1. প্রচ্ছদ
  2. জাতীয়
  3. সারাবাংলা
  4. রাজনীতি
  5. রাজধানী
  6. আন্তর্জাতিক
  7. আদালত
  8. খেলা
  9. বিনোদন
  10. লাইফস্টাইল
  11. শিক্ষা
  12. স্বাস্থ্য
  13. তথ্য-প্রযুক্তি
  14. চাকরির খবর
  15. ভাবনা ও বিশ্লেষণ
  16. সাহিত্য
  17. মিডিয়া
  18. বিশেষ প্রতিবেদন
  19. ফটো গ্যালারি
  20. ভিডিও গ্যালারি

ঝুলবারান্দা কিংবা আমার আছে কান্না!

খান ওয়াহিদুজ্জামান প্রকাশিত: মার্চ ১১, ২০২১, ০৩:০৬ পিএম ঝুলবারান্দা কিংবা আমার আছে কান্না!
ছবি: আগামী নিউজ

ঢাকাঃ বাড়ির পেছনের দিকের নিরিবিলি ঝুলবারান্দার গরাদে (Railing-এ) হাতের ভর দিয়ে কনুইতে মাথা রেখে আমি মন্ত্রমুগ্ধের আকাশের দিকে উদাস ছলোছলো চোখে তাকিয়ে - আমার একাকীত্বের কথা , নিজের ভালোবাসার মানুষ আশেপাশে থাকার পরেও তাকে মনের একান্ত গোপন ও না বলা কথাটা বলতে না পারার ব্যর্থতার কথা ভাবছিলাম আর অনুশোচনায় ভুগছিলাম যে - কেনো তাকে বলতে পারছি না!! 

হঠাৎ সে আমাকে ডাকতে ডাকতে এই নিভৃত ঝুলবারান্দায় এলো এবং হাপাতে হাপাতে বললো - "এই, তুমি এইখানে আর সবাই আমরা তোমাকে সারা বাড়িতে খুঁজে মরছি!" আমি চমকে তার দিকে তাকালাম এবং সাথে সাথেই চোখ নামিয়ে নিলাম- কারণ আমি কখনোই তার দিকে সরাসরি তাকাতে পারি না ! কেনো জানি আমার বুক ধড়ফড় করে কাঁপতে থাকে!

সে একটু সুস্থির হয়ে বেড়া বা গরাদে (Railing-এ) দুই হাতের ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে সামনের দিকে ঝুঁকে - চতুর্দিক দেখছিলো আর বিরক্তির সুরে আমাকে প্রশ্ন করছিলো - "এইখানে কি করছিলে একা একা ভূতের মতো মুখ করে ! ?" - অভিভূতের মতো আমি তার মুখের দিকে তাকালাম এবং তাকিয়ে রইলাম- তার মুখটা অন্য দিকে ঘুড়ানো ছিলো বলে সে আমাকে এখন দেখতে পাচ্ছিলো না কিন্তু আমি শুধু তার মুখের একটা পাশ দেখতে ছিলাম । প্রথম কিছুক্ষণ তার চোখ নাক ও গোলাপী আভামিশ্রিত গালের একপাশ দেখতে পাচ্ছিলাম পরে যখন সে ধীরে ধীরে আমার দিকে মুখ ঘুরিয়ে তাকালো তখন তার পুরো মুখটা দেখতে পেলাম ।
 
সে পুনরায় জানতে চাইলো - "কি ব্যাপার , চুপ করে আছো কেনো ? কি করছিলে এইখানে একা একা এই ভর দুপুরবেলা ?" - আমি উত্তর দিলাম - 'না , এমনি ! কিছু না !' আমি এমনিতেই চুপচাপ স্বভাবের । পেটে বোমা পড়লেও আমার মুখে কথা ফোটে না সেইটা সবাই জানে - তাই সে বেশী প্রশ্ন করে আমাকে ঘাঁটাঘাঁটি করলো না । নরম সুরে জানতে চাইলো - "মন খারাপ কি না ?" কিন্তু আমি উত্তরে কিছুই বলতে পারলাম না ! 
তার নরম আদুরে কন্ঠের স্পর্শে আমি ভেতরে ভেতরে ভেঙে পঢ়ছিলাম আর অভিমানে কাতর হয়ে ভাবছিলাম - সেই মাহেন্দ্রক্ষণ এলো তাহলে - সে কি আমাকে বুঝতে শুরু করলো এতদিনে ? এই নিভৃত নীর্জন সময়ের অপেক্ষাই তো আমি এতোদিন করেছি - যেন তাকে আমার মনের না বলা কথাটি বলতে পারি ! 

এইরম নীরব পরিবেশটাই তো এতদিন আমি মনে মনে চেয়ে এসেছি - যেইখানে শুধু সে আর আমি থাকবো- আর কেউ না! আজ তাহলে সেই সুসময় এলো আমার জীবনে ! আমি সাহস করে তাকালাম তার দিকে - কিছু একটা বলার চেষ্টা করলাম কিন্তু মুখ দিয়ে কোনো কথা বেরুচ্ছে না !! আমি আবেগাপ্লুত হয়ে পড়লাম এবং ছলছল চোখে তার দিকে তাকিয়ে রইলাম- সে আমার কপাল থেকে আগেই হাত নামিয়ে নিয়ে ছিলো - হঠাৎ সে আমার বাম বাহুতে মৃদু চাপ দিয়ে গম্ভীর ও দুশ্চিন্তাগ্রস্থ কন্ঠস্বের জানতে চাইলো - "তোমাকে এমন দেখাচ্ছে কেনো , তোমার কি মন খারাপ ?" তার স্পর্শে আমি কেঁপে উঠলাম - সমস্ত শরীর থরথর করে কেঁপে উঠলো - মনে হচ্ছিলো আমার বাম বাহুটা অবশ হয়ে গেছে , ওইখানে কোনো বোধশক্তি নাই - একেবারে গলে গলে নাই হয়ে যাচ্ছে!

আমি আবার পায়ের দিকে চোখ নামিয়ে নিলাম - চোখ নামানোর আগে একটু দেখতে পেলাম - সে আমার দিকে অদ্ভুদ একটা মায়ার চোখে তাকিয়ে আছে - আমার চোখ ঝাপসা হয়ে আসছিলো মনে হচ্ছিলো এক্ষুণি কেঁদে ফেলবো ! "কিরে , বকুল তুমি এইখানে , আর আমরা সারাবাড়ি খুঁজতাছি !" - হঠাৎ নিচের থেকে বড়ফুপু চিৎকার করে ডেকে আমাকে যেনো বাঁচিয়ে দিলো- আমি ঘাড় ঘুরিয়ে নিচে বড়ফুপুর দিকে তাকালাম । ফুপু পুনরায় চিৎকারের সুরে বললেন - "তুমি এইখানে কি করছো , নিচে আসো ! বেলা তো অনেক হলো , খাবে না ?" আমি মাথা উপরনীচ করে সম্মতি জানালাম । ফুপু অত নীচ থেকে বুঝলো কি না কে জানে ! কারণ , আমরা তিন তলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছি আর ফুপু নিচতলায় মাটির উপরে। 

ফুপু তারপর রোদ আড়াল করতে কপালের উপর একটা হাত রেখে - আবার চেচিয়ে বললেন - "শিশির , তুমি বকুল কে নিয়ে রসুইঘরে খেতে আসো । আর দেরি করো না যেনো , কেমন ?" - বলে , ফুপু যেনো কার ডাক শুনে সাড়া দিতে চটপট ভেতরবাড়ির দিকে চলে যেতে থাকলো।
 
শিশির আমার বাহু থেকে তার হাতটা সরিয়ে নিয়ে - সেই হাতটা একটু উপরে উঠানোর মতো করে - ফুপুর চলে যাবার দিকে তাকিয়ে বললো - "আসছি ।" ফুপু , হাটা পথের ধারে একটা নাড়কেল গাছের 'বাউগরা' পড়ে ছিলো , সেইটা কুড়িয়ে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে স্বগতোক্তি করলো - "এসো এসো , তোমরা চটপট চলে এসো।
 
শিশির এইবার আর আমাকে জিজ্ঞাসা করলো - " বকুল , তুমি কি স্নান করেছো ?" ফুপুর উপস্থিতিতি পরিবেশটা একটু হালকা হয়েছিলো - আর আমিও একটু সহজ হয়ে গিয়েছিলাম - তাই শিশিরের দিকে তাকিয়ে মাথা ওপাশোপাশ করে জানালাম যে - না স্নান করি নাই। 

শিশির , এইবার তাড়া দিয়ে সিঁড়ি ঘরের দিকে ধীরে ধীরে আগাতে আগাতে বললো - "তাহলে চলো নীচে যাই , প্রথমে স্নান সারতে হবে তারপর খাওয়া । আমি আবার স্নান না করে খেতে পারি না ।" 
আমি চুপচাপ তাকে অনুসরণ করে যাচ্ছিলাম । শিশির সিঁড়িতে চলতে চলতে বললো - "তুমি তোমার ঘর থেকে তোয়ালে আর ধোয়া কাপড় নিয়ে নিচে আসো - আমরা স্নান করতে দিঘিতে যাবো , কেমন ? দিঘিতে স্নান করতে খুব ভালো লাগে , তাই না ?" - বলে শিশির আমার দিকে তাকালো - আমি নীরবে ঘাড় নেড়ে সায় দিলাম। 

'আমার এই অসম্ভব নীরবতা'য় শিশির মোটেই বিরক্ত হলো না , কারণ , আমরা যৌথ পরিবারের সদস্য হওয়ায় এবং ছোটবেলা থেকে সে দেখে আসছে আমি এমন মুখচোরা - তাই সে আমাকে বুঝতে পারে । সুতরাং বিরক্ত হবার কোনো কারণ নাই । তাছাড়া , 'আমার এই অসম্ভব নীরবতা'তে সবাই অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। 

০২ -

আমরা একসময় স্নানের পোশাক সহ নিচে এলাম , বসারঘরে সায়ান আর ইমনের সাথে দেখা হলে - ওদের সাথে সৌজন্য বিনিয় করতে গিয়া একটু সময় দিয়েছিলাম - তাইজন্য নিচে আসতে একটু দেরী করে ফেললাম। - শিশির রসুইঘরের সামনে এসে ফুঁপুকে শুনিয়ে বললো- "আমরা দিঘি থেকে একটু স্নানটা সেরে আসি।" - ফুঁপু রসুইঘরের বারান্দায় বসে খাবারগুলা বিভিন্ন আকারের বাটিতে রাখছিলেন পরিবেশনের জন্য- ব্যস্ততার কারণে, সে চোখ তোলার সময়ই পাচ্ছিলেন না। 

বাবা রসুইঘর থেকে একটু বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন - "কি রে , তোরা দুটিতে এখনো স্নান করিস নাই ? এতো বেলা হলো !" শিশির কিছুটা দূরে চলে এসেছিলো - ঘাড় ঘুরিয়ে মামার দিকে তাকিয়ে চেচিয়ে বললো - "না , আমরা কেউই স্নান করি নাই তো! ফুঁপু হঠাৎ বললেন- "না করে থাকলে এখন আর করতে হবে না , অনেক বেলা হয়েছে , খেয়ে নে তোরা । সবাইকে খাইয়ে দিই - তারপর আমার অন্য অনেক কাজ আছে । তাছাড়া , প্রতিদিন বিকেলে তোরা যেইরম হুটুপুটি করিস- তাতে এই গরমে একেবারে ঘেমে নেয়ে উঠিস - তখন আবার গা ধুতে হয় - তার চাইতে এক কাজ কর , সন্ধ্যার আগে আগে একেবারেই স্নানটা করে নিস , কেমন ? গরম কালে সন্ধ্যায় স্নান করলে কিচ্ছু হবে না নে! অগত্যা , আমরা দুইজনেই উঠানের তারে স্নানের কাপড় ঝুলিয়ে রেখে , কলতলা থেকে সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে - রসুইঘরের বারান্দায় উঠে এলাম।

গরমের কারণে রসুইঘরের উঠানের দিকের বেড়া খুলে সরিয়ে রাখা হয়েছে - যেনো হাওয়া ঢুকতে পারে , কিন্তু তার পরিবর্তে মোটা গুনার জাল লাগিয়ে দেয়া হয়েছে - যেনো চট করে কোনো কুকুর , বেড়াল সহ অন্যান্য পশুপাখি ঢুকতে না পারে। 

তাই রসুইঘর আর উঠানের মাঝে কোন আড়াল নাই - সবখান থেকেই সবখানটা স্পষ্ট দেখা যায় , রসুইঘরের বারান্দার রান্নার জায়গা থেকে থেকেও তাই সবাইকে দেখা যাচ্ছিলো - আমরা দুইজনে পিরিতে বসলে , দুইটা বড় থালায় গাওয়া ঘি-এর ছিটা দেয়া ভাত ও কয়েকটা বাটিতে করে - মাংস , সবজী , আলুভাজা , মুগের ডাল , কুমড়াফুল ভাঁজা , চাটনী , ঘরে পাতা দই , পায়েস - ইত্যাদি একে একে পরিবেশন করা হলো আমাদের সামনে। 

ফুঁপু বারান্দা থেকেই আমার দিকে চিন্তিত মুখে তাকিয়ে থেকে- বাবাকে উদ্দেশ্যে করে ব্যাকুলতা মেশানো কন্ঠে বললো- "দাদা, তুমি কি বকুলের দিকে খেয়াল করে দেখেছো , দিনদিনে ও কেমন রোগা হয়ে গেছে , দেখেছো মুখটা কেমন শুকিয়ে আমসি হয়ে যাচ্ছে ?" ফুঁপুর কথায় রসুইঘরের সবগুলা মানুষের কয়েক জোড়া চোখ আমার দিকে মনোনিবেশ করলো - দেখে, আমি একটু বিব্রত হয়ে পড়লাম!
 
বাবা কিছু বলার আগেই - মা বিব্রত কন্ঠে বললো - "সে আর বলতে ! শুধু কি শুকাচ্ছে ? ওর গায়ের রঙটাও কেমন যেনো দিনেদিনে ময়লা হয়ে যাচ্ছে ! - আর হবেই বা না কেনো ! সে তো তেমন কিছুই খেতে চায় না , দিদি।
গতো কয়েক বছর ধরে , সেই উচ্চমাধ্যমিকে পড়ার সময় থেকেই - তার খাওয়া একটু একটু করে কমে যাচ্ছে । আগে কতকিছু খেতো। না ! ? - দিদি তুমি তো জানোই। - কিন্তু যতোই বড়ো হচ্ছে ততোই তার খাওয়া কমছে - এবং কথার পরিমানও কমছে।
 
পাশ থেকে টগর সহাস্যে বলে উঠলো - "বকুলকে শুটকি বানিয়ে বাজারে বিক্রি করবো - হিহিহি !" একটা হালকা হাসির রোল পড়লেও - আমি একটু লজ্জায় ও আতঙ্কে মিইয়ে গেলাম। কারণ , আমি বুঝতে পারছি এখন আমাকে সবাই বেশী বেশী খাওয়া জন্য সাধাসাধি শুরু করবে ! আমি এমনিতেই খেতে পারি না - তার উপরে কেউ সাধাসাধি করলে - আরো খেতে পারি না। 

০৩ -

খেতে পারি না কি আর সাধে ! যখন থেকে শিশিরর প্রেমে পড়েছি এবং বুঝতে পেরেছি তাকে ছাড়া আমি আর দ্বিতীয় কাউকে ভালো বাসতে পারবো না এবং কারো সাথেই জীবন কাটাতে পারবো না , তখন থেকে - সেই গোপন প্রেমের কথা বলতে না পারার অব্যক্ত যন্ত্রণাই তো আমাকে জীবন্ত লাশ বানিয়ে ফেলেছে । এখন আমি বেঁচে আছি যেনো মরার মতো! ঘুরছি ফিরছি খাচ্ছি দাচ্ছি , বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠে যাচ্ছি , পড়াশোনা করছি ইত্যাদি ইত্যাদি সবই করছি - তবে শুধু করার জন্য করা - ভেতর থেকে কোনো তাগিদ পাচ্ছি না। এর মধ্য থেকে শুধু পড়াশোনাটাই একটু বেশী মনোযোগ দিয়ে করছি - অন্য আর কিছুর চাইতে - কারণ , পরীক্ষায় অত্যন্ত ভালো ফলাফল না করলে আমার মুক্তি নাই ! কেন মুক্তি নাই ? 

বলছি- তার আগে একটু বলে নেই যে - উচ্চমাধ্যমিকের পর আমি শিশিরের প্রতি এতো দূর্বল হয়ে পড়েছিলাম যে - ওই সময়টা আমি তার জন্য খুব কাতর ছিলাম - তাইজন্য পড়াশোনায় মন ছিলো না। বই সামনে ধরে রেখেও সারাক্ষণ শুধু তার চিন্তা করতে থাকতাম - কিছুতেই পড়ায় মনোসংযোগ করতে পারতাম না। সারাটা দিন আর সারাটা রাত শুধু শিশিরকে নিয়ে কল্পনার জাল বুনে যেতাম- আমি বরাবরই খারাপ ছাত্র ছিলাম না - খুব একটা ভালো ছাত্র না হলেও। কিন্তু তাই বলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারবো না - এইরম মেধাহীন কখোনোই ছিলাম না। কিন্তু শিশিরের প্রেমে পরে আমি আমার ছাত্র জীবনের সর্বনাশ করে ছাড়লাম। পড়াশোনা একেবারে লাটে উঠলো। সারাদিনরাত পড়ার আসনের সামনে বইখাতা নিয়া বসে থাকতাম - অথচ ভাবতাম শুধু শিশিরের কথা। 

মনে মনে তার সাথে খাচ্ছি দাচ্ছি ঘুরছি শুচ্ছি, সংসার করছি, পাহাড় সমুদ্রে বনে বাদারে ঘুরতে যাচ্ছি ইত্যাদি অবাস্তব ও উদ্ভট কল্পনায় আমার উর্বর মস্তিষ্ক ব্যস্ত রইলো আর পড়াশোনা গোল্লায় গেলো - সবাই ভাবছে আমি ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতি নিয়া ব্যস্ত আছি - কিন্তু আসলে , আমি কি নিয়া যে ব্যস্ত - সে তো আমি নিজেই জানি । কিন্তু এও জানি যতোই তাকে নিয়া কল্পনার জাল বুনি না কেনো - বাস্তবে কখোনোই তা সম্ভব হবার না । তাই কল্পনাতেই তাকে আরো বেশী করে আকরে ধরতাম। 

শেষমেষ যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে না পেরে - পরিবারকে আতঙ্কগ্রস্ত করে ও আত্মীয়স্বজনকে চমকে দিয়ে , কোনো বিষয়েই ভর্তির সুযোগ পেলাম না- তখন নিজের ধ্বংসলীলা অনুভব করে আমার নিজেরো সম্বিত ফিরে এলো। এবং আমি যখন আবিষ্কার করলাম যে - আমি অধঃপতনের অতল তলায় তলিয়ে যাচ্ছি - তখন একদিন ঘরের দরজা জানালা আটকে বাড়ির সবাইকে অস্থিরতার মধ্যে রেখে হাউমাউ চিৎকার করে অনেকক্ষন কাঁদতে থাকলাম- সেইদিন আমাকে দরজার কপাট ভেঙে বের করে না আনলে কি যে করতাম আমি নিজেই জানি না! কাঁদতে কাঁদতে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম আত্মহত্যা করবো।

হয়তো চাকু দিয়া হাতের রগ কেটে ফেলতাম- যখনই সেই অশুভ কথাগুলো ভাবছিলাম - তখনই বাড়ির লোকজন  অন্তর্যামীর মতো আমার মনের কথা হয়তো বুঝে ফেললো এবং ঘরের দরজার একপাট ভেঙে হুরমুর করে ঘরে ঢুকে -আমাকে জড়িয়ে ধরে ঢুকরে কেঁদে পড়লো । - তা না হলে, কি যে হতো - কে জানে!! তারপর ধীরে ধীরে একটু একটু করে সুস্থির হলাম। 

যাইহোক, একদিন নিজেকে বোঝালাম - শিশিরকে যেইহেতু পাবো না - আর বাড়ির লোকেদের মুখের দিকে চেয়ে আত্মহত্যাও করতে পারবো না - তাই আমাকে দেশ ছাড়তে হবে । শিশিরের কাছ থেকে অনেক দূরে চলে যেতে হবে । নাহলে আমি বাঁচতে পারবো না । শিশির সামনে থাকলে - ওকে না পাবার বেদনা ও যন্ত্রণা বুকে বেশী করে বাজবে আর আমি একটু একটু করে নিঃশেষ হতে থাকবো। 

সুতরাং দেশ ছাড়ার একমাত্র উপায় হলো বেশী করে পড়াশোনা করা আর ভালো বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি হয়ে - সেখান থেকে উচ্চতর সনদ নিয়ে এবং সরকারী বৃত্তি পাওয়া। একটা বৃত্তি যদি পাই, তবে উচ্চতর গবেষনার কাজে দেশের বাইরে চলে যেতে পারবো এবং তখন আর শিশিরের চোখের সামনে থাকতে হবে না। ওর কাছ থেকে দূরে থেকেই আমি অন্তত এখনকার থেকে ভালো থাকবো বলে মনে হচ্ছিলো। 

০৪ - 

রসুইঘরে হঠাৎ একটা খুনসুটি লাগায় আমার ভাবনায় ছেদ পড়লো, টগর নিশাতের থালা থেকে তার অতি প্রিয় কুমড়া ফুল ভাজা চুরি করে খেয়ে ফেলেছে, তারপর নিশাতও মৃদু চিৎকার করে থাবা দিয়ে টগরের থালা থেকে মুরগীর রান নিয়ে নিলো - এই তো লেগে গেলো দুইজনের খুনসুটি । কাউকেই থামানো যাচ্ছে না - ওদের খাবার কাড়াকাড়ি দেখে অন্যেরাও মজা পেলো। 

আমার হঠাৎ একটা কথা মনে পড়ায় শিশিরের দিকে তাকালাম, তাকিয়েই বুকটা 'ছ্যাৎ' করে উঠলো - কারণ , শিশিরও আমার দিকে তাকিয়ে আছে - আমি , মাথা নিচু করে ফেললাম । আমার মনে পড়লো, শিশিরও মাঝেমাঝে আমার তরকারীর বাটি থেকে দুষ্টামী করে এটাওটা তুলে নিয়ে খেয়ে ফেলতো । যদিও আমি প্রতিফল সরূপ কোনো খুনসুটি করতাম না, শুধু মুচকি হাসতাম।
 
শিশিরের নাকের ডগায় সবসময়েই বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে আজও ব্যতিক্রম হয় নাই - তার নাকের ডগায় কয়েক বিন্দু সুক্ষ ঘাম ছিলো , আমি কল্পনায় তার পাশ গিয়ে ডান হাতের বুড়ো আঙ্গুল দিয়ে তার নাকের ঘাম মুছিয়ে দিয়ে ঘামে ভেজা আঙুলটাকে তার গাল ছুঁইয়ে চিবুকের কাছে নিয়ে এলাম এবং হঠাৎ আমি সম্বিত ফিরে পেয়ে নিজেকে সামলে নিলাম আর শিশিরের মুখ থেকে চটকরে চোখ সরিয়ে নিতে গিয়ে তার চোখে চোখ পড়ে গেলো- আমি সতর্কভাবে চতুর্দিকে একটু তাকিয়ে দেখে নিলাম আর কেউ ব্যাপারটা টের পেলো কি না । দেখলাম না , সবাই খাওয়া নিয়ে ব্যস্ত । আমি যতটুকু পারলাম খেয়ে - অন্যদের খাওয়া শেষ হবার অপেক্ষা করতে করতে এঁটো হাত নিয়ে বসে রইলাম- কিছুক্ষণ পর মা ব্যাপারটা খেয়াল করায় বললেন, "কি রে, ভালো খেয়েছো ? তোমার ভালো লেগেছে খেতে ?" আমি বললাম 'হুম, ভালো খেয়েছি।
'
মা , আমাকে আরেকটু খাবার নিতে সাধলেন - 'উহু ! আমার পেট ভরে গেছে বলায়' - তিনি বললেন -  "তাহলে এঁটো হাত নিয়ে বসে আছো কেনো- কলতলায় গিয়ে হাত ধুয়ে ফেলো!" আমি উঠে হাত ধুতে কল তলায় গেলাম। মধ্যাহ্নভোজের পর বিছানায় গড়াগড়ি করা আমার ভালো লাগে না - তাইজন্য পড়ার আসনে বই নিয়ে বসে পড়ায় মনযোগ করার চেষ্টা করলাম কিছুক্ষণ। তারপর  দুপুরটা একটু পড়ন্ত হতেই শোবার ঘর থেকে বেরুলাম । দোতলায় ভতরের দিকের একপাশে একটা ঝুলবারান্দা আছে , সেখানে এসে বসলাম। একা একাই বসে আছি - আর কেউ নাই ঝুলবারান্দায়। 

দালানের এই পাশটা উঠানের একপাশে , চটকরে কারো চোখে পড়ে না। তবে উঠেনের মাঝামাঝি এলে এই ঝুলবারান্দাটা স্পষ্ট দেখা যায়। অনেকসময় উঠানে কোনো আনন্দের ব্যবস্থা থাকলে হইহট্টগোল এড়িয়ে থাকা আমি এই ঝুলবারান্দা থেকেই সেসব দেখি। এই যেমন - এখন উঠানের আরেক পাশের চাতালে বসে অনেকেই আড্ডা দিচ্ছিলো এবং হৈহুল্লোর করছিল - আমি এখান থেকেই তাদের হাসির উচ্চশব্দ , কলরব ও কথার কলকাকলী শুনতে পাচ্ছিলাম। কিন্তু ওইসব হাসিঠাট্টা কিছুতেই আমাকে আকর্ষণ করছিলো না - কারণ , আমার মনে এতো সুখ নাই যে হাস্যরস করবো। আমার না পাওয়ার যন্ত্রণা নিয়েই আমি একা থাকতে চাই। এই পৃথিবীটা তোমাদের । আর তোমাদের পৃথিবীতে তোমরা পাওয়ার আনন্দে ঝলমল করছো, আনন্দ করছো। কিন্তু আমি ? আমি কেনো আনন্দ করবো? আমার কি পাবার আছে ? কিছুই না। তাহলে ? কিছু না পাওয়ার যন্ত্রণার মাঝে কোনো আনন্দ আসে না। 

০৫ - 

আজ আট বছরের মতো একজনকে ভালো লেগেছে আর পাঁচ বছরের মতো হতে চললো চরমভাবে তার প্রেমে পড়েছি - বলা যায় একেবারে হাবুডুবো খেয়ে মরছি - কিন্তু মুখে বলতে পারছি না। কি করে বলবো ? আমাদের ভালোবাসা কি কেউ কি মেনে নিবে ? নিবে না । সমাজ তো দূরে থাক আমাদের পরিবারই তো মেনে নিবে না। আর তার চাইতেও বড় কথা হলো - যাকে ভালোবেসেছি সেই কি মেনে নিবে!? যাকে, গত আট বছর ধরে তিলে তিলে একটু একটু করে বুকের মধ্যে ধারন করেছি - সারাদিনমান যার ধ্যানজ্ঞান করে সময় পার করছি , যাকে নিয়ে কল্পনার লাগাম ছেড়ে দিতে পারি , কল্পনায় যাকে নিয়ে একের পর এক দৃশ্যপট, একের পর এক কাহিনী তৈরী করছি, স্বপ্ন সাজিয়ে যাচ্ছি - স্বয়ং সেই কি মেনে নেবে আমার এই নিষ্কলুষ ভালোবাসা? নাকি , শোনার পর ঘৃনায় বিরক্তিতে কুকরে গিয়ে বমি করে দেবে ? - নর্দমা কিংবা বিষ্ঠা দেখলে মানুষরা যা করে আর কি! তাহলে - আমি কিভাবে বলবো যে - তাকে আমি ভালোবাসি ! ? আমার ভালোবাসা যদি তার কাছে সেইরম বিরক্তিকর ঠেকে তবে তো না বলাই ভালো! ভাবতে ভাবতে আমার চোখ জলে ভরে গেলো - দুইভ্রু আর কপাল কুচকে আমি আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলাম। 

বসে বসে কল্পনায় পুনরায় শিশিরকে ভাবা শুরু করলাম। তৈরী করে চললাম একটা দৃশ্যপট - রসুই ঘরে বসে যেইরম ভাবছিলাম , শিশিরের নাকের ঘাম মুছিয়ে দেয়া , সেইখান থেকে শুরু করলাম - তার মুখটা আমার দিকে ফিরিয়ে এনে আঙুল দিয়ে তার ঠোঁটের উপর বোলাতে বোলাতে মন্ত্রমুগ্ধের মতো তার ঠোঁটের দিকে আমার ঠোঁট এগিয়ে নিচ্ছিলাম এবং সে আমার আঙুল তার মুখের ভেতরে নিয়ে চুষতে চুষতে একটা হালকা কামড় বসিয়ে দিলো - আমি ছটিফটিয়ে উঠলাম- দেখলাম - আমি এতোটাই বিভোর হয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে মনে মনে স্বপ্ন দৃশ্য কল্পনা করছিলাম যে - টের পাইনি কখন শিশির আমার পাশে এসে দাঁড়িয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রয়েছে এবং আমাকে ডাকছে "এই যে বকুল , কোথায় হারিয়ে গেলে ?" - তার ডাকে সম্বিত ফিরে পেয়ে তার দিকে তাকালাম এবং দেখলাম সেও একই ভাবে আমার দিকে তাকিয়ে আছে - আমি একটু লজ্জিত হলাম , লজ্জায় নাকের দুই পাশটা একটু জ্বালা করে উঠলো- এইবার আমি সরাসরি তার দিকে ব্যকুলভাবে তাকালাম এবং আবারো কল্পনার দেশে হারিয়ে গেলাম - পুরানো কথা মনে পড়ছিলো- সেই কতবছর আগে - এক্কেবারে কিশোর বয়সে থেকে তাকে ভালো লাগতে শুরু করেছিলো এবং তার প্রেমে ভেঙে পরেছিলাম (অর্থ্যাৎ Crush খেয়েছিলাম) - তারপর থেকে আমার মনটা জুরে শুধু সে আর সে - আর কেউ সেইখানে ঢুকতেই পারলো না! 

কিন্তু প্রেমে পড়ার পর থেকে আজ পর্যন্ত তাকে মুখফুটে বলতেই পারলাম না ! কিন্তু আজকে যে আর কিছুতেই নিজের মনের কথা চেপে থাকতে ইচ্ছা করছে না । তাকে আমার ভালোবাসার কথা বলে , তার কাছে নিজেকে ধরা দিতে খুব ইচ্ছা করছে - হঠাৎ মনে হলো : যে করেই হোক তাকে আজ বলতেই হবে - আমি আর পারছি না - এই অপ্রকাশিত প্রেমের ভার আমি আর সইতে পারছি না ! যন্ত্রণার বিষে নীল হয়ে আছি - 

আজ যতো যাই হোক - লজ্জার মাথা খেয়ে হলেও তাকে মুখফুটে বলতেই হবে - না হলে আমি দমবন্ধ হয়ে বুকফেটেই মরে যাবো! হয় এস্পার না হয় ওস্পার - যা হয় হোক - একটা কিছু তো হবে। যদি তাকে মুখফুটে না বলি তবে সে বুঝবে কি করে যে তাকে আমি ভালোবাসি! কি করে সে বুঝবে যে - সারাদিন সারারাত ধরে আমি শুধু তার ধ্যান করে যাই ! 

০৬ - 

আচ্ছা , মুখফুটে বলতেই হবে কেনো ভালোবাসি!? শিশির কি কিচ্ছু বোঝে না ! এতোটাই নির্বোধ কি সে ? সে যে এতো এতো পড়াশোনা করেছে বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চতর পড়াশোনা করে সর্বোচ্চ সম্মানিত সনদ পেয়েছে এবং এখন গবেষনা করছে - এতো বুদ্ধিমান একটা মানুষ কি আমার মতো ছোট্ট একটা মানুষের কথা বুঝতে পারছে না! ? আশ্চর্য! এইটা কিভাবে সম্ভব! 

হঠাৎ আকস্মিক তার হাতের তালু এসে আমার কপালের উপর পড়লো - তার উষ্ণ ছোঁয়া পেয়ে আমি একটু থরথরিয়ে কেঁপে উঠলাম। সে বললো - "তোমার কি শরীর খারাপ ? মানে জ্বরটর কিছু আসে নাই তো ? তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে তুমি ভেতরে ভেতরে প্রচণ্ড অসুস্থ কিন্তু বাইরে কিছু প্রকাশ করছো না!"
 
তারপর একটু থেমে কি যেনো একটা ভেবে নিয়ে পুনরায় চিন্তিত মুখে বললো - "আচ্ছা, দুপুরে খাবার সময়েও তোমাকে এইরম অসুস্থ মনে হয় নাই ! যদিও খাবারের আগেও তোমাকে এইরম অসুস্থ লাগছিলো - কিন্তু পরে তো আবার সব ঠিক হয়ে গিয়েছিলো।  তা, এখন আবার কি হলো!? 

শিশিরের নরম কাতর সুরে এইবার আমি নিজের আবেগকে ধরে থাকতে পারলাম না , হঠাৎ আমার কি যে হলো - ঝুলবারান্দার বেড়া বা গরাদে ভর দিয়ে চিৎকার আর হাউমাউ করে এক বুকফাঁটা আর্তনাদে কেঁদে উঠলাম ! শিশির আচমকা চমকে থতমত খেয়ে গেলো। সে ঠিক বুঝতে পারছিলো না - কি হলো আর কি করবে এখন । হঠাৎ তার চোখেও জল ভরে এলো। 

আর আমি দুই হাতের মুঠি দিয়ে সজোরে বেড়া বা গরাদ ধরে, গরাদের সাথে আমার নিজের কপাল ঠেকিয়ে চিৎকার করে ডুকরে ডুকরে কাঁদছি, কি যে এক বুকফাটা আর্তনাদ বুকের গভীর থেকে বেরিয়ে আসছে আমি আর নিজেকে কিছুতেই সামাল দিতে পারছি না- আমি জানি সে আমাকে পছন্দ করে - কিন্তু সেই পছন্দ তো আত্মীয়তার জন্য - আমার বাবা আর তার মা - তারা দাদা ও দিদি বলে - আমদের সম্পর্কটা তুত সম্পর্ক - তাইজন্য সে আমাকে স্নেহ করে - কিন্তু সেইটা তো আর ভালোবাসা না । তাহলে ? সুতরাং তাকে  কথাটা বলে নিজেকে আর ছোট করতে পারবো না কিছুতেই - এইসব ভেবে আবারো আমি বুকফাটা চিৎকারে কেঁদে উঠলাম-

কারণ , আমি বুঝে গেছি - আমি আজও তাকে কথাটা বলতে পারবো না। কারণ, কথাটা যে মুখ ফুটে বলার মতো না !! তাই আজও আমি কিছুই বলতে না পেরে কাঁদতে থাকলাম। আর শিশির আমার পিঠের উপর একটা হাত দিয়ে আমার পেছনে অসহায়ের মতো ঠায় দাঁড়িয়ে লইলো।

 লেখক: সাহিত্যিক, কলামিষ্ট

আগামীনিউজ/প্রভাত

আগামী নিউজ এর সংবাদ সবার আগে পেতে Follow Or Like করুন আগামী নিউজ এর ফেইসবুক পেজ এ , আগামী নিউজ এর টুইটার এবং সাবস্ক্রাইব করুন আগামী নিউজ ইউটিউব চ্যানেলে
Small Banner