ঢাকাঃ ডালিম বা আনার উৎপাদন ও রফতানি শীর্ষ দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে আফগানিস্তান। দেশটিতে প্রচুর পরিমাণ ডালিম চাষ হয়। তবে এতদিন সাধারণ ফল হিসেবে ডালিম রফতানি হলেও এখন সেটি পানীয় আকারে রফতানি হচ্ছে। পামির কোলার শাফা নামের পানীয়টি বিশ্বজুড়ে তোলপাড় ফেলেছে। এটিকে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি বিক্রিত কোকাকোলার বিকল্প এবং স্বাস্থ্যকর পানীয় হিসেবে ভাবা হচ্ছে।
চলতি বলছের জুলাই মাসে এক প্রতিবেদনে আফগানিস্তানের সংবাদমাধ্যম টোলো নিউজ জানায় যে, প্রথমবারের মতো আফগানিস্তান থেকে ডালিমের তৈরি পানীয় আমদানি করছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।
সেই সময় আফগানিস্তানের শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয় (এমওআইসি) জানায় যে, ডালিমের পানীয়ের একটি চালান আফগানিস্তান থেকে প্রথমবারের মতো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রফতানি হয়েছে। ডালিমের কোমল পানীয় উৎপাদন করেছে হেরাতের একটি কোম্পানি।
মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র আখুন্দজাদ আবদুল সালাম জাভাদ জানান, এই দেশীয় পণ্যের রফতানি আফগানিস্তানের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধিতে একটি উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ।
তিনি জানান, 'সম্প্রতি, পামির কোলা কোম্পানির ৪৫ টন ডালিমের পানীয় বহনকারী দুটি কন্টেইনার যুক্তরাষ্ট্রে পাঠানো হয়েছে। এছাড়াও, পানীয়গুলো জার্মানি এবং কাজাখস্তানেও পাঠানো হয়েছে। এছাড়া তারা তুরস্ক, ভারত, পাকিস্তানেও এটি রফতানি করে। এখন এই পণ্য বিশ্বজুড়ে রফতানি করার স্বপ্ন দেখছে আফগানিস্তান।'
পামির কোলা কোম্পানির বিক্রয় ব্যবস্থাপক বলেছেন যে, এই সংস্থাটি ইরান, সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং মধ্য এশিয়ার দেশগুলোতেও এই পানীয় রফতানি করেছে।
অর্থনীতিবিদদের মতে, অভ্যন্তরীণ পণ্য রফতানি সম্প্রসারণ আফগানিস্তানের অর্থনীতির বৃদ্ধি এবং জনগণের জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগ দিতে সাহায্য করতে পারে।
অর্থনীতিবিদ আবদুল নাসির রেশতিয়া বলেন, 'দেশ আরও বিনিয়োগকে উৎসাহিত করবে এবং রফতানি বাড়লে এবং সরকার আরও সুযোগ-সুবিধা দিলে বিনিয়োগের ঋণ বাড়বে।'
চলতি বছরে আফগানিস্তানের তালেবান সরকারের শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতায় চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট শতাধিক দেশি-বিদেশি ব্যবসায়ীদের অংশগ্রহণে এক সপ্তাহব্যাপী জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রদর্শনীর আয়োজন করে।
এদিকে চীনে একটি বড় আন্তর্জাতিক প্রদর্শনীতে ডালিম পাঠান আফগানিস্তানের কয়েকজন কৃষক। ওই প্রদর্শনীতে আফগানিস্তানের ডালিম ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করে। এতে উল্লসিত আফগানিস্তানের কৃষকরা। তাদের মধ্যে একজন কৃষক সাইদ মোহাম্মদ।
আফগানিস্তানের কৃষক সাইদ মোহাম্মদ বলেন, 'আমি ১০ একর জমির ডালিম সংগ্রহ করেছি (এ বছর থেকে)। চীনে ডালিম পাঠানো খুবই ভালো। কারণ আমাদের ডালিম চীনে রফতানি করলে শুধু (আফগান) কৃষকই নয়, সমগ্র দেশ এবং জনগণ উপকৃত হবে।'
সাইদ মোহাম্মদ দক্ষিণ কান্দাহার প্রদেশের আরগান্দাদ উপত্যকায় বাস করেন। এটি আফগানিস্তানের একটি প্রধান ডালিম উৎপাদনকারী এলাকা।
আফগানদের জন্য শরৎ হল ডালিমের ঋতু। কান্দাহার, কাবুল, বা উত্তরের পাহাড়ের কাউন্টি যাই হোক না কেন, রাস্তায় সব জায়গায় তাজা ডালিম এবং ফলের রস বিক্রি করতে দেখা যায়।
চীনে আফগানিস্তানের ডালিম পৌঁছানো এবং ডালিম রফতানির সঙ্গে যুক্ত ফয়েজ বলেন, আমরা প্রাথমিকভাবে প্রদর্শনীতে ২০০ কেজি ডালিম পাঠিয়েছিলাম। সেগুলো প্রথমে কান্দাহার থেকে স্থলপথে কাবুলে পৌঁছেছিল। সেখান থেকে বিমানে দুবাই এবং পরে চীনের সাংহাইয়ে পৌঁছেছিল।
এর আগে ২০২০ সালে চীনের প্রদর্শনীতে আফগানিস্তানের হাতে বোনা কার্পেট প্রদর্শন করেছিলেন ফয়েজ। সেই সময় চীনজুড়ে দুই হাজারের বেশি কার্পেটের অর্ডার পেয়েছিলেন তিনি। যেটির মাধ্যমে প্রায় দুই হাজার আফগান পরিবার সারা বছরের আয় করেছেন।
ফয়েজ মনে করেন, আফগানিস্তানের ডালিমও বিশ্বজুড়ে শিগগিরই পৌঁছে যাবে এবং দেশটির রফতানিযোগ্য প্রধান পণ্য হয়ে উঠবে।
আফগান ফল বিক্রেতাদের মতে, ডালিম হলো দেশের কৃষকদের জন্য সবচেয়ে লাভজনক ফসল। এর অর্থনৈতিক মূল্য আঙ্গুর, আপেল এবং পার্বত্য দেশে উৎপাদিত অন্যান্য ঐতিহ্যবাহী ফলের তুলনায় বেশি।
ফয়েজের ব্যবসায়িক অংশীদার মেরাজুদ্দিন আমিরি ২০০৬ সাল থেকে ফল ও বাদাম ব্যবসায় জড়িত। তিনি বলেন, এই বছর শুধু কান্দাহারেই দেড় লাখ টন ডালিম উৎপাদিত হয়েছে।
চীনের এক্সপোতে ডালিমের আত্মপ্রকাশ দেখে আমিরিও আনন্দিত। তিনি বলেন, 'আমরা আফগানিস্তান ও চীনের মধ্যে বাণিজ্যের আরো সম্প্রসারণ ও উন্নয়ন দেখতে চাই।'
তিনি বলেন, আফগানিস্তানে আফিম তথা পপি চাষের দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। তবে এখন সেটি শেষ হচ্ছে। ২০২২ সালে এর ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের পর কৃষকরা ডালিম, গম এবং অন্যান্য ফসল চাষ করছেন। আরও ডালিম উৎপাদন যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্তানে ব্যাপক পরিবর্তন আনবে।
আফগানিস্তানে বছরে ৬ লাখ টনের বেশি ডালিম উৎপাদিত হয়। এটি বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ ডালিম উৎপাদনকারী দেশ। আফগানিস্তানের ৩৪টি প্রদেশের মধ্যে ৩৩টিতে ডালিম চাষ করা হয়। এর মধ্যে কান্দাহার, হেলমান্দ, ফারাহ, হেরাত এবং বলখ সবচেয়ে বেশি ডালিম উৎপাদনকারী এলাকা।
ইউনাইটেড স্টেটস এজেন্সি ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট (ইউএসএআইডি) এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, আন্তর্জাতিক বাজারে ডালিমের রস প্রতি লিটারে ৪ ডলার পর্যন্ত দামে বিক্রি হয়। আর তাজা ডালিম বিশ্বে বিক্রি হয় গড়ে ০.৫ ডলার বা প্রায় ৫০ টাকা দামে।
সূত্র: টোলো নিউজ, সিনহুয়া, খামা প্রেস ও আরিয়ানা নিউজ।
এমআইসি/