ঢাকাঃ দেশের ইটভাটা শ্রমিকদের সুরক্ষা নেই। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করতে হয় তাদের। কাজে যোগদানের পর রীতিমতো বন্দি অবস্থায় রাখা হয়। নির্যাতনের শিকার অসহায় শ্রমিকরা চাইলেও পালাতে পারেন না। এসব শ্রমিকের বেশিরভাগই বিভিন্ন জায়গা থেকে নিয়ে এসে মালিকদের কাছে বিক্রি করে দেয় দালালরা। মালিকদের কাছ থেকে পাওয়া সে অর্থ সমন্বয় না হওয়া পর্যন্ত এসব শ্রমিককে কাজ করতে বাধ্য করা হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে শেকল দিয়েও বেঁধে রাখা হয় তাদের। কাজ করতে অনীহা প্রকাশ করলে চালানো হয় অমানবিক নির্যাতন। চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন ইটভাটা ঘুরে এমন করুণ চিত্রের দেখা মিলে।
এমন তথ্য জানিয়ে শ্রম অধিদপ্তর ও কল-কারখানা পরিদর্শন অধিদপ্তরের কর্মকর্তা রাকিব হাসান আগামী নিউজকে বলেন, শ্রম আইন অনুযায়ী এসব শ্রমিক কোনো সুবিধাই পান না। প্রতিবছর ইটের দাম বাড়লেও ইটভাটার শ্রমিকদের মজুরি বাড়ে না। গত পাঁচ বছরেরও বেশি সময় ধরে একজন শ্রমিককে দৈনিক ৪০০ টাকায় ১৬-১৭ ঘণ্টা কাজ করতে হচ্ছে। যারা ইট বানান, তাদের বেতন এর চেয়ে একটু বেশি। তবে শ্রমিকদের এই বেতনের একটি বড় অংশ চলে যায় দালালদের হাতে। কারণ এসব দালালই দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে এসব শ্রমিককে কাজে নিয়ে আসেন।
এই কর্মকর্তারা আরও জানান, দালালরা কাজে যোগদানের আগেই মালিকদের কাছ থেকে টাকা নেয়। সেই টাকা সমন্বয় না হওয়া পর্যন্ত শ্রমিকদের কাজ করতে বাধ্য করা হয়। এজন্য কোনো কোনো ইটভাটায় শ্রমিকদের ওপর অমানবিক নির্যাতন চালানো হয়। শেকল দিয়ে বেঁধে রাখা হয়।
এই দুই অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গত এক বছরে দেশের পাঁচটি ইটভাটা থেকে অর্ধশতাধিক শ্রমিককে উদ্ধার করেছে পুলিশ ও র্যাব। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল গত বছরের ৩ জানুয়ারি চাঁদপুরের মহমায়াচরলী এলাকার পিয়াল ব্রিকস (ইটভাটা) থেকে বন্দি অবস্থায় ছয় কিশোর-শ্রমিকসহ ১৪ শ্রমিককে উদ্ধারের ঘটনা। এসব শ্রমিককে ইটভাটায় তালাবদ্ধ রেখে নির্যাতন করা হচ্ছিল। সেদিন উদ্ধারের পর ভুক্তভোগী শ্রমিকরা জানান, তিন বেলা খাবার ও থাকার ব্যবস্থাসহ প্রতিদিন ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা করে মজুরি দেওয়ার শর্তে নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে শ্রমিক সর্দার মো. দাউদ তাদেরকে নিয়ে আসেন পিয়াল ব্রিকসে। কিন্তু এখানে আসার পর থেকে প্রতি সপ্তাহে ৮০ হাজার ইট কাটতে হবে বলে তাদের ওপর চাপ সৃষ্টি করে ইটভাটার মালিকপক্ষ। ভোর সাড়ে ৪টায় ঘুম থেকে টেনে তুলে কাজ করতে বাধ্য করা হয়। কেউ দেরি করে উঠলে তাদেরকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজসহ মারধরও করা হয়। ঠিকমতো টাকাপয়সাও দেয় না। আবার কাজ শেষে সন্ধ্যার পরপরই একটি কক্ষের মধ্যে তাদের তালাবদ্ধ করে রাখা হয়।
প্রত্যেকটি ভাটার কাছেই শ্রমিকদের বসবাসের গড়ে তোলা হয়েছে শ্রমিকদের বসবাসের এলাকা। কারখানায় যারা কাজ করেন তারা পরিবারসমেত সেখানে থাকেন। শ্রমিকদের সেই ঘরগুলোর অবস্থা খুবই করুণ। এগুলোর উচ্চতা মাত্র দেড় মিটার। উচ্চতা এতটাই কম যে মানুষ ঠিকমতো সোজা হয়ে দাঁড়াতেও পারে না। আর সেগুলোতে নেই বিদ্যুৎসংযোগ। টিনের চালের তৈরি ওই ঘরগুলোর ভেতরে প্রচ- গরম। তার কারণ চুল্লির উত্তাপ। আর সেই গরম পরিবেশেই মাত্র তিন থেকে চার বর্গমিটার এলাকায় গাদাগাদি করে থাকেন অন্তত ১০ জন মানুষ।
এ ব্যাপারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন বিভাগের ডিন অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ আগামী নিউজকে বলেন, ‘ইটভাটায় কর্মরত শ্রমিকরা মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রয়েছে। ইটভাটায় দীর্ঘ সময় কাজ করার ফলে বিষাক্ত ধোঁয়া ও ধুলাবালিতে শিশুদের ত্বক ও নখ নষ্ট হওয়ার পাশাপাশি রক্তস্বল্পতা, অ্যালার্জি, হাঁপানি, ব্রংকাইটিস রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে।’
ইটভাটা শ্রমিকদের সার্বিক পরিস্থিতি তুলে ধরে শ্রম অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক ড. মো. আনোয়ার উল্ল্যাহ আগামী নিউজকে বলেন, ‘ইটভাটা আইন আছে। সেখান শ্রমিক সুরক্ষা ও পরিবেশবান্ধব ইটভাটার কথা বলা আছে। কিন্তু সেটা মানা হয় না। ইটভাটার শ্রমিকরা সংগঠিত নয়। তাদের ট্রেড ইউনিয়ন নেই। ফলে কোনো তথ্য আমাদের কাছে আসে না। কলকারখানা পরিদর্শন অধিদপ্তরের কাজ ইটভাটাগুলো পরিদর্শন করা। সেটাও অনিয়মিত। এসব শ্রমিকের কোনো মজুরি বোর্ড নেই। দৈনিক ৪০০ টাকা ধরা হয়েছে। কিন্তু মালিকরা সেটাও মানে না। এসব শ্রমিক রেজিস্টার্ড না হওয়ায় আমাদের পক্ষেও অনেক সময় কিছু করা যায় না। তবে আমরা ডেটাবেস করার উদ্যোগ নিয়েছে। সব ইটভাটা ও শ্রমিকের নাম-ঠিকানা রাখব।’
এই কর্মকর্তা আরো বলেন, উদ্বেগের বিষয় হলো ইটভাটায় শ্রমিক আটকে রেখে মজুরি না দেওয়ার ঘটনা বেড়ে চললেও অধিকাংশ ইটভাটা গ্রাম ও প্রত্যন্ত অঞ্চলে অবস্থিত হওয়ায় এসব ঘটনা প্রকাশ পায় না।
পরিবেশ অধিদপ্তরের হিসাবে, দেশে ইটভাটা আছে ৪ হাজার ৫১০টি। এসব ভাটায় প্রতিবছর পোড়ানো হয় ৩ হাজার ২৪০ কোটি ইট। তবে শ্রম অধিদপ্তরের দাবি, ছোট-বড় মিলিয়ে ইটভাটার সংখ্যা প্রায় ৬ হাজার থেকে ৭ হাজার। এ ছাড়া অবৈধভাবে গড়ে ওঠা ইটভাটার সংখ্যা অজানা। প্রতিটি ভাটায় তৈরি হয় বছরে ৭৫ লাখ ইট। তবে এসব ইটভাটায় কত শ্রমিক কাজ করে সে তথ্য নেই কোনো অধিদপ্তরের কাছেই।
আগামীনিউজ/প্রভাত