করোনাভাইরাসের বিস্তার বাড়ায় প্রতিরোধে এগিয়ে আসছে মানুষ। সমাজের বিভিন্ন স্তর থেকে সামর্থ্যমতো সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। পারসোনাল প্রোটেক্টিভ ইকুইপমেন্ট (পিপিই) এর অভাবে করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগীর চিকিৎসা দেওয়ার ক্ষেত্রে আতঙ্কে ছিলেন চিকিৎসক, নার্স ও হাসপাতালের কর্মীরা। এই সমস্যা দূর করতেও এগিয়ে এসেছে সাধারণ মানুষ। কিটের স্বল্পতায় ব্যাপক আকারে করোনা শনাক্তের পরীক্ষা করা সম্ভব হচ্ছিল না। সেই কিটও তৈরি হচ্ছে বেসরকারি উদ্যোগে। হ্যান্ড স্যানিটাইজার তৈরি করে বিনামূল্যে অসহায় ও শিক্ষার্থীদের কাছে বিতরণ করছে সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা। কোনো কোনো সংগঠন সড়কে জীবাণুনাশক ¯ন্ডেপ্র করছে। আবার কেউ কেউ বিতরণ করছেন মাস্ক ও হ্যান্ড গ্লাভস।
জানা যায়, সাধারণ মানুষের উদ্যোগে পারসোনাল প্রোটেক্টিভ ইকুইপমেন্ট (পিপিই) বা বিশেষ সুরক্ষিত পোশাক তৈরি করা হচ্ছে। পরে এগুলো হাসপাতালগুলোয় বিন্যামূল্যে সরবরাহ করা হবে। শনিবার পিপিইর ৩০টি নমুনা বা স্যাম্পল তৈরি করা হয়েছে। পে ইট ফরোয়ার্ড ও মানুষ মানুষের জন্য নামের দুই সংগঠনের উদ্যোগে পুরো প্রক্রিয়ার অর্থায়ন করছে বুয়েট অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন, বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস ট্যাক্সেশন অ্যাসোসিয়েশন ও ঢাকা রোটারি ক্লাব নর্থ-ওয়েস্ট। এর কারিগরি কাজের দায়িত্বে থাকা মার্কস অ্যান্ড স্পেনসারের বাংলাদেশের প্রধান স্বপ্নœ ভৌমিক জানান, পিপিই বানানোর বিষয়টি এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। সাধারণ সেলাই মেশিনে পোশাকগুলো সেলাই করা হয়েছে। সেলাইয়ের কারণে পুরোপুরি বায়ুরোধী করা যায়নি। আশা করছি, দুই-তিন দিনের মধ্যেই প্রাথমিকভাবে ব্যবহার উপযোগী পিপিই বানানো সম্ভব হবে।
অন্যদিকে, করোনাভাইরাস কভিড-১৯ পরীক্ষার পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের বিজ্ঞানী ড. বিজন কুমার শীলের নেতৃত্বে ড. নিহাদ আদনান, ড. মোহাম্মদ রাঈদ জমিরউদ্দিন ও ড. ফিরোজ আহমেদ র্যাপিড ডট ব্লট নামের পরীক্ষার এই পদ্ধতি উদ্ভাবন করেন। জানা যায়, বিজন কুমার শীল গণবিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এবং গণস্বাস্থ্য ফার্মাসিউটিক্যালের প্রধান বিজ্ঞানী। ড. বিজন ও তার দলের উদ্ভাবিত পদ্ধতিতে মাত্র ৩৫০ টাকায় ১৫ মিনিটে করোনা শনাক্ত সম্ভব বলে দাবি করেছেন গণস্বাস্থ কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ও ট্রাস্টি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। আর সরকার যদি এর ওপর ট্যাক্স-ভ্যাট আরোপ না করে তাহলে মাত্র ২০০ থেকে ২৫০ টাকায় এটি বাজারজাত করা সম্ভব হবে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বাজারের ওপর চাপ ও ক্রেতার খরচ কমাতে দেশের বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা হ্যান্ড স্যানিটাইজার তৈরি ও সচেতনতার কাজ করছে। শুধু তাই নয়, এ স্যানিটাইজার তারা বিনামূল্যে সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দিচ্ছেন। রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর মধ্যে ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়নের নেতা-কর্মীরা মানুষের মধ্যে বিনামূল্যে হ্যান্ড স্যানিটাইজার বিতরণ শুরু করেছে। ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা প্রথম দফায় ১০০ মিলিগ্রামের ১০ হাজার পিস স্যানিটাইজার তৈরি করে। এর পাশাপাশি সংগঠনটির অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়, জেলা ও মহানগর শাখাও হ্যান্ড স্যানিটাইজার তৈরি ও বিতরণ করে। একইভাবে শ্রমজীবী মানুষ ও সাধারণ শিক্ষার্থীদের জন্য বিনামূল্যে হ্যান্ড স্যানিটাইজার সরবরাহের উদ্যোগ নেয় কেন্দ্রীয় ছাত্র ইউনিয়ন।
করোনা প্রতিরোধে এগিয়ে এসেছেন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও। এরই মধ্যে আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ (এআইইউবি), ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির ফার্মেসি বিভাগ, ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক ইউনিভার্সিটি, ইউনিভার্সিটি অব ডেভেলপমেন্ট অল্টারনেটিভ, ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ, সাউদার্ন ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ সচেতনতার পাশাপাশি হ্যান্ড স্যানিটাইজার তৈরি করে মানুষের কাছে বিনামূল্যে পৌঁছে দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে। এ ছাড়া বর্তমানে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের পাবলিক হেলথ ডিপার্টমেন্টের উদ্যমী শিক্ষার্থীরা ভার্চুয়াল মেডিকেল সার্ভিস সেবা দিচ্ছেন।
সামাজিক সংগঠনগুলোর মধ্যে ‘বিদ্যানন্দ’ নামের একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের কর্মী ও তাদের স্বেচ্ছাসেবকরা নিজেরাই হ্যান্ড স্যানিটাইজার, মাস্ক, চিকিৎসকদের পারসোনাল প্রোটেক্টিভ ইকুইপমেন্ট (পিপিই) তৈরি করে তা সাধারণ মানুষের মধ্যে বিনামূল্যে বিতরণ করেন। প্রতিষ্ঠানটি চিকিৎসক ও রসায়নবিদদের উপস্থিতিতে হ্যান্ড সলিউশন তৈরি করছে। প্রতিষ্ঠানটিকে সহায়তায় অনেকেই অনুদান দিচ্ছেন। এ ছাড়া প্রতিষ্ঠানটি চিকিৎসক ও নার্সদের মধ্যে বিনামূল্যে বিতরণের জন্য গাউন তৈরি করেছে। বিদ্যানন্দের কিছু স্বেচ্ছাসেবী প্রায় তিন-চারশ গাউন তৈরি করে সংশ্লিষ্টদের পৌঁছে দিচ্ছেন। এর বাইরে প্রতিষ্ঠানটি হাজার হাজার মাস্ক তৈরি করে তা বিভিন্ন হাসপাতাল ও চ্যারিটেবল প্রতিষ্ঠানের কাছে সাশ্রয়ী মূল্যে বিক্রি করে। জনসমাগম বেশি হয় এমন স্থানগুলোতে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধে বিদ্যানন্দের স্বেচ্ছাসেবকরা জীবাণুনাশক ¯ন্ডেপ্র ছিটিয়ে যাচ্ছে শহরের বিভিন্ন স্থানে। ঢাকার কয়েকটি স্থানে হাত ধোয়ার ব্যবস্থাও করেছে সংস্থাটি।
করোনাভাইরাস সংক্রমণের এ সময়ে মিরপুরের ‘বাসন্তী নিবাস’ নামের নারীদের ক্যাপসুল হোটেলে বিনামূল্যে নারী চিকিৎসক এবং নার্সদের থাকার ব্যবস্থা করেছে। থাকার সুবিধা দেওয়ার পাশাপাশি হোটেলটি সেই চিকিৎসক ও নার্সদের সকাল, দুপুর এবং রাতের খাবারও বিনামূল্যে সরবরাহ করছে। এ ছাড়া করোনা প্রতিরোধে ফেসবুকের বিভিন্ন গ্রুপভিত্তিক পেজের সদস্যরাও সুবিধাবঞ্চিত মানুষের মাঝে মাস্ক ও হাত ধোয়ার সাবান বিতরণ করছেন। এমনই একটি গ্রুপ ০৭০৯-এর সদস্যরা সম্প্রতি শহরের জনবহুল স্থান, এয়ারপোর্ট ও রেলস্টেশনে প্রয়োজনীয় এ দ্রব্যগুলো বিতরণ করেন। বর্তমানে এ ধরনের আরও অনেক গ্রুপের সদস্যদের এই ইতিবাচক কাজে অংশগ্রহণ করতে দেখা যাচ্ছে। এদের কেউ কেউ সচেতনতার অংশ হিসেবে লিফলেটও বিতরণ করছেন।
চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (চুয়েট) রসায়ন বিভাগের উদ্যোগে করোনাভাইরাসের প্রাথমিক প্রাদুর্ভাব মোকাবিলায় জীবাণুনাশক ‘চুয়েটাইজার’ নামে হ্যান্ড স্যানিটাইজার তৈরি করেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমোদিত প্রস্তুত প্রণালি অনুসরণ করে এটি তৈরি করা হয়। চুয়েটের রসায়ন বিভাগের ল্যাবে ১০০ মিলিলিটার সাইজের ৩০০ ইউনিট স্যানিটাইজার তৈরি করা হয়েছে। চুয়েটের রসায়ন বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ড. রাজিয়া সুলতানার নেতৃত্বে চুয়েটাইজারটি তৈরি করা হয়। (খবর : বাংলাদেশ প্রতিদিন, ২৩ মার্চ, ২০২০)