কক্সবাজারঃ একের পর এক হত্যা, গুম, মাদক, অপহরণ ও ধর্ষণসহ নানা অপরাধে ভয়ংকর হয়ে উঠছে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের পরিস্থিতি। এখানে খুন যেন নিত্যনতুন কিছু নই, সেটি অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছে। এমন দিন নেই ক্যাম্পে অঘটন ঘটছে না। নানা অপকর্ম ও অপরাধে ভারি হয়ে উঠছে রোহিঙ্গা শিবিরের আবহাওয়া।
ক্যাম্পের একাধিক সূত্র বলছে, এসব অপরাধের সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত মিয়ানমারের সশস্ত্র কয়েকটি সন্ত্রাসী বাহিনী। তারমধ্যে রয়েছে , আরাকান স্যালভেশন আর্মি (আরসা), রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশন (আরএসও) ও সন্ত্রাসী নবী হোসেন বাহিনী।
উখিয়া, টেকনাফে ৩৩টি ক্যাম্পে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সংখ্যা প্রায় সাড়ে ১২ লাখ। তাদের মধ্যে আট লাখের বেশি রোহিঙ্গা ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পর কয়েক মাসে রাখাইনে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর দমন-পীড়নের মুখে পালিয়ে এসেছে।
ক্যাম্পগুলো নিয়ন্ত্রণে রাখতে সন্ত্রাসী গ্রুপগুলোর মধ্যে এখন প্রকাশ্যে চলছে দ্বন্দ্ব, সংঘাত ও সংঘর্ষ। বর্তমানে বেশি তৎপর মিয়ানমারের সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান স্যালভেশন আর্মি (আরসা) রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশন (আরএসও) ও নবী হোসেন গ্রুপ। ক্যাম্প কেন্দ্রিক মাদক ব্যবসা, চাঁদাবাজি, অপহরণ ও চোরাচালান নিয়ন্ত্রণই তাদের মূল টার্গেট।
সর্বশেষ শুক্রবার (৭ জুলাই) ভোরে উখিয়ার বালুখালী রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আরসা ও আরএসও-এর মধ্যে পাল্টাপাল্টি গুলিতে ঘটনাস্থলে পাঁচ রোহিঙ্গা নিহত হন। এরপর রাতে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের একটি নালা থেকে আরও একজনের গলাকাটা লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। অর্থাৎ শুক্রবার একদিনেই ক্যাম্পে ছয়জন নিহত হয়েছে। নিহতরা সবাই আরসা সদস্য বলে জানিয়েছে পুলিশ।
গোলাগুলিতে নিহতরা হলেন, আরসা কমান্ডার ক্যাম্প-১০ এর বাসিন্দা মো. নজিমুল্লাহ, আরসার জিম্মাদার ক্যাম্প-১৩ এর নুরুল আমিন (২৪), আরসার সদস্য ক্যাম্প-৮ ওয়েস্টের বাসিন্দা আনোয়ার হোসেন (২৪) ও মোহাম্মদ হামীম (১৬)। অপরজনের পরিচয় পাওয়া যায়নি। এছাড়া রাতে ১১ নম্বর ক্যাম্প এলাকার নালা থেকে সানা উল্লাহ (২৩) নামে একজনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে।
ক্যাম্প সূত্রে জানা গেছে, ক্যাম্পে আরসা-আরএসও সদস্যদের মধ্যে বর্তমানে দ্বন্দ্ব চরম আকার ধারণ করেছে । উদ্দেশ্য নিয়ে মতবিরোধ দেখা দেওয়ায় আরসা’র প্রধান আতাউল্লাহ আবু আম্মার ওরফে জুনুনির গ্রুপ থেকে সরে আসার চেষ্টা করছে অন্য একটি অংশ। আর এ অংশকে নিজেদের দলে ভেড়াতে চাইছে আরএসও। এতেই দেখা দিয়েছে বিপত্তি। এছাড়া রয়েছে ক্যাম্পের ত্রাস নবী হোসেন গ্রুপ। আবার ক্যাম্পের অনেক সাধারণ রোহিঙ্গাও আরসা সন্ত্রাসী দলের ওপর অতিষ্ট হয়ে গোপনে আরএসওকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। এদের যুক্তি আরএসও ক্যাম্পে শান্তি বজায় রাখতে চায়।
ক্যাম্পের আরেকটি সুত্র বলছেন, মিয়ানমারে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর চালানো নির্যাতন-নিপীড়নের তথ্যানুসন্ধানের জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (আইসিসি) প্রধান কৌঁসুলি করিম আসাদ আহমাদ খান নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল ক্যাম্প পরিদর্শন করেন। আইসিসি টিম চলে যাওয়ার একদিন পর এ গোলাগুলির ঘটনাকে ঘিরে অনেক প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে।
গত বৃহস্পতিবার আইসিসির প্রধান কৌঁসুলি করিম আসাদ আহমাদের সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য নির্যাতিতদের ডাকতে গিয়ে মো. এবাদুল্লাহ (২৭) নামের এক রোহিঙ্গা সাব মাঝি (নেতা) ছুরিকাঘাতে নিহত হয়েছেন।
রোহিঙ্গাদের দাবি, অধিকার নিয়ে কাজ করতে গঠিত হয়েছে বেশ কয়েকটি সংগঠন। এর মধ্যে আরএসও মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ফেরার বিষয় ও অধিকার নিয়ে কাজ করে। আর ক্যাম্পে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড করছে আরসা। আরসার নিয়ন্ত্রণে থাকা সন্ত্রাসীরা মিয়ানমার সরকারের ইন্ধনে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন ও আন্তর্জাতিক আদালতের বিচার বাধাগ্রস্ত করতে কাজ করছে। প্রত্যাবাসনের আগ্রহী রোহিঙ্গাদের টার্গেট করে হত্যা ও ভয়ভীতি দেখাচ্ছে তারা।
বৃহস্পতিবার আইসিসির প্রধান কৌঁসুলি করিম আসাদ আহমাদ খানের ক্যাম্প সফর ও বিচার কার্যক্রমের সাক্ষ্য দিতে আগ্রহী রোহিঙ্গাদের ভয় দেখাতে এ হামলা বলে ধারণা রোহিঙ্গাদের।
উখিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শেখ মোহাম্মদ আলী বলেন, গতকাল বালুখালী আশ্রয়শিবিরে ছয় রোহিঙ্গা নিহতের ঘটনায় আজ শনিবার সকাল ১০টা পর্যন্ত থানায় মামলা হয়নি। তবে মামলার প্রস্তুতি চলছে।
এ বিষয়ে ৮-এপিবিএন অধিনায়ক (অতিরিক্ত ডিআইজি) আমির জাফর বলেন, ক্যাম্পে একাধিক সশস্ত্র গ্রুপের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে বাড়ছে খুনোখুনি। কে আরসা, কে আরএসও সেটি বিষয় নয়। ক্যাম্পে কোনও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চলবে না। ক্যাম্প আমাদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। যারাই অপরাধে জড়াবে, তাদের আইনের আওতায় আনা হবে। গতকালের এই ঘটনায় সন্দেহজনকভাবে ৬ জনকে আটক করা হয় বলে জানান এপিবিএনের এই কর্মকর্তা।
জেলা পুলিশ ও এপিবিএনের তথ্য অনুসারে, কক্সবাজারের ৩৩টি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে গত সাড়ে পাঁচ বছরে ১৭৩টি হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। নিহতদের মধ্যে রয়েছেন কমিউনিটি নেতা, স্বেচ্ছাসেবক ও সাধারণ রোহিঙ্গা। এর মধ্য চলতি বছরের সাত মাসে (৭ জুলাই) রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবিরে একাধিক সংঘর্ষ ও গোলাগুলির ঘটনায় অন্তত ৫৯ জনের মৃত্যু হয়েছে।
গত এক বছরে উখিয়া-টেকনাফের বিভিন্ন ক্যাম্পে অভিযান চালিয়ে ৩৮০টি আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার ও ১৬৮ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। একই সময়ে ২৬ লাখের বেশি ইয়াবা ও ২৯ কেজি আইসসহ ৭৭৯ রোহিঙ্গাকে ধরা হয়। এছাড়া ১৩৬ রোহিঙ্গা অপহরণের ঘটনায় ১৮ মামলায় ২৯ জনকে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।
বুইউ