাকে বহনকারী জিপটিতে রশি বেঁধে মূল ফটক পর্যন্ত টেনে নিয়ে যান বঙ্গভবনের কর্মকর্তারা। এসময় দুই পাশে দাঁড়িয়ে ফুলের পাপড়ি ছিটিয়ে রাষ্ট্রপতিকে বিদায় জানানো হয়। মূল আনুষ্ঠানিকতা শেষ হওয়ার পর বিশেষ নিরাপত্তা বাহিনীর (এসএসএফ) তত্ত্বাবধানে বঙ্গভবনের প্রধান ফটক থেকে ভিভিআইপি মোটর শোভাযাত্রায় নতুন ঠিকানায় রওনা দেন আবদুল হামিদ।
সর্বোচ্চ সম্মান ও রাষ্ট্রীয় প্রটোকল অনুযায়ী আবদুল হামিদকে নিকুঞ্জের বাসায় নিয়ে যাওয়া হয়। এরই মধ্যে নিকুঞ্জ এলাকায় নিরাপত্তা জোরদার আর বাইরের মানুষের প্রবেশাধিকার সীমিত করা হয়েছে।
২০১৩ সালে প্রথমে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি এবং পরে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নেন আবদুল হামিদ। এরপর দুই মেয়াদে বঙ্গভবনে ১০ বছর ৪১ দিন সময় কেটেছে তার।
রাষ্ট্রপতির প্রেস সচিব জয়নাল আবেদীন জানান, নতুন রাষ্ট্রপতিকে স্বাগত জানিয়েছেন আবদুল হামিদ। শপথ নেওয়ার পর রাষ্ট্রপতির চেয়ারে বসেন মো. সাহাবুদ্দিন। আর শপথ নেওয়ার আগে নতুন রাষ্ট্রপতি যে চেয়ারে বসেছিলেন, সেখানে বসেন বিদায়ী রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ। এসময় তিনি রাষ্ট্রপতি কার্যালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে নতুন রাষ্ট্রপতিকে পরিচয় করিয়ে দেন।
১৯৯৬ সালে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর নিকুঞ্জ-১ আবাসিক এলাকার দুই নম্বর সড়কে তিন কাঠা জমি পান আবদুল হামিদ। ২০০০ সালের শেষ দিকে সেখানে বাড়ির কাজ শুরু করেন। কয়েক বছর কাজ শেষে তৈরি হয় তিনতলা বাড়ি।
দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি সময় ধরে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পদে আসীন থাকা বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ আবদুল হামিদের জন্ম কিশোরগঞ্জের মিঠামইনে। হাওরাঞ্চলে জন্ম নেওয়া এই মানুষটি ছাত্রলীগে যোগ দেওয়ার মধ্যদিয়ে শুরু করেন তার রাজনৈতিক জীবন। এরপর দেশের জন্য সকল আন্দোলন সংগ্রামে সম্মুখ সারিতে থেকে কাজ করে নিজেকে নিয়ে গেছেন অন্য উচ্চতায়।
মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে অস্ত্র হাতে ঝাঁপিয়ে পড়েন দেশ স্বাধীন করতে। মুক্তিযুদ্ধে অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে আবদুল হামিদকে স্বাধীনতা পদকেও ভূষিত করেছে সরকার। ১৯৫৯ সালে ছাত্রলীগে যোগ দেওয়ার মধ্য দিয়ে তার রাজনৈতিক জীবন শুরু। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে সে সময়ের ময়মনসিংহ-১৮ (বর্তমানে কিশোরগঞ্জ-৪) আসন থেকে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সর্বকনিষ্ঠ সদস্য নির্বাচিত হন আবদুল হামিদ।
১৯৭৩ সালের ৭ মার্চ দেশের প্রথম সাধারণ নির্বাচনে কিশোরগঞ্জ-৫ আসন থেকে নির্বাচিত হন আবদুল হামিদ। ১৯৮৬ সালের তৃতীয় সংসদ নির্বাচন, ১৯৯১ সালের পঞ্চম সংসদ নির্বাচন, ১৯৯৬ সালের সপ্তম সংসদ নির্বাচন, ২০০১ সালের অষ্টম সংসদ এবং ২০০৮ সালের নবম সংসদ নির্বাচনে তিনি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
সপ্তম সংসদে ১৯৯৬ সালের ১৩ জুলাই থেকে ২০০১ এর ১০ জুলাই পর্যন্ত ডেপুটি স্পিকারের দায়িত্ব পালনের পর ২০০১ এর ২৮ অক্টোবর পর্যন্ত স্পিকার হিসেবে সংসদ পরিচালনা করেন আবদুল হামিদ। নবম সংসদে নির্বাচিত হওয়ার পর দ্বিতীয়বারের মতো স্পিকার হন।
দেশের ১৯তম রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমানের অসুস্থতার কারণে ২০১৩ সালের ১১ মার্চ অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পান আবদুল হামিদ। জিল্লুর রহমানের মৃত্যুর পর ২০১৩ সালে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন তিনি। ওই বছরের ২৪ এপ্রিল শপথ নেন দেশের ২০তম রাষ্ট্রপতি হিসেবে। এরপর ২০১৮ সালের ২৪ এপ্রিল তিনি দ্বিতীয় মেয়াদে শপথ নেন।
বাংলাদেশে এত দীর্ঘসময় রাষ্ট্রপতি থাকার রেকর্ড আর কারও নেই। বাংলাদেশের আইনে দুই মেয়াদের বেশি কারও রাষ্ট্রপতি থাকার সুযোগও নেই।
বুইউ