নারায়নগঞ্জঃ “একটা সময় ছিল, যখন ঢাকা শহরেই মেলা বসতো। বৈশাখী মেলা, মহররমের মেলা, ঈদের মেলা, দুর্গা পূজার মেলাসহ আরও অনেক মেলা। এখনও মনে আছে চারিদিকে সাজানো মাটির পসরা, তালপাতার বাঁশি, মাটির খেলনা, হরেকরকম ঘুড়ি, টমটম, লাটিম, গাড়ি, বল, বেলুন, হাড়ি-পাতিল, কানের দুল, নাকের নোলক, ক্লিপ-ফিতা, শাড়ি-কাপড়, আলতা-সাবান, দা-খুন্তি, মাকড়ি, বাঁশ-বেতের জিনিস, পাখা, চালুনি, ঘর সাজানোর উপকরণ, নাগরদোলা, চটপটি, কটকটি, ফানুস—কী নেই সেখানে। কী ছেড়ে, কী কিনবো অবস্থা।
আমি ছোট্ট মানুষ, বাবা-মায়ের হাত ধরে গোলাকান্দাইল মাঠে গিয়েছিলাম পৌষের মেলায়। যতটুকু মনে পড়ে নাগরদোলায় উঠেছিলাম, হাওয়াই মিঠাই খেয়েছিলাম। তারপর ব্যাগ ভর্তি মাটির খেলনা নিয়ে বাসায় ফিরেছিলাম”-অতীত স্মরন করে এমনভাবে কথাগুলো বলছিলেন জন্মান্ধ বংশীবাদক আলী আকবর। “আমি মেলা থেকে তালপাতার এক বাঁশি কিনে এনেছি, বাঁশি আর আগের মত বাজে না, আর এখন বাঁশের পোড়া বাঁশি বাজিয়েই চলে আমার জীবন”।
ছোট্ট বেলায় শখের বশে বাঁশি বাজানো শিখলেও এ বাঁশিই আজ তার জীবনের চলার পাথেও। দুঃখ করে আকবর বলেন, আগে কি জানতাম পোঁড়া বাঁশি আমায় ঘরে থাকতে দিবে না। তাহলে কি আর বাঁশি বাজানো শিখতাম। তারপরও ভাল লাগে মানুষকে সাময়িক আনন্দ দিতে পেরে। খুশি হয়ে লোকে যা অল্প কিছু দেয় তা দিয়ে আমারও কোনো রকমে চলে যায়। ভিক্ষাবৃত্তিকে পেশা হিসেবে না নিয়ে, বাঁশি বিক্রি করেই জীবিকা নির্বাহ করছেন দৃষ্টি প্রতিবন্ধি আলী আকবর। নরসিংদী জেলার গ্রাম চুলা এলাকায় জন্ম আলী আকবর জন্ম থেকেই দৃষ্টি প্রতিবন্ধি।
আলী আকবরের বাবা একজন কৃষক হওয়ার কারণে তাকে ছোট বেলা থেকেই অনেক প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হতে হয়েছে। প্রতিবন্ধি স্কুলে পড়ানোর মতো সমার্থ্য আলী আকবরের বাবার ছিলো না। তাই আলী আকবরের স্কুলে যাওয়া হয় নি। সে তার দুচোখে কিছইু দেখতে পারে না। দৃৃষ্টি প্রতিবন্ধি হওয়ার কারণে আলী আকবরকে কম প্রতিকুলতার সম্মুখীন হতে হয় নি। জন্ম থেকে দৃষ্টি প্রতিবন্ধি হওয়ার কারণে তার পরিবার ও ভাইয়ের তাকে অবহেলা করতো।
কথায় আছে, যার পঞ্চম ইন্দ্রীয় কাজ না করে উপরওয়ালা তাকে ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় প্রদান করেন। দারিদ্রের সংসারে বড় হওয়া আলী আকবর দৃষ্টি প্রতিবন্ধি হওয়ার কারণে পড়ালেখা করতে পারে নি। ছোট বেলা থেকেই গান, বাঁশি ও তবলা বাজানো এগুলোর প্রতি তার অসীম আগ্রহ ছিলো। এর কারণে এলাকার এক উস্তাদের কাছে আলী আকবর গান, বাঁশি ও তবলা বাজানো শিখে। পরিবার ও ভাইদের অবহেলা ও নির্যাতনের শিকার হওয়া আলী আকবর রূপগঞ্জ উপজেলার ভুলতা এলাকার উস্তাদ সূন্দর আলী দেওয়ানের কাছে এসে গান, বাঁশি ও তবলা বাজানো শেখা শুরু করে। এর পর থেকেই আলী আকবর বিভিন্ন বিয়ের অনুষ্ঠানে গান ও বাঁশি বাজাতো।
চার বছর আগে উস্তাদ সুন্দর আলীর ছাত্রী শিরিন আক্তার নামে এক দৃষ্টি প্রতিবন্ধিকে ভালবেসে হিন্দু ধর্ম থেকে মুসলমান ধর্ম গ্রহন করে। হিন্দু পরিবারের জন্ম নেওয়া দিপক চন্দ্র বিশ্বাস ভালবাসার জন্য মুসলমান ধর্ম গ্রহন করে নিজের নাম পাল্টে রাখে আলী আকবর। ধর্ম পরিবর্তন করায় আলী আকবরের পরিবার ও ভাইয়েরা তার সঙ্গে কোন যোগাযোগ রাখে নি। স্বামী-স্ত্রী তারা দুজনেই বিভিন্ন বিয়ের অনুষ্ঠান ও বিভিন্ন স্ট্যাজ শোতে গান ও বাঁশি বাজানোর জন্য যেতো।
কথায় আছে, অভাগা যেদিকে চায় সাগর শুকিয়ে যায়। বিয়ের এক বছর যেতে না যেতেই আলী আকবের স্ত্রী শিরিনা আক্তার হ্রৃদ রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। এর পর থেকেই আলী আকবরের এক হয়ে পড়েন।
এছাড়া আলী আকবরের বাঁশিতে রয়েছে এক জাদুকরি ধ্বনি। আলী আকবর এখন বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে বাঁশি বাজিয়ে মানুষের মন জয় করে মানুষের কাছে বাঁশি বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করে। সে কারো কাছ থেকে টাকা চেয়ে নেয় না এছাড়া কেউ তার বাঁশি বাজানোতে সন্তোষ্ট হয়ে তাকে টাকা দিতে চায় তাহলে তার বিনিময়ে সে তাকে একটি বাঁশি দিয়ে দেয়। প্রতিটি বাঁশির মূল্য হচ্ছে চল্লিশ থেকে পঞ্চাশ টাকা করে। আলী আকবর প্রতিদিন প্রায় ৮’শ থেকে ৯’শ টাকার বাঁশি বিক্রি করতে পারে। বর্তমানে ভুলতা এলাকা একটি ভাড়া করা বাড়িতে আলী আকবর বসবাস করছেন। উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় বিভিন্ন সময় তাকে বাঁশি বিক্রি করতে দেখা যায়।
আলী আকবরের ওস্তাদ সুন্দর আলী দেওয়ান জানান, হিন্দু থেকে মুসলমান ধর্ম গ্রহন করায় আলী আকবরের পরিবার তার সঙ্গে যোগাযোগ করা বন্ধ করে দেয়। সুন্দর আলী দেওয়ানের ছাত্রী শিরিনা আক্তারকে ভালবেসে বিয়ে করেন আলী আকবর। বিয়ের রেশ কাটতে না কাটতেই শিরিনা হ্রৃদ রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। এর পর থেকেই আলী আকবর একা হয়ে পড়েন। আলী আকবর জীবিকা নির্বাহের তাগিদে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গিয়ে বাঁশি বাজায়। যখন কোন অনুষ্ঠান থাকে না তখন বেড়িয়ে বাঁশি বিক্রির জন্য। আলী আকবরের গান ও বাঁশি বাজানো মনোমুগ্ধকর বাঁশি শুনে অনেকেই বিমোহিত হয়েছেন।
আলী আকবর জানান, ছোট বেলা থেকেই আলী আকবর দারিদ্রতার মাঝে বড় হয়েছেন। এছাড়া দৃষ্টি প্রতিবন্ধি হওয়ার কারণে জীবনে তাকে কম অবহেলার শিকার হতে হয় নি। তিনি সবসময় মানুষের কাছে অবহেলার পাত্র হিসেবে ছিলো। এছাড়া তার ভাইয়েরা তাকে কানা বলে বিভিন্ন সময় উপহাস করতো। মুসলমান ধর্মের এক মেয়েকে ভালবেসে বিয়ে করার জন্য হিন্দু থেকে মুসলিম ধর্ম গ্রহন করার তার পরিবার তাকে সকল সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করে। স্ত্রী শিরিনা হৃদ রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়ার পর আলী আকবর একা হয়ে পড়েন।
তারপরও হেরে যায় নি আলী আকবর ভিক্ষাবৃত্তিকে পেশা হিসেবে না নিয়ে বাঁশি বিক্রি করেই জীবিকা নির্বাহ করছেন। প্রতিদিন রূপগঞ্জ ফেরিঘাটসহ বিভিন্ন বাস স্ট্যান্ডে বাঁশি বাজিয়ে বাজিয়ে বিক্রি করেন। বাঁশি বিক্রি করে আলী আকবরের একার সংসার বেশ ভালভাবেই চলে যায়। আলী আকবর আরো বলেন, আমি প্রতিবন্ধি বলে নিজেকে কখনো ছোট মনে করি নি। আমার প্রতিবন্ধকতা আমার দূর্বলতা নয় বরং এটাই আমার অস্ত্র। আলী আকবরের মতো যারা প্রতিবন্ধি আছে তাদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, তার মতো যারা প্রতিবন্ধি আছে তাদেরকে ভিক্ষা না করে আমার মতো কোন না কোন কাজ করা উচিত। জীবনে চলতে চলতে গেলে অনেক বাঁধা বিপত্তি আসবে তাই বলে থেমে থাকলে চলবে না।
আগামীনিউজ/এএস