নেত্রকোণাঃ দেশে স্বাধীনতার ৫০বছর সুবর্ণ জয়ন্তী পালিত হলেও এখনও অযত্ন অবহেলায় ও অরক্ষিত অবস্থায় পড়ে আছে নেত্রকোণার অধিকাংশ বধ্যভূমি। সেখানে এখনও নির্মাণ করা হয়নি কোনো স্মৃতিফলক। বর্তমান সরকারের আমলে দেশের ব্যাপক উন্নয়ন হলেও নেত্রকোণার অধিকাংশ বধ্যভূমিগুলো সঠিকভাবে চিহ্নিত ও সেগুলোর কোনো উন্নয়ন না হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন মুক্তিযোদ্ধা ও নেত্রকোণার সাধারণ মানুষ। স্মৃতিফলক নির্মিত না হওয়ায় নেত্রকোণার ছোট-বড় ১০টি বধ্যভূমির অধিকাংশই হারিয়ে যেতে বসেছে।
১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময় এলাকার রাজাকার, আল-বদর, আল-সামস্, শান্তি কমিটির সহযোগিতায় পাক-হানাদার বাহিনী অসংখ্য মা-বোনকে ধরে নিয়ে গণধর্ষণ, নিরীহ ও মুক্তিকামী বাঙালিকে ধরে নিয়ে অমানসিক নির্যাতণের পর নির্মমভাবে হত্যা করে এসব বধ্যভূমিতে ফেলে রাখত। অগণিত শহীদের রক্তে ভেজা এসব বধ্যভূমি সঠিকভাবে চিহ্নিত করণ ও যথাযথ সংরক্ষণের অভাবে ক্রমশ হারিয়ে যেতে বসেছে। অনেকেই এসব স্থান অবৈধ দখলের পাঁয়তারা করছে। জাতীয় দিবস এলে কিছু কিছু বধ্যভূমির কদর বাড়লেও সারা বছরই এগুলো থাকে অযত্ন আর অবহেলায়।
বর্তমান সরকার ও প্রশাসন বিপুল উৎসাহ উদ্দীপনায় স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী পালন করছে অপরদিকে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজরিত এসব বধ্যভূমি অযত্ন আর অবহেলায় পড়ে থাকায় মুক্তিযোদ্ধা আর সাধারণ মানুষের মাঝে ক্ষোভের সঞ্চার করছে।
স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক, ইতিহাসবিদ ও বিভিন্ন শহীদ পরিবারের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, জেলার বিভিন্ন উপজেলায় আনুমানিক ১৪টি বধ্যভূমি রয়েছে। এগুলো হচ্ছে, জেলা শহরের মোক্তারপাড়া সেতু সংলগ্ন মগড়া নদীর তীর, সাতপাই সড়ক সংলগ্ন মগড়া নদীর তীর, জেলা শহরের চন্দ্রনাথ উচ্চ বিদ্যালয় সংলগ্ন মগড়া নদীর তীর, সাতপাই এলাকায় অবস্থিত নেত্রকোণা সরকারি টেকনিক্যাল স্কুল এ্যান্ড কলেজ প্রাঙ্গণ, নেত্রকোণা-পূর্বধলা সড়কের ত্রি-মোহনী, নেত্রকোণা সদর উপজেলার চল্লিশা রেলওয়ে সেতু, পূর্বধলা উপজেলার পুকুরিয়াকান্দা, জারিয়া রেলস্টেশন সংলগ্ন কংস নদীর তীর, রাজপাড়া গ্রামের ডা. হেম বাগ্চীর বাড়ী, দুর্গাপুর উপজেলার বিরিশিরি গ্রাম সংলগ্ন সোমেশ্বরী নদীর তীর, গাওকান্দিয়া, কেন্দুয়া উপজেলার ঘোড়াইল, ধূপাগাতি, সেনের বাজার ও কেন্দুয়া বাজার এবং বারহাট্রায়। এর মধ্যে জেলা শহরের মোক্তারপাড়া সেতু সংলগ্ন মগড়া নদীর তীর ও সাতপাই মগড়া নদীর তীর, চন্দ্রনাথ স্কুলের সামনে মগড়া নদীর তীর ও পূর্বধলা উপজেলার ত্রি-মোহনী বধ্যভূমিতে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়েছে। অন্যান্য বধ্যভূমি এখনও সম্পূর্ণ অরক্ষিত।
শহীদ পরিবারের সন্তান মো.আব্দুর রব রব্বানী বলেন, ‘আমার চাচা বদিউজ্জামান মুক্তা ও সিদ্দিকুর রহমানসহ যে ছয়জনকে বিরামপুর বাজারে হত্যা করা হয় সেই স্থানে আজও কোনো স্মৃতিফলক নির্মাণ হয়নি। যদি স্মৃতিফলক নির্মাণ করা হতো তাহলে আগামী প্রজন্ম তাদের সম্পর্কে জানতে পারতো।’
এ ছাড়াও ১৯৭১-এর ২২সেপ্টেম্বর পূর্বধলার ত্রি-মোহিনীতে সবচেয়ে বড় হত্যাযজ্ঞ ঘটেছিল। সেদিন হানাদাররা সুরেশ সাহা, সতীশ সরকার, স্বদেশ দত্তসহ হিন্দু সম্প্রদায়ের ২৫জন নিরীহ মানুষকে ধরে এনে গুলি করে হত্যা করেছিল। স্বাধীনতার ৫০বছর পরও জেলার সবচেয়ে বড় বধ্যভূমিগুলো পড়ে আছে অযত্নে আর অবহেলায়।
বধ্যভূমিতে স্মৃতিসৌধ নির্মাণসহ এগুলোকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার দাবি জানান মুক্তিযোদ্ধাসহ মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী নেত্রকোণাবাসী।
বীরমুক্তিযোদ্ধার সন্তান শাহীন উদ্দীন আহমেদ (ভিপি শাহীন) বলেন- আওয়ামীলীগ সরকার মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতানায় বিশ্বাসী, আশা করছি অতিদ্রুত বধ্যভূমিগুলোতে স্মৃতিফলক নির্মাণ করবেন আগামী প্রজন্ম বাঙালির রক্তে রঞ্জিত ইতিহাস ও ঐতিহ্য জানার জন্য।
নেত্রকোণা জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার ও মুক্তিযোদ্ধা হায়দার জাহান চৌধুরী বলেন, ‘স্বাধীনতার এত বছরেও কেন বধ্যভূমিগুলোতে স্মৃতিফলক নির্মাণ করা হয়নি তা আসলে অবাক করার মতো বিষয়। আমি চাই এসব স্থানে শহীদদের নাম সম্বলিত স্মৃতিফলক নির্মাণ করবে প্রশাসন।’
নেত্রকোণা জেলা প্রশাসক কাজি মো.আবদুর রহমান জানান, ‘জেলার বধ্যভূমিগুলো সঠিক চিহ্নিত করণ, যথাযথ সংরক্ষণ ও সেসব স্থানে স্মৃতিফলক নির্মাণের জন্য সংশ্লিষ্ট দপ্তরে প্রস্তাব পাঠিয়েছি। প্রয়োজনীয় বরাদ্ধ পেলে বধ্যভূমিগুলো যথাযথ সংরক্ষণ ও স্মৃতিফলক নির্মাণ করা হবে।’
আগামীনিউজ/নাসির