ঢাকাঃ বর্ডার গার্ড বাংলদেশ (বিজিবি) ও ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্সের (বিএসএফ) মহাপরিচালক পর্যায়ের ৫০তম সীমান্ত সম্মেলন শেষ হয়েছে। এবারের সম্মেলনে ১৪ বিষয়ে ঐক্যমতে পৌছেছে দুই বাহিনী। তবে বরাবরের মতো এবারেও সম্মেলনের আলোচনার শীর্ষে ছিল সীমান্ত হত্যা শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনা। বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে হত্যা ও মারধরের ঘটনা শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনতে দুই পক্ষই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পুনরায় প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেছেন। এর বাইরে পারস্পরিক বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক অটুট ও আস্থা বৃদ্ধিতে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণে উভয়পক্ষ সম্মত হয়েছেন।
আজ শনিবার (১৯ সেপ্টেম্বর) রাজধানীর পিলখানায় বিজিবি সদরদফতরে সীমান্ত সম্মেলনের শেষ দিনে আয়োজিত যৌথ সংবাদ সম্মেলনে সর্বমোট ১৪টি সিদ্ধান্তের বিষয়ে জানানো হয়।
নির্ধারিত আলোচনার বাইরেও নানা বিষয়ে উন্মুক্ত আলোচনা হয়েছে, যার মাধ্যমে এবারের সম্মেলকে সফল বলে আখ্যায়িত করেছে দুই পক্ষ।
ঢাকায় অনুষ্ঠিত চার দিনব্যপী এবারের সীমান্ত সম্মেলনে বিএসএফ মহাপরিচালক রাকেশ আস্থানা ও বিজিবি মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মো. সাফিনুল ইসলামের নেতৃত্বে নিজ নিজ প্রতিনিধি দল অংশ নেন।
সম্মেলনে উল্লেখযোগ্য সিদ্ধান্তের মধ্যে রয়েছে-
১. সীমান্তে উভয় দেশের নিরস্ত্র নাগরিকদের হত্যা, আহত, মারধরের ঘটনা শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনার লক্ষ্যে ঝুঁকিপূর্ণ সীমান্তবর্তী এলাকায় যৌথ টহল বৃদ্ধি, জনসচেতনতামূলক কর্মসূচি আরও বেগবান এবং প্রয়োজন মাফিক আর্থ-সামাজিক উন্নয়নমূলক কর্মসূচি গ্রহণসহ সীমান্তে অতিরিক্ত সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণে উভয় পক্ষই সম্মত হয়েছেন।
২. ঝুঁকিপূর্ণ সীমান্তে যৌথ টহল পরিচালনাসহ সমন্বিত কার্যক্রম গ্রহণ এবং সীমান্ত এলাকায় বসবাসকারী নাগরিকদের মধ্যে আন্তর্জাতিক সীমানা আইনের বিধি-বিধান সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টির মাধ্যমে সীমান্তে হামলার ঘটনা শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনতে উভয় পক্ষই সম্মত হয়েছেন।
৩. সমন্বিত সীমান্ত ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা- সিবিএমপির ওপর গুরুত্বারোপ করে বিভিন্ন ধরণের আন্তঃসীমান্ত অপরাধ দমনের লক্ষ্যে ইতিবাচক মনোভাব নিয়ে সিবিএমপি বাস্তবায়ন এবং উভয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী উপকৃত হবে এমন তাৎক্ষণিক ও দরকারি তথ্য বিশেষ করে অধিকতর তদন্তের জন্য আগ্নেয়াস্ত্র চোরাকারবারীদের ডিজিটাল ফটোগ্রাফ উভয় বাহিনীর মধ্যে শেয়ার করতে উভয় পক্ষই সম্মত হয়েছে। উভয় পক্ষই সীমান্তে অপরাধ দমন এবং আন্তর্জাতিক সীমানার অলঙ্ঘনীয়তা বজায় রাখতে অতিরিক্ত সতর্কতা অবলম্বনের আশ্বাস দিয়েছেন।
৪. মানবপাচার ও অবৈধভাবে আন্তর্জাতিক সীমানা অতিক্রম প্রতিরোধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের বিষয়ে উভয়পক্ষ সম্মত হন। উভয় বাহিনীর মহাপরিচালক যার যার দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী মানবপাচারে ক্ষতিগ্রস্তদের যত দ্রুত সম্ভব তাদের উদ্ধার ও পুনর্বাসনের সুবিধার্থে সহায়তা করতেও সম্মত হয়েছেন।
৫. উভয় পক্ষই আন্তর্জাতিক সীমানায় কাঁটা তারের বেড়া কেটে অপসারণ, বেড়ার ক্ষয়ক্ষতিরোধে যৌথ প্রচেষ্টা অব্যাহত এবং নিয়মিত যৌথ টহল পরিচালনা চালিয়ে যেতে সম্মত হয়েছেন।
৬. উভয়পক্ষই অবৈধভাবে সীমানা অতিক্রম, সীমানা লঙ্ঘন থেকে সীমান্তবর্তী জনসাধারণকে বিরত রাখতে সম্মত হয়েছে এবং একই সঙ্গে উভয় বাহিনীর সদস্যদের মাধ্যমে সীমান্তের অলঙ্ঘনীয়তা বজায় রাখার ব্যাপারে আশ্বাস দিয়েছেন।
৭. সাম্প্রতিক সময়ে মানসিক ভারসাম্যহীন ব্যক্তিদের অনুপ্রবেশ, জোরপূর্বক পুশইন নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে মানসিকভাবে ভারসাম্যহীন ব্যক্তিদের জাতীয়তা যাচাই এবং একে অপরের সহযোগিতায় তাদের হস্তান্তর, গ্রহণ প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করতে উভয় পক্ষই সম্মত হয়েছেন।
৮. উভয়পক্ষই পূর্ব অনুমোদন ছাড়া ১৫০ গজের মধ্যে কোনো ধরনের উন্নয়নমূলক কাজ না করার বিষয়ে পারস্পরিক সম্মতি জ্ঞাপন করেছে। উভয়পক্ষই বন্ধ থাকা অন্যান্য উন্নয়নমূলক কাজগুলো যত দ্রুত সম্ভব সমাধানের ব্যাপারে সম্মত হয়েছেন।
৯. যৌথ নদী কমিশনের অনুমোদন অনুযায়ী সীমান্ত নদীর তীর সংরক্ষণে সহায়তা প্রদান এবং অননুমোদিতভাবে অভিন্ন সীমান্ত নদীর তীর সংরক্ষণ কাজ না করতে উভয়পক্ষই সম্মত হয়েছেন।
১০. উভয়পক্ষই বিদ্যমান নীতিমালা অনুসরণ করে বাংলাবান্ধা-ফুলবাড়ী ইন্টিগ্রেটেড চেকপোস্ট ও রিট্রিট সেরিমনি উপলক্ষে দর্শক গ্যালারি নির্মাণে সহযোগিতা করতে সম্মত হয়েছেন।
১১. বিএসএফ মহাপরিচালক সন্দেহভাজন ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে বিজিবি ও বাংলাদেশের অন্যান্য বাহিনীর গৃহীত পদক্ষেপের প্রশংসা এবং বাংলাদেশে ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীর সম্ভাব্য অবস্থান ধ্বংস করতে বিজিবির অব্যাহত সহযোগিতা প্রত্যাশা করেন।
১২. বিএসএফ মহাপরিচালক বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের ১৫০ গজের মধ্যে নতুন ডিজাইনের একসারি বিশিষ্ট কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণের বিষয়ে পয়েন্ট উত্থাপন করেন। এ প্রেক্ষিতে বিজিবি মহাপরিচালক জানান যে, নতুন ডিজাইনের কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণ না করার বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারের সিদ্ধান্ত ইতোমধ্যেই জানিয়ে দেয়া হয়েছে।
১৩. উভয়পক্ষ সীমান্তে অস্ত্র, গোলাবারুদ, বিস্ফোরক দ্রব্য, মাদক, স্বর্ণ এবং জালমুদ্রা পাচার প্রতিরোধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণে সম্মত হয়েছেন। সীমান্তে চোরাচালানী দ্রব্যসহ আটক ব্যক্তিদের সম্পর্কে তাৎক্ষণিক তথ্য এবং উভয় বাহিনীর প্রয়োজন অনুযায়ী প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের প্রতিবেদন বিনিময়ের বিষয়ে উভয় পক্ষ সম্মত হয়েছেন।
১৪. বিজিবি মহাপরিচালক বিএসএফ মহাপরিচালককে আসন্ন পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে বিজিবি এয়ার উইংয়ের দুটি হেলিকপ্টারের অধিকতর ট্রেনিং ও অপারেশনাল ফ্লাইটের বিষয়ে অবহিত করেন এবং যে কোনো ধরনের বিভ্রান্তি বা ভুল বুঝাবুঝি এড়াতে তাকে তার বাহিনীর প্রান্তিক পর্যায় পর্যন্ত অবহিত করার অনুরোধ জানান। তিনি পুনর্ব্যক্ত করেন, এ ব্যাপারে বিজিবি কর্তৃক বিএসএফের মাঠ পর্যায়ের সংশ্লিষ্ট কমান্ডারদেরকে পূর্বেই অবগত করা হবে। বিএসএফ মহাপরিচালক বিজিবি থেকে এ সংক্রান্ত তথ্য প্রাপ্তির পর স্থানীয় বিএসএফ ইউনিটকে এ বিষয়ে নির্দেশ প্রদানের আশ্বাস দেন।
এছাড়াও উভয়পক্ষ বিদ্যমান পারস্পরিক বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক অটুট ও আস্থা বৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণে সম্মত হয়েছেন। বিজিবি ও বিএসএফ উভয় মহাপরিচালক সম্মেলনের ফলপ্রসূ আলোচনা ও সিদ্ধান্ত নিয়ে সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন।
বিজিবি সদর দফতরে (১৬-১৯ সেপ্টেম্বর) বিজিবি-বিএসএফ মহাপরিচালক পর্যায়ে ৫০তম সীমান্ত সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। শনিবার (১৯ সেপ্টেম্বর) সম্মেলনের যৌথ আলোচনার দলিল স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে শেষ হয় এ সম্মেলন।
আগামীনিউজ/জেহিন