
ঢাকাঃ আড়ংয়ের রাজধানীর বনানীর আউটলেটের চেঞ্জরুমে গোপনে ধারণ করা উদ্ধারকৃত ৩৭টি ভিডিও বিশ্লেষণে পুলিশের সাইবার সিকিউরিটি অ্যান্ড ক্রাইম বিভাগ। সহকর্মীদের ভিডিও ধারণের অভিযোগে গ্রেফতার আড়ংয়ের চাকরিচ্যুত কর্মী সিরাজুল ইসলাম সজীবের মোবাইল ফোন তল্লাশি করে ভিডিওগুলো উদ্ধার করা হয়।
মঙ্গলবার (২৮ জানুয়ারি) আদালতে দেয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে সজীব বলেছে, উদ্ধার হওয়া ভিডিওগুলো আড়ংয়ের নারীকর্মীদের পোশাক পরিবর্তনের সময় ধারণ করা। এসব ভিডিও পাঠিয়ে ব্ল্যাকমেইল করে অনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনসহ টাকা দাবি করছিল সে। বনানী থানায় করা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় সজীব আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়।
ডিবির সাইবার ক্রাইম ইউনিট সূত্র জানায়, সজীবের মোবাইল ফোন থেকে উদ্ধারকৃত ৩৭টি ভিডিও বিশ্লেষণ করে দেখা হচ্ছে। এই ৩৭ ভিডিও ছাড়াও আরো ভিডিও রয়েছে কি না তাও দেখছে সাইবার ফরেনসিক ল্যাবে। এছাড়াও সজীবের নামে বা অন্য নামের অ্যাকাউন্ট থেকে বিভিন্ন সোসাল মিডিয়ায় ভিডিও জমা রাখা বা গোপনে পাঠিয়ে সেভ করে রাখা হয়েছে কিনা তাও পরীক্ষা করে দেখা হচ্ছে। মোট কথা সজীব অন্য কোথাও ভিডিওগুলো পাঠিয়েছে কি না তা পরীক্ষা করে দেখা হচ্ছে।
এর আগে এ ঘটনায় এক নারী কর্মী ১৬ জানুয়ারি বনানী থানায় অভিযোগ দেন। শনিবার (২৫ জানুয়ারি) সাইবার সিকিউরিটি অ্যান্ড ক্রাইম বিভাগের এসআই ফারুক হোসেন বনানী থানায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করেন। ওই দিনই সজীবকে পূর্ব শেওড়াপাড়া থেকে গ্রেফতার করা হয়। একদিনের রিমান্ড শেষে সজীব আদালতে জবানবন্দি দেয়। পরে তাকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। এক নারী সহকর্মীর পোশাক পরিবর্তনের সময় গোপনে ভিডিও করার অভিযোগে ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে সজীবকে চাকরিচ্যুত করা হয়। তাকে চাকরিচ্যুত করা হলেও ভিডিওগুলো তার কাছে সংরক্ষিত ছিল। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আড়ং সজীবের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা না নেয়ায় সে বেপরোয়া হয়ে ওঠে। সে গত ১১ জানুযারি একটি ভিডিও পাঠিয়ে এক নারী কর্মীকে অনৈতিক প্রস্তাব এবং অর্থ দাবি করে।
তদন্ত সূত্র জানায়, উদ্ধারকৃত ৩৭টি ভিডিও ৯-১০ জন স্টাফ তরুণীর। তারা ডিউটির শুরুতে স্টাফ চেঞ্জরুমে নিজেদের সাধারণ পোশাক পরিবর্তন করে আড়ংয়ের নির্ধারিত ইউনিফর্ম পরেন। আবার ডিউটি শেষে ইউনিফর্ম বদলে নিজেদের কাপড় পরে বের হয়ে যান। সেসময়ই গোপনে সেলফি স্টিক দিয়ে ওই রুমে স্থাপিত ক্যামেরায় ভিডিও করতেন সজীব।
এক সহকর্মীর ভিডিও ধারণ ও সামাজিক মাধ্যমে আপলোডের অভিযোগে গত বছরের ডিসেম্বরে তাকে চাকরিচ্যুত করে আড়ং। তবে এর পরপরই জানুয়ারিতে সজীব ২২ বছর বয়সী এক তরুণী স্টাফের ফেসবুক ম্যাসেঞ্জারে তার কাপড় পরিবর্তনের ভিডিও পাঠিয়ে তাকে ব্ল্যাকমেইল করেন। ভিডিও ছড়িয়ে দেয়ার হুমকিও দেন ওই তরুণীকে। যে ভিডিও উদ্ধার হয়েছে, সেখানে ব্ল্যাকমেইলিংয়ের শিকার তরুণী ছাড়াও আরো চারজনকে শনাক্ত করা হয়েছে বলে জানান তদন্ত কর্মকর্তারা।
তদন্ত সূত্রে জানা গেছে, দেড় বছর আগ থেকে সজীব বিভিন্ন কৌশলে স্টাফদের চেঞ্জরুমে মোবাইলের ক্যামেরার মাধ্যমে ভিডিও করতে থাকেন। এ পর্যন্ত তিনি অনেকের ভিডিও ধারণ করলেও একজন তরুণীই শেষ পর্যন্ত তার বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন। সজীব ওই তরুণীর ম্যাসেঞ্জারে ছবি পাঠিয়ে তার সঙ্গে শারীরিক সম্পর্কের প্রস্তাব দেন এবং চাঁদা দাবি করেন।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) সাইবার ইউনিটের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (এডিসি) নাজমুল ইসলাম বলেন, আসামি রিমান্ডে তার অপকর্মের তথ্য দিয়েছে। আদালতে গিয়েও জবানবন্দি দিয়েছে। আদালতের নির্দেশে আমরা তাকে কারাগারে পাঠিয়েছি। এরপর প্রক্রিয়া অনুযায়ী দ্রুত সময়ে চার্জশীট দিয়ে দিব।
সজীবের বিরুদ্ধে দায়ের করা অভিযোগে উল্লেখ করা হয়েছে, আড়ংয়ের বনানী শাখায় কর্মরত ওই তরুণীকে ১১ জানুয়ারি রাত ১২টা ৩৭ মিনিটে সজীব তার ফেসবুক ম্যাসেঞ্জার থেকে বার্তা পাঠিয়ে সীমান্ত সৈকত নামে আরেক ফেসবুক আইডি থেকে পাঠানো একটি ভিডিও দেখতে বলেন। ওই তরুণী ভিডিওতে দেখেন, আড়ংয়ের বনানী শাখার চতুর্থ তলার কর্মচারীদের চেঞ্জ রুমে তার পোশাক পরিবর্তনের দৃশ্য এটি। এসময় সজীব তাকে ভিডিও করে শরীর দেখাতে বলেন এবং তার কথামতো কাজ না করলে ভিডিওটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়ার হুমকি দেন।
তদন্ত সূত্র জানায়, সজীবের গ্রামের বাড়ি ভোলার চরফ্যাশন থানার আমিনাবাদে। তার কাছ থেকে একটি রেডমি ৫ প্লাস ফোনসেট জব্দ করা হয়। ওই মোবাইলে তার নিজের ফেসবুক আইডি লগইন অবস্থায় পাওয়া যায়। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তিনি আড়ংয়ের ওই নারীকর্মীর ভিডিও করা এবং তাকে হুমকি দেয়ার বিষয়টি স্বীকার করেছেন।
এ বিষয়ে আড়ংয়ের চিফ অপারেটিং অফিসার আশরাফুল আলম বলেন, সিরাজুল ইসলাম সজীবের বিরুদ্ধে বনানী আউটলেটের একজন বিক্রয় প্রতিনিধি ১৬ জানুয়ারি বনানী থানায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করেন। এ ব্যাপারে অভিযোগকারীকে শুরু থেকেই সর্বাত্মক সহায়তা দিয়ে আসছি আমরা।
তিনি আরো বলেন, আড়ং যৌন হয়রানিমূলক যে কোনো কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে নীতিগতভাবে সর্বদা কঠোর অবস্থানে থাকে এবং এই ধরনের কর্মকাণ্ডে জড়িত আড়ং-সংশ্লিষ্ট যে কোনো ব্যাক্তি বা গোষ্ঠীকে কঠোর হস্তে দমনের জন্য তৎক্ষণাৎ পদক্ষেপ নেয়। এরই ধারাবাহিকতায় সিরাজুল ইসলাম সজীবের বিরুদ্ধে গত ডিসেম্বরে যৌন হয়রানিমূলক কর্মকাণ্ডের অভিযোগ পাওয়া গেলে তদন্তের মাধ্যমে তাকে তৎক্ষণাৎ চাকরিচ্যুত করা হয়। বর্তমানে চলমান মামলাটির কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে কর্তৃপক্ষকে আমাদের পক্ষ থেকে সার্বিক সহায়তা দেয়া হচ্ছে।
আগামীনিউজ/মোরসু/এনএ