ঢাকাঃ কবি সুকান্ত মুখোপাধ্যায় প্রচণ্ড খিদেয় কাতর এই পৃথিবী থেকে কবিতাকে ছুটি দিতে চেয়েছিলেন। তিনি লিখেছিলেন—
(১)
“কবিতা তোমায় দিলাম আজকে ছুটি
ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়
পূর্ণিমার চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি।“
রোজ রাতে আমরা রুটিই খাই। আজ ভাত করেছি। বাবুর আব্বু পদ্মার ইলিশ এনেছেন। তাই আমি আজ শখ করে ইলিশ মাছ রান্না করেছি। আমরা দু’জনেই শুধু ডাইনিং রুমে। ওকে খাবার বেড়ে দিয়েছি। খেতে খেতে জামিল বলল,
—একদম আমার মায়ের রান্নার মতো হয়েছে। মায়ের কাছ থেকে শিখে নিয়েছিলে?
—হ্যাঁ। ইলিশের এই তেরছা কোটা শাশুড়ি মায়ের থেকেই শেখা গো। তবে রেসিপিটা আমার মায়ের।
—ফারিয়া জানো, ইলিশ মাছকে তেরছা কোটা করে টুকরা করার মতো আশ্চর্য বুদ্ধিমত্তা আমার মায়ের ছিল। তুমি ভালই রপ্ত করেছো। একই আকারের মাছকে আটপৌরে করে কুটলে তার টুকরোগুলো যত বড় বড় হবে, এই তেরছা কোটা করে কুটলে সেই মাছেরই টুকরোগুলো হবে বেশ খানিকটা বড় বড়! ভাতের প্লেটে মাছের পিস তুলে ধরে বলল জামিল।
—তুমি জানো বাবুর আব্বু, আমাকে বিয়ের দেখার সময় তোমার মা আমার মাকে এ প্রশ্ন করেছিলেন যে আমি ইলিশ মাছ কুটতে জানি কি না!
তাই! বৌর সাথে কথা বলতে বলতে জামিল দেখল ফারিয়া ভাত-তরকারী-সব্জি বক্সে ভরছে।
—কি ওগুলো?
—খাবার দিচ্ছি বাবুর আব্বু।
—কাকে? এ বক্সে কেন?
প্রায় ভর্ৎসনার সুরে জামিল বলল। সে কিছুতেই বুঝতে পারছিল না ফারিয়া এই হলদেটে ছোট বক্সে, মিঃ নুডুলসের কাপে আর মাতৃভাণ্ডারের রসমালাইর বাটিতে কাকে খাবার দেবে।
আমি হেসে বললাম,
—সমস্যা কোনটা?
—এ বক্সে কেন? কাকে দেবে?
—আর বোলো না। একজন লোকের নাকি খাবার দরকার। ফেসবুকে লিখেছিল। আমিই তারপর নক করে জানতে চেয়েছিলাম। উনি বললেন উনার কথা। তার নাকি চুলো নেই। ফ্রিজ নেই। চাকুরী নেই। খাবার কিনে খেতে পারছেন না। কী একটা সমস্যা বল তো? কাছেই বোধয় থাকেন। আমি বলেছিলাম যে খাবার দেব। নিচে পাঠিয়ে দেব শফিকের কাছে। উনাকে ঠিকানা দিয়েছি। বলে দিলাম ফেসবুকে যে খাবার দেয়া আছে। সিকিউরিটিকে বললেই হবে, দিয়ে দেবে।
দেশে কোভিড-১৯ সংক্রমণ আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে যাওয়ায় সরকার আবার লকডাউন দিয়েছে। যেকোনো দেশের অর্থনীতির জন্য এটা দুঃসংবাদ, কিন্তু উন্নয়নশীল দেশের জন্য এটা ভয়াবহ দুঃসংবাদ। গরিব মানুষ, যারা দিন আনি, দিন খাই করে বাঁচেন, তাঁদের কথা অপ্রত্যাশিতভাবে চিন্তা করে আর ফারিয়ার মুখে এ কথা শুনে খাবার খাওয়া বন্ধ হয়ে গেল জামিলের।
সে আজকেই গিয়েছিল পুরান ঢাকার কাজী আলাউদ্দিন রোডর ৭০ নম্বর হোল্ডিংয়ের দোকান হাজির বিরিয়ানি হোটেলে। বাবু এ বিরিয়ানি খেতে খুব পছন্দ করে। গিয়ে দেখেছে দোকানটির কাঠের ভাঁজ করা দরজার একপাশ ভেতর থেকে বন্ধ। সামনে সরু বারান্দা থাকা হোটেলের ভেতর চেয়ারগুলো টেবিলের ওপরে রাখা। সেখানের হাজি মোহাম্মদ আশু জানালেন, করোনার জন্য গত মাসের ২৪ তারিখ থেকে চুলা জ্বলছে না। বাবুর্চি, পরিবেশক মিলিয়ে প্রায় ২২ জন কর্মচারী ছিলেন। সবাইকে ছুটি দিয়েছেন। তাঁরা সবাই কাজ করলে মজুরি—এই চুক্তিতে কাজ করতেন। প্রতিষ্ঠান বন্ধ হওয়ায় যে যার মতো চলে গেছেন, কোনো মজুরি ছাড়াই।
সেই ১৯৩৯ সালে প্রতিষ্ঠা করা হাজি মোহাম্মদ হোসেনের ঐতিহ্যবাহী খাবারের দোকান ‘হাজির বিরিয়ানি’র হোটেল থেকে বিরিয়ানি না কিনেই ফিরতে হয়েছে জামিলকে। বাবুকে পদ্মার ইলিশই জোরাজুরি করে খাওয়াতে হবে। বাচ্চাটা মাছ খেতে একদমই চায় না। কে জানে হয়তো খাবেই না।
এখন জামিল ভাবছে, তারা তো তবু খেয়েপড়ে আছে। যারা কাজ করলে মজুরি এই চুক্তিতে নিয়োজিত ছিল তাদের কি অবস্থা এখন, আচম্বিতে মনে পড়ল জামিলের। নিম্ন আয়ের ওই প্রান্তিক শ্রমিকদের জন্য কোনো বিকল্প ব্যবস্থা ছাড়াই আয়ের পথ অনির্দিষ্ট কালের জন্য বন্ধ হয়েছে। এখন পরিবার পরিজন নিয়ে এসব শ্রমিকরা কি করছে? না খেয়েই কী আছে অসহায় মানুষগুলো?
কিছুটা মন খারাপ করেই জামিল ফারিয়াকে বলল,
—কে লোকটি? খুব গরিব বুঝি? কী কাজ করতো বলেছে কিছু?
—না গো, আমি অতো প্রশ্ন করিনি। একজন লোক সামান্য একটু খাবার চেয়েছে তাকে কি জিজ্ঞেস করি আবার? তবে কথাবার্তায় উচ্চশিক্ষিতই লাগলো। জানি না কি করতেন। বললেন একটু সমস্যা। তাই আমি আর বেশী কিছু জিজ্ঞেস করিনি। তুমি রাগ করেছ জামিল?
—ফারিয়া তুমি কী যে বলো না? এই ইলিশ মাছের ডিমটি দিয়ে দাও। নাও এই মাছটাও দাও।
—দিয়েছি তো দুই টুকরো।
—সমস্যা নেই, আরও এক টুকরো দাও।
ফারিয়া জানে তার স্বামীটি বেশ নরম মনের মানুষ।
জামিল দ্রুত খেয়ে নিজেই প্যাক করলো বক্সগুলো, বলল,
—একটু জেনো তো উনার পড়াশোনা কি। ২০১৯ সালেও আমার প্রতিষ্ঠানে কিছু লোক দরকার ছিল। ভালো বেতন দেব, পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়েও তখন লোক পাচ্ছিলাম না।
—বল কী? আমি উনার ফেসবুক আইডিটি তোমাকে দেখাই। দেশে কতো উচ্চশিক্ষিত বেকার ছেলেমেয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে, আর তুমি চেয়েও লোক পাচ্ছিলে না?
—না, পাচ্ছিলাম না। ইন্টারভিউ দিতে আসে, অনার্স–মাস্টার্স পাস করা তরুণেরা ইন্টারভিউ দিতে আসে, কিন্তু কিচ্ছু জানে না। ভার্সিটি থেকে ইংলিশে মাস্টার্স করে এসেছে, দুইটা সেনটেন্স শুদ্ধ করে ইংলিশ লিখতে পারে না। কথা বললেই বুঝি আইকিউ লেভেল খুব কম! দুনিয়ার কোনো খোঁজখবরই রাখে না।
—বাবুর আব্বু, আমি এ লোকটার ফেসবুক ওয়াল দেখেছি। বেশ পড়াশোনা জানা লোক বলে মনে হল।
—আচ্ছা আমি নীচে খাবারটা রেখে আসি ফারিয়া। তুমি উনাকে জানিয়ে দাও খাবার নীচে রাখা হয়েছে।
ছেলেবেলায় হাদিসের বই বুখারী শরীফ থেকে মা পড়ে শুনিয়েছিলেন, ‘আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘এক ব্যক্তি রাসুল (সা.)-কে প্রশ্ন করেন, ইসলামে কোন কাজটি শ্রেষ্ঠ? মহানবী (সা.) বলেন, ‘ইসলামে সবচেয়ে ভালো কাজ হচ্ছে ক্ষুধার্তকে খাবার খাওয়ানো।’, মনে পরে গেল নরম হৃদয়ের জামিলের। প্রয়াত মায়ের কথা ভেবেও চোখে কোণে জল তার।
(২)
“মিথ্যা শুনিনি ভাই
এই হৃদয়ের চেয়ে বড় কোনো মন্দির কাবা নাই”
দ্রোহের কবি, সাম্যের কবি, বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম যথার্থই বলেছেন।
অ্যামাজনের মালিক জেফ বেজোস পৃথিবীর ধনীতম মানুষ। আর তিনিই ফেলে আসা বছরে দান করার বিষয়েও ছিলেন সবচেয়ে এগিয়ে। পৃথিবীর সর্বোচ্চ দাতাদের তালিকায় সবার উপরে আছেন বেজোস। তিনি ২০২০ সালে দান করেছেন ১ হাজার কোটি মার্কিন ডলার।
ফ্রেড ক্যুউমার ও তাঁর স্ত্রী দান করেছেন প্রায় ৩০ কোটি মার্কিন ডলার।
যে ফেসবুকে লিখছি সেই ফেসবুকে প্রতিষ্ঠাতা মার্ক জাকারবার্গ ও তাঁর স্ত্রী দান করেছেন প্রায় ২৫ কোটি মার্কিন ডলার।
আমরা অতো ধনী নই। আমাদের অতো টাকা নেই। আমরা তৃতীয় বিশ্বের অতি সাধারণ মানুষ। বাংলাদেশের নাগরিক।
১৪ এপ্রিল থেকে আমাদের দেশে সর্বাত্মক লকডাউন দিয়েছে ক্ষমতাসীন সরকার। ভাষ্য, দেশে করোনার সংক্রমণ ভয়াবহ রূপ নিয়েছে, লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে সংক্রমণ ও মৃত্যুর হার। সঙ্গে বাড়ছে জনগণের অবহেলা ও উদাসীনতা। এমতাবস্থায় তারা তাই জনস্বার্থে ১৪ এপ্রিল থেকে সর্বাত্মক লকডাউন সক্রিয় ভাবে বাস্তবায়ন করবেন।
এরপর থেকে শুধু জরুরি সেবা ছাড়া আর কোনো কিছুই চলছে না। কোন বিষয়ে নমনীয়তা দেখানো হচ্ছে না।
এ ধরনের নিষেধাজ্ঞায় অনেক কিছু বন্ধ বা সীমিত পরিসরে চালু থাকলে সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়েন নিম্ন আয়ের মানুষ, দিন এনে দিন খাওয়া শ্রমজীবী মানুষ, বস্তিবাসী। তাদের তাৎক্ষণিক সহায়তা, খাদ্যের যোগান দেওয়া বিষয়ে কোনো কিছু বলা হয়নি সরকারি ঘোষণায়।
লকডাউন বা এই নিষেধাজ্ঞাকালীন করণীয় কী? পরিবহন শ্রমিক, দিনমজুরদের কাজ থাকবে না। তারা কী করবেন?
নিষেধাজ্ঞার ঘোষণায় এসব গরিব মানুষের কথা ভাবা হয়নি। বিবেচনায় নেওয়া হয়নি ক্ষুধা যে করোনার চেয়েও ভয়ঙ্কর। খাদ্যের জোগান দিতে না পারলে গরিব মানুষকে যে ঘরে রাখা যাবে না, তা ভাবা হয়নি। ঘোষণায় সামগ্রিক পরিকল্পনার ছাপ দৃশ্যমান হয়নি।
আমরা ক’জন তরুণ আমাদের যা আছে তা দিয়েই এসব অসহায় মানুষের জন্য কিছু করার কথা ভেবে কাজ করছি।
ঢাকায় সেদিন আমরা উত্তরখান কাচকুরা বাজারের পাশে এক বস্তিতে খাবার দিয়েছিলাম। ওখানে প্রায় চল্লিশটি শিশু ছিল। ওদের মায়েরা আমাদের কাছে অনুরোধ করেছিলেন যেন আমরা বাচ্চাগুলোর জন্য একটু দুধের ব্যবস্থা করে দিই।
আমরা জানি সবাই আমরা খুব কঠিন সময় পার করছি। আমরা, আমি আর আপু খুব চাচ্ছিলাম, যদি আমরা কিছু মানুষ মিলে ১ কেজি করে গুঁড়োদুধ পঞ্চাশটি শিশুর জন্য যদি ব্যবস্থা করে দিতে পারি তাহলে ওরা কয়েকদিন একটু পুষ্টি পেতো।
যেই ভাবা সেই কাজ। আমরা যোগাযোগ করেছিলাম বিভিন্ন জায়গায়। দৈবক্রমে এত সাড়া পেয়েছি যা অভাবনীয়। পঞ্চাশজন শিশুর দুধ আমরা যোগাড় করতে পেরেছিলাম।
খুশির খবর আরও, ডানো দুধ কোম্পানির সাথে কথা বলার পর তারা আমাদের স্পেশাল একটা দামে দিয়েছিল দুধ। তাই আমরা একেকজনকে দেড় কেজি করে গুঁড়ো দুধ দিতে পেরেছিলাম।
এমন অনেক দিন গেছে, আমরা সকালে বের হয়েছি, বাসায় ফিরেছি রাতে। ছোট ছোট সন্তান আমাদেরও রয়েছে। ওদের এবং পরিবারের সদস্যদের ঝুঁকিতে রেখেও মানবতার জন্য মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছি আমরা। তবে এতে আনন্দ এবং তৃপ্তি খুঁজে পেয়েছি কারণ মানবতার কল্যাণে বিবেকের তাড়নায় করোনার কারণে পরিস্থিতির শিকার মানুষদের পাশে দাঁড়াতে চেয়েছিলাম আমরা, আমাদের যা আছে তা নিয়েই।
দুধ ১৫ এপ্রিল শিশুদের কাছে পৌঁছে দিয়েছিলাম আমরা। এ কাজ করেই আমরা থেমে থাকিনি।
পাঁচ রোজা পর্যন্ত আমরা আমাদের আরেকটি প্রোগ্রামের প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছি। রোজার ত্রিশ দিন আমরা বিনামূল্যে দুশো অসহায় মানুষদের ইফতার করানোর চেষ্টা করব বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
রাজিয়া হক কনক আপুর অনেকগুলো উদ্যোগের সাথে আমরা রাইজিং স্টার চ্যারিটি টিম মিলে নিরলস ভাবে কাজ করে যাচ্ছি।
আচ্ছা সাহিত্য রচনা বন্ধ করছি। ক্ষুধাপীড়িত এই পৃথিবীতে সাহিত্যচর্চা করবো না। সাহিত্যচর্চার জন্য চাই শোক-দুঃখ ও জরামুক্ত এক পৃথিবী।
যখন থমকে গেছে অনেক কিছুই, সেই মুহূর্তে সাধারণভাবেই আমাকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সক্রিয় থাকতে হয় সবার সাথে যোগাযোগ রাখতে।
এমন সময়ে একজনের একটি আবেদন আমার মনকে আলোড়িত করলো। আমি মানুষটিকে বললাম,
—আপনি ফেসবুকে আবির আহমেদ খান নামে আমাকে পাবেন। আপনি সেখানে নক করুন। দেখি কি করা যায়।
—আচ্ছা।
আমি রাজিয়া হক কনক আপুকে জানালাম। আপু শুনে খুব দুঃখিত হলেন। বললেন,
—কিন্তু কি করবো? এখন রাত এগারোটা। লোকটি কই আর আমি কই আর তুমি কই আবির?
—কনক আপু কিছুই কি করা যায় না? উনার লোকেশনে কেউই কি নেই আমাদের?
—দেখছি আমি ভাই আবির।
—আপু আমি উনার সাথে কথা বলেছি একটু আগে। তার চোখে জল। সারাদিন শুধু এক বেলা খেয়েছেন।
—তাই আবির? আচ্ছা আমরা খাওয়াবোই লোকটিকে।
আমি আর আপু মিলে অসাধ্য সাধন করলাম। রাত সাড়ে এগারোটায় মানুষটিকে খাবারের ব্যাবস্থা করে দিলাম।
আপু আর আমি ঘোষণা করেছি, ‘একজন মানুষের রান্না করা খাবার প্রয়োজন। তাকে একটু রান্না করা খাবার দিতে পারবেন এমন কেউ আছেন? দুই বেলা? আমরা অর্থ দেব, শুধু রান্না করে খাবারটা রাখবেন , উনি এসে নিয়ে যাবেন।‘ অর্থাভাবে থমকে থাকবে একজনের খাবার খাওয়া, এটা মেনে নেওয়া যায় না।
সাহায্যের জন্য যথার্থ লোককে ‘ট্যাগ’ করে সমাজমাধ্যমে পোস্ট করেছি আমরা। তা দেখেই নিশ্চয়ই তৎপর হবেন কোনও না কোনও মানবিক মানুষ।
লকডাউনে দুঃখে থাকা শ্রমিকদের জন্য সামান্য উদ্যোগ, কখনও হাসপাতালের রোগীর আত্মীয়দের খাবার বিলি— নানা কাজেই দেখা যাবে আমাদের রাইজিং স্টার চ্যারিটি টিমকে।
(৩)
লোকটির শরীর খারাপ করেছে। ধনীরা চিকিৎসায় স্বদেশ-বিদেশ করতে পারেন। তিনি এক ধনী ব্যক্তির বিদেশে চিকিৎসার বর্ণনা শুনেছিলেন। সিঙ্গাপুরের চিকিৎসক। বাংলাদেশী রোগীর চিকিৎসা করবেন। রোগী ধনী। ওই বিদেশী চিকিৎসক সাহেবের ফি প্রথম আধা ঘণ্টায় ১৫০ সিঙ্গাপুরি ডলার, অর্থাৎ ৯ হাজার টাকা। যত বেশি কথা বলেছেন, অর্থাৎ যত মিনিট সময় দিয়েছেন, ততো অতিরিক্ত সিঙ্গাপুরি ডলার যোগ হবে।
এসব তার কাছে রূপকথার মতো শোনায়। তার এতো টাকা নেই। কোনও টাকাই নেই। উপরন্তু সরকারী হাসপাতালের সাধারণ চিকিৎসা নেবার সুযোগও কম এই সময়ে। সর্বত্রই ঠিকঠাক চিকিৎসা পাচ্ছেন না সাধারণ রোগীরা।
এই করোনা মহামারীর সময়ে অনেক প্রাইভেট চেম্বার বন্ধ। হাসপাতাল ঘুরে ঘুরে রোগী নিয়ে বিপাকে স্বজনরা, সাধারণ পরীক্ষা করানোও দুষ্কর, দুর্ভোগের শেষ নেই। চিকিৎসা না পেয়েই মারা যাচ্ছেন, মরে গিয়েছেন অনেকে। কোভিড-১৯ টেস্টের রিপোর্ট সঙ্গে না থাকায় হাসপাতাল থেকে চিকিৎসা না দিয়ে রোগীকে ফিরিয়ে দেয়া, রাস্তায় অজানা গন্তব্যে ঠেলে দেয়া, অ্যাম্বুলেন্সে হাসপাতালের পর হাসপাতাল ঘুরে বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়ার মতো অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি ঘটনা গত এক বছরের বেশী সময় ধরে যেন নৈমিত্তিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে।
লোকটি খেতে পারেন না। খাবার কেনার টাকা নেই। দীর্ঘদিন অনাহারে-অর্ধাহারে থাকার ফলে এখন অবস্থা এমন হয়েছে, খাবার সামনে থাকলেও খেতে ইচ্ছে করে না। খেতে মন চায় না। খিদে আছে কিন্তু খেতে পারছেন না। সময় ও সুযোগের অভাব বা মান-অভিমান যে কারণেই হোক না কেনো যদি অনেকক্ষণ পর খাবার খাওয়া হয় তবে তা শরীরে খারাপ প্রভাব ফেলে, আর লোকটি তো দিনের পর দিন না খেয়ে থাকা রপ্ত করেছে।
প্রথম প্রথম যখন না খেয়ে থাকতেন, তখনই পেট ব্যথা, মাথা ব্যথা, বমিবমি ভাব ও পেটে গ্যাস হওয়া ইত্যাদি সমস্যা দেখা দিলো। না খেয়ে কত দিন বাঁচা সম্ভব?
সবচেয়ে বেশি দিন না খেয়ে বেঁচে ছিলেন পাকিস্তানের কাশ্মীরে ৪০ বছর বয়সী নকশা বিবি। ২০০৫ সালের ভূমিকম্পে ধসে যাওয়া ঘরে ৬৩ দিন বেঁচে ছিলেন পচে যাওয়া খাবার খেয়ে আর অল্প কিছু চুইয়ে পড়া পানির সরবরাহে।
একদম না খেয়ে ঠিক কত দিন বাঁচা যায় তা হিসাব করা দুরূহ।
ভুক্তভোগী লোকটি মরে গেলেন। বয়স, শারীরিক সুস্থতা, ওজন, কাজের মাত্রা, জিনগত বৈশিষ্ট্য, মনোবল, পরিবেশের তাপমাত্রা ইত্যাদির ওপর একজন মানুষের বেঁচে থাকা নির্ভর করে। তিনি ওসব বিষয়ে ডাহা ফেল করে মরে গেলেন।
মরে গিয়েও কি বেঁচে গেলেন? ভেতর থেকে দরজা বন্ধ ছিলো কিন্তু লোকটির সাড়াশব্দ পাওয়া যাচ্ছিল না। দরজা ভেঙ্গে তার মৃতদেহ দেখতে পাওয়া যায়। মৃতদেহটির পায়ের দিকটি বাথরুমের ভেতরে ও বাকী অংশ বাইরের দিকে। দরজায় কাত হয়ে পড়েছিলেন এবং সেখানে বমি করেছিলেন তিনি।
একটা বছরের বেশী সময় জুড়ে সারাদেশে কোথাও সাহায্য না পেয়ে মৃত্যু, কোথাও ঘণ্টার পর ঘণ্টা পড়ে মৃতদেহ, এসব ঘটনার কথা জানা গিয়েছে! করোনা আতঙ্কে বাংলাদেশ জুড়ে অমানবিকতার ছবি দেখা গিয়েছিল।
মরে গিয়ে বেঁচে যাওয়া লোকটির কিন্তু ময়নাতদন্তও করা হয়েছিল। ময়নাতদন্তের চূড়ান্ত রিপোর্ট বলছে, আকস্মিক মৃত্যু হয়েছে তার। মৃতদেহে কোন আঘাতের চিহ্নও মেলেনি। অনেক ক্ষণ খালি পেটেও ছিলেন। বহু ক্ষণ না খেয়ে থাকা, এক সঙ্গে প্রচুর ওষুধ খেয়ে ফেলা, এই সব মিলিয়েই লোকটির শরীরে প্রাণঘাতী বিষক্রিয়া ঘটে বলে অনুমান। এ মৃত্যু করোনা আক্রান্ত হয়ে নয়। আদৌ তিনি করোনা আক্রান্ত কি না, কেউ জানতেনও না কিন্তু! এক বছর আগে, মৃত্যুর পরে টানা প্রায় সাত ঘণ্টা পড়ে ছিল নারায়ণগঞ্জে গিটারিস্ট খাইরুল আলম হিরোর দেহ। করোনা আতঙ্কে দেহ ছুঁয়েও দেখলেন না এলাকার মানুষ। মৃতের পরিবার, আত্মীয়স্বজনও প্রাথমিক ভাবে দেহে হাত দেননি বলে জানা যায়।
করোনা আবহে সোশ্যাল ডিস্ট্যান্সিং মানতে গিয়ে ক্রমেই যেন অমানবিক হয়ে উঠছিল মানুষ।
লাশকাটা ঘরে যখন চেরা হচ্ছিল তার বুক, তখন নারায়ণগঞ্জে ‘টিম খোরশেদ’র করোনা যুদ্ধের ১ বছর পূর্তি হচ্ছিল।
পাশের ঘরে মৃত স্বামীর লাশও দেখতে যাননি স্ত্রী, এমনকি কারও পিতার লাশটি শ্মশানে দাহ করার লোকও ছিল না- ঠিক এমন সময়ে করোনার মধ্যেই মাঠে নেমেছিলেন নারায়ণগঞ্জের কাউন্সিলর মাকসুদুল আলম খন্দকার খোরশেদ।
করোনা আক্রান্ত ব্যক্তিদের দাফন করাই নয়, অনেক হিন্দু ধর্মাবলম্বীর মুখাগ্নিও করেছেন এই করোনা বীর।
এসব কাজে তিনি নেননি কোনো আর্থিক মূল্য কিংবা বিনিময়। তার এ যুদ্ধে সাহস পেয়েছে পুরো দেশ এবং একে একে এগিয়ে এসেছে অনেকেই এসব কার্যক্রমে। অনুপ্রেরণার উৎস হিসেবে খোরশেদ যেন এক নতুন সৈনিক; যে কিনা অদৃশ্য এক শক্তির বিরুদ্ধে লড়াইটা অব্যাহত রেখেছেন।
করোনায় মৃতদের সৎকারে সংক্রমণের ঝুঁকি থাকে। তাই বেওয়ারিশ মরদেহ দাফন কার্যক্রম স্থগিত করেছিল লাশ দাফনের বৃহৎ সংস্থা আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম। তবে পর্যাপ্ত সুরক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে সৎকার কার্যক্রম আবারও শুরু করে তারা। ঢাকায় করোনায় মৃতদেহ সৎকারের জন্য রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির সঙ্গে একটি সমঝোতা স্মারক সই করেছে তারা। প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃত ব্যক্তিদের লাশ দাফনে প্রথম দিকে আত্মীয়-স্বজনরাও এগিয়ে আসেনি। এনজিও আল-মারকাজুল ইসলামী করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত ও সন্দেহভাজন মৃত ব্যক্তিদের লাশ দাফনে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছে।
ফারিয়া-জামিল দম্পতি অথবা আবির আহমেদ খান-রাজিয়া হক কনকের রাইজিং স্টার চ্যারিটি টিম, মাকসুদুল আলম খন্দকার খোরশেদ বা ‘টিম খোরশেদ’, আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম, রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি, এনজিও আল-মারকাজুল ইসলামীর মতো সংস্থাগুলোর পেছনের মানুষগুলো বা করোনার সময়েও অ্যাম্বুল্যান্স বা শববাহী গাড়ী চালান যারা—তারা কি মানুষ?
সারা বিশ্বে যখন করোনা থাবা মেরেছিলো, সারা বিশ্বকে গৃহবন্দী করেছিল করোনা নামক মারণ ভাইরাস তখন কেউ ঘর থেকে বেরোনোর সাহস পেত না। সেই দুঃসময়ে দেবদূতের মত অসহায় মানুষের জন্য নিবেদিত হয়েছেন তারা। প্রত্যেকেই তারা সত্যিকারের এক-একজন নায়ক। মানুষের মনের গভীরে জায়গা করে নিয়েছেন তারা। প্রত্যেকেই তারা এই মহানুভবতার জন্য কিছুর আশা করেন না। উন্নয়নের ঘোড়দৌড়ে বিপন্ন মানবতার তারা রক্ষক।
কবি শেখ ফজলল করিমের একটি কবিতা আছে৷ সেই কবিতায় শুধু বেহেশত বা স্বর্গ নয়, দোজখ বা নরক সম্পর্কেও ধারণা দেয়া আছে৷ কবিতার নামই ‘স্বর্গ ও নরক'৷ সেখানে শেখ ফজলল করিম লিখেছিলেন—
‘‘কোথায় স্বর্গ, কোথায় নরক, কে বলে তা বহুদূর?
মানুষেরই মাঝে স্বর্গ নরক, মানুষেতে সুরাসুর!
রিপুর তাড়নে যখনই মোদের বিবেক পায় গো লয়,
আত্মগ্লানির নরক-অনলে তখনি পুড়িতে হয়৷
প্রীতি ও প্রেমের পূণ্য বাঁধনে যবে মিলি পরষ্পরে,
স্বর্গ আসিয়া দাঁড়ায় তখন আমাদেরি কুঁড়ে ঘরে৷''
লেখকঃ নীলাভ আহমেদ
আগামীনিউজ/এএস