
ঢাকাঃ ‘ঘর-দুয়ার আজ বাউল যেন শীতের উদাস মাঠের মতো/ ঝরছে গাছে সবুজ পাতা আমার মনের-বনের যত- উন্মনা’–কাজী নজরুল ইসলাম।
শীতকাল যেমন আনন্দময়, তেমনি এটি নিয়ে আসে নানা বিপদ-বালাই। এ সময়ে একদিকে শীত এলে জমে বাহারি পিঠাপুলির উৎসব, বনভোজনের আয়োজন, শীতের রঙিন পোশাক তো আছেই। সেইসঙ্গে শীত এলেই বেড়ে যায় রোগ ব্যাধি। শিশু থেকে বৃদ্ধ– সবার জন্য শীতের সঙ্গে সঙ্গে আসে সর্দি, কাশি, হাঁচির মতো নানা রোগ। শ্বাসকষ্ট, অ্যালার্জিজনিত রোগেরও প্রকোপ বাড়ে শীতে। এই অবস্থা সামাল দিতে শীতের সময় গরম কাপড় পরা, শীতের বাতাস এড়িয়ে চলার পরামর্শ দিচ্ছেন চিকিৎসকেরা। আগুন পোহাতেও সতকর্তা অবলম্বন প্রয়োজন।
শীতের সময় কমন অসুখ হলো সর্দিজ্বর, কাশি। এ ছাড়া নিউমোনিয়া, শ্বাসকষ্ট বা অ্যাজমা, অ্যালার্জি, চোখ ওঠা, ডায়রিয়া, খুশকি, খোসপাঁচড়া বা চর্মরোগ প্রভৃতিরও প্রকোপ বেশি দেখা দেয়।
সর্দি-কাশি-জ্বর
সর্দি-কাশি-জ্বর বা কমন কোল্ড শীতের সময়কার একটি সাধারণ রোগ। সর্দিজ্বর দেহের শ্বাসনালির ভাইরাসজনিত এক ধরনের সংক্রমণ। ঋতু পরিবর্তনের সময় এ রোগ বেশি দেখা যায়। রোগ প্রতিরোধক্ষমতা যাদের কম তাদের এ রোগ বেশি হয়। হাঁচি-কাশির মাধ্যমে এসব রোগ একজনের শরীর থেকে অন্যজনের শরীরে ছড়ায়। সর্দিজ্বর হলে প্রথমে নাকে ও গলায় অস্বস্তি লাগে, হাঁচি হয়, নাক দিয়ে অনবরত পানি ঝরতে থাকে। নাক বন্ধও থাকতে পারে। মাথাব্যথা, মাথা ভারী বোধ হওয়া, শরীরে ব্যথা, জ্বর, গলাব্যথা প্রভৃতি উপসর্গও দেখা যায়।
সর্দি-কাশি-জ্বর প্রতিরোধে করণীয় হলো :
নিউমোনিয়া
এটি একটি মারাত্মক অসুখ। নিউমোনিয়ায় শিশু ও বৃদ্ধরা বেশি ভোগে। পৃথিবীব্যাপী পাঁচ বছরের নিচের শিশুমৃত্যুর অন্যতম কারণ নিউমোনিয়া। বাংলাদেশেও শিশুমৃত্যুর প্রধান কারণ এ রোগটি। যদিও এটি প্রতিরোধযোগ্য এবং চিকিৎসার মাধ্যমে নিরাময়যোগ্য একটি রোগ, তথাপিও মৃদু বা হালকা নিউমোনিয়া থেকে জীবনহানিও হতে পারে।
নিউমোনিয়া থেকে বাঁচতে কিছু করণীয় হলো :
অ্যাজমা
হাঁপানি বা অ্যাজমাজাতীয় শ্বাসকষ্টের রোগ শুধু শীতকালীন রোগ নয়, তবে শীতে এর প্রকোপ অনেকাংশে বেড়ে যায়। অ্যাজমা একবার হলে এর ঝুঁকি মোকাবেলা করতে হয় সারা জীবনই। তবে অ্যাজমাকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারলে জটিলতা বা ঝুঁকি থাকে না বললেই চলে। এ জন্য কিছু করণীয় হলো :
চর্মরোগ
শীতকালে বাতাসের আর্দ্রতা কম থাকে। শুষ্ক বাতাস ত্বক থেকে শুষে নেয় পানি। ফলে ত্বক হয়ে পড়ে দুর্বল। ত্বকের ঘর্মগ্রন্থি ও তেলগ্রন্থি ঠিকমতো ঘাম বা তৈলাক্ত পদার্থ তৈরি করতে পারে না। এতে ত্বক আস্তে আস্তে আরো শুষ্ক, ফাটল ধরে ও দুর্বল হয়। একসময় ত্বক ফেটে যায়। শীতের সময় নানা ধরনের চর্মরোগ হতে পারে। বিশেষ করে ঠোঁট, হাত ও পায়ের ত্বকে দেখা দেয় চুলকানি, একজিমা, স্ক্যাবিস, চর্মরোগ প্রভৃতি। এ ছাড়া মাথায় প্রচুর খুশকি দেখা যায়। এসব থেকে পরিত্রাণ পেতে করণীয় হলো—
অলিভ অয়েল ত্বকে আলাদা আস্তর তৈরি করে বলে ঠাণ্ডাজনিত সমস্যা থেকে রেহাই পাওয়া যায়। শীতের সময় তাই অলিভ অয়েল বা লুব্রিকেন্টজাতীয় কিছু ব্যবহার করুন।
নাক-কান-গলার অসুখ
এসব সমস্যাও শীতে বাড়ে। এসব রোগে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয় নবজাতক, শিশু, বৃদ্ধ ও ধূমপায়ীর। শীতকালে নাকের দুই পাশের সাইনাসে ইনফেকশন দেখা দেয়, একে বলে সাইনোসাইটিস। কারো সাইনোসাইটিস দেখা দিলে নাকের দুই পাশে ব্যথা ও মাথাব্যথা হতে পারে। অ্যালার্জি, ঠাণ্ডা এবং ইনফ্লুয়েঞ্জার মতো সমস্যাগুলো থেকে এই রোগের প্রকোপ দেখা দেয়। কারো যদি অ্যালার্জি থাকে, সে ক্ষেত্রে জেনে নিতে হবে অ্যালার্জির কারণ। যাতে সতর্ক হয়ে তিনি নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন। পাশাপাশি ধূমায়িত এবং দূষিত পরিবেশ পরিত্যাগ করে চলা, ধূমপান পরিত্যাগ করা, ঘুমানোর সময় মাথা উঁচু রাখা (যাতে সাইনাস নিজে থেকেই পরিষ্কার হতে পারে), নাকে খুব জোরে আঘাত লাগতে না দেওয়া ইত্যাদি বিষয়ে খেয়াল রাখতে হবে।
যাঁদের গলা ব্যথা, স্বরভঙ্গ, কণ্ঠনালির নানা সমস্যাসহ টনসিলের প্রদাহ বা টনসিলাইটিস রয়েছে, তাঁরা লবণ মেশানো হালকা গরম পানি দিয়ে গড়গড়া করলে আরাম পাবেন। ঠাণ্ডা পানি পরিহার করে কুসুম গরম পানি ব্যবহার করুন এবং গলায় গরম কাপড় বা মাফলার জড়িয়ে রাখুন। সেই সঙ্গে মাউথওয়াশ দিয়ে কুলি করলে ভালো থাকা যায়। জ্বর থাকলে প্যারাসিটামল ও সর্দি-কাশি থাকলে অ্যান্টিহিস্টামিন সেবন করা উচিত।
বাতব্যথা
আর্থ্রাইটিস বা বাতের সমস্যা শীতের সময় বেড়ে যায়। মূলত বয়স্কদেরই এ সমস্যা হয় বেশি। বিশেষ করে রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস বা এনকাইলোজিং স্পন্ডিওলাইটিস, স্পন্ডাইলো আর্থ্রাইটিস, রি-অ্যাকটিভ আর্থ্রাইটিস, সোরিয়াসিটিস, অস্টিও আর্থ্রাইটিস রোগীদের শীতের সময় চলাফেরা বা মুভমেন্ট কম হয় বলে ব্যথার প্রকোপ বেড়ে যায়। বাতব্যথা প্রতিরোধে করণীয় হলো—
শীতের রোগের প্রাদুর্ভাবের বিষয়ে হাজারীবাগ সরকারি বহিঃবিভাগ সেবাকেন্দ্রের মেডিক্যাল অফিসার ডা. নুশরাত মোমেনা বলেন, ‘শীতের সময় শিশুদের ব্রংকিওলাইটিস রোগের প্রকোপ বাড়ে। নিউমোনিয়ার ঝুঁকি বাড়ে। বড়দের কমন রোগ হচ্ছে সর্দি, হাঁচি, কাশি, জ্বর জ্বর ভাব। এসময় ডায়রিয়ার সমস্যাটা প্রকট হয়ে দেখা দেয়। বড়দের ক্ষেত্রে রেসপিরেটরি ইনফেকশনগুলো বেড়ে যায়। শরীরে অ্যালার্জিজনিত সমস্যা অনেক বাড়ে।’
শীতকালীন সতর্কতা হিসেবে তিনি বলেন, ‘এসময় ঠাণ্ডার কারণে অনেকেই কম গোসল করে থাকে। এটা একেবারেই উচিত নয়। গরম পানি মিশিয়ে গোসল করতে হবে। পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার বিষয়টি প্রতিদিন খেয়াল রাখতে হবে। শীতের প্রকোপ থেকে বাঁচতে গরম কাপড় গায়ে দিতে হবে। শীতের বাতাস বইলে সেক্ষেত্রে কম যাতায়াত করতে হবে। অ্যালার্জিজনিত অসুবিধা থেকে বাঁচতে নিয়মিত গোসল করার ওপর জোর দিতে হবে।’
হাজারীবাগ নগর স্বাস্থ্যকেন্দ্রের ডা. মাহমুদা আখতার বলেন, ‘শীতকালে মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। এ কারণে সামান্যতেই রোগ বেড়ে যায়। এই সময় অন্তঃসত্ত্বা মায়েদের ঠাণ্ডা লেগে যায়। হাঁপানির প্রকোপ বেশি হয়। ফলে, তাদের স্বাস্থ্য ঝুঁকি বাড়ে।’ তিনি প্রসূতি মায়েদের সম্পর্কে বলেন, ‘প্রসূতি মায়েদের এমনিতেই ডেলিভারির জন্য দুশ্চিন্তায় থাকতে হয়। তার ওপর এদের সবসময় টেনশনে থাকতে হয় সন্তানের যেন ঠাণ্ডা না লাগে। নিউমোনিয়া অ্যাটাক না করে। নিউমোনিয়ায় পেটে পানি জমে যায়। ডায়রিয়ার প্রবলেমও দেখা দেয়। শীতকালে অন্তঃসত্ত্বা ও প্রসূতি মায়েদের সব ধরনের রোগের ঝুঁকি বেড়ে যায়। এক্ষেত্রে ঠাণ্ডা না লাগার ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে।
আগামীনিউজ/এএইচ