ঢাকাঃ অনলাইন প্ল্যাটফর্মে টিকটক, বিগো লাইভ, লাইকি, পাবজি, ফ্রি ফায়ারের মতো গেম ও অ্যাপসের নেশায় উঠতি বয়সীরা। স্বল্প সময়ে স্টার হতে তাদের মধ্যে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে আসক্তি। চটকদারি কথাবার্তা ও অশ্লীল উত্তেজক কথাবার্তায় তৈরি করছে ভিডিও ক্লিপস। ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে নেট দুনিয়ায়। লাইক ও শেয়ার বাড়াতে তৈরি করা হচ্ছে সংঘবদ্ধচক্র, তৈরি হচ্ছে কিশোর ও কিশোরী গ্যাং কালচার।
এদিকে মডেল হওয়ার কথা বলে মেয়েদের দিয়ে করানো হচ্ছে নানা অপকর্ম। রাজি না হলে ফাঁদে ফেলে চলছে নির্যাতনও। অন্যদিকে গেমসের নেশায় বুদ হয়ে আছে শিশু-কিশোররা। এসব গেমস পড়ালেখায় আগ্রহ কমিয়ে বাড়াচ্ছে সহিংসতা। ফলে বাড়ন্ত শিশু-কিশোরদের মধ্য থেকে দিন দিন সামাজিক দায়বদ্ধতা মুছে যাচ্ছে। মাদকের নেশাও গিলে খাচ্ছে তাদের। মেধাহীন ভবিষ্যৎ প্রজন্মের আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।
সম্প্রতি ভারতে তরুণী নির্যাতনের ঘটনায় টিকটক নিয়ে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দেয়। ওই ঘটনায় ভিডিও ভাইরাল হওয়ার পর যে কয়জন টিকটকারের নাম উঠে আসে তাদের হোতা ছিল হৃদয়। তাকেসহ দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে অশ্লীল ভিডিও কন্টেন্ট তৈরিকারী টিকটকারদের গ্রেফতার করে পুলিশ। এরপরও থেমে নেই টিকটক, বিগো লাইভ, পাবজি, লাইকি। ফ্রি ফায়ারের মতো গেমসে জড়াতে দেখা যাচ্ছে যুবসমাজকেও।
বাংলাদেশে সকল অনলাইন প্লাটফর্ম থেকে টিকটক, বিগো লাইভ, পাবজি, ফ্রি ফায়ার ও লাইকির মতো সকল প্রকার অনলাইন গেম এবং অ্যাপস বন্ধে আইনি (লিগ্যাল) নোটিশ পাঠানো হয়েছে। গত শনিবার (১৯ জুন) মানবাধিকার সংগঠন ‘ল অ্যান্ড লাইফ’ ফাউন্ডেশনের পক্ষে সুপ্রিম কোর্টের দুই আইনজীবী ব্যারিস্টার মোহাম্মদ হুমায়ন কবির পল্লব এবং ব্যারিস্টার মোহাম্মদ কাউছার এ নোটিশ পাঠান। নোটিশে ডাক ও টেলিযোগাযোগ সচিব, বিটিআরসি চেয়ারম্যান, শিক্ষা সচিব, স্বরাষ্ট্র সচিব, আইন সচিব, স্বাস্থ্য সচিব এবং পুলিশ প্রধানকে বিবাদী করা হয়েছে। নোটিশে ক্ষতিকর গেমস ও অ্যাপস বন্ধে ৪৮ ঘণ্টা সময় দেওয়া হয়েছে। অন্যথায় জনস্বার্থে হাইকোর্টে রিট দায়ের করা হবে বলে নোটিশে উল্লেখ করা হয়েছে।
নোটিশে বলা হয়েছে, পাবজি এবং ফ্রি ফায়ারের মতো গেমগুলোতে বাংলাদেশের যুব সমাজ এবং শিশু-কিশোররা ব্যাপকভাবে আসক্ত হয়ে পড়েছে। যার ফলে সামাজিক মূল্যবোধ, শিক্ষা, সংস্কৃতি বিনষ্ট হচ্ছে এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্ম হয়ে পড়ছে মেধাহীন। এসব গেমস যেন যুব সমাজকে সহিংসতা প্রশিক্ষণের এক কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠছে। দেশের সকল অনলাইন প্ল্যাটফর্ম থেকে টিকটক, বিগো লাইভ, পাবজি, ফ্রি ফায়ার গেম ও লাইকির মতো সকল প্রকার অনলাইন গেমস এবং অ্যাপস বন্ধে সরকারকে বলা হয়েছে। নোটিশকারী আইনজীবী ব্যারিস্টার মোহাম্মদ হুমায়ন কবির পল্লব বলেন, ‘আগামী ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে এগুলো বন্ধের ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে তাদের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে রিট দায়ের করা হবে।’
অভিভাবকদের একজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ‘করোনার এ দুঃসময়েও অষ্টম শ্রেণি পড়ুয়া ছেলের জন্য কিনে দিতে হয়েছে স্মার্টফোন। সে সময় বুঝিনি এমন অবস্থা তৈরি হবে। এখন ক্লাসের পাশাপাশি গেমসে আসক্ত হয়ে পড়েছে ছেলে। কথা বললেও শুনছে না। আবার মোবাইল কেড়ে নেওয়াও যাচ্ছে না। ফলে বিপদেই আছি।’
আরও কয়েকজন চাকরিজীবী অভিভাবকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, দিন দিন নতুন নতুন গেমস আসছে। একটি বন্ধ হলে অন্যটি এসে ভিড় করছে। ফলে গেমস বন্ধ করা কঠিন। তাদের অনেকেই স্বামী-স্ত্রী দুজনই চাকরিজীবী। ফলে চোখে চোখে রাখা অসম্ভব বলছেন তারা। ফলে এসব অ্যাপস ও গেমস বন্ধের কোনো বিকল্প দেখছেন না। তারা গেমস আতঙ্কে আছেন বলেও জানান।
তবে গেমস ও বিভিন্ন অ্যাপস বন্ধের নোটিসে খুশি অভিভাবকরা। এ বিষয়ে সরকার যথাযথ পদক্ষেপ নেবে বলে আশা করেন তারা।
আইনি নোটিশে বিবাদীদের অনলাইন প্ল্যাটফর্ম থেকে ক্ষতিকর অ্যাপস অবিলম্বে অপসারণ এবং লিংক বন্ধ করার অনুরোধ করা হয়েছে। একই সঙ্গে বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করার জন্য মনিটরিং, ইভাল্যুয়েশন ও সুপারিশ কমিটি গঠন করার অনুরোধ করা হয়েছে। এতে সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন অভিভাবকরা। যদিও এমন নোটিসে হতাশ টিকটক স্টারদের অনেকেই।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে দুজন টিকটক স্টার বলেন, ‘এটা কোনো সমাধান নয়। সবাই তো আর খারাপ কিছু করছেন না। ভালো কিছুও হচ্ছে। অ্যাপস বন্ধ না করে বরং নজরদারিতে রাখা উচিত।’
গেমসের বিষয়েও একই ধরনের যুক্তি খেলোয়াড়দের। তারা বলছেন, করোনায় বাইরে বের হওয়া নিষেধ। ঘরে বসে থেকে গেমস খেলে সময় কাটায়। বন্ধ হয়ে গেলে অনেকেই ঘরে বসে থাকবে না। ফলে হিতে বিপরীত হতে পারে।
যদিও ভয়াবহতা বুঝতে পেরে ইতিমধ্যে নেপাল ও ভারতের কয়েকটি রাজ্য অনলাইন গেমস পাবজি ও ফ্রি-ফায়ার বন্ধ করে দিয়েছে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কথা চিন্তা করে বাংলাদেশেও একই পদক্ষেপ নেওয়া উচিত বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, গেমগুলো আসলে যারা খেলে তাদের মস্তিষ্কে কিছু কেমিক্যাল পদার্থ নিঃসরণ হয়। খেলোয়াড়, সে শিশু হোক বা বড় হোক, সবার মধ্যেই এই ক্রিয়া চলতে থাকে। বারবার সেই গেমটি খেলার জন্য তাকে প্ররোচিত করে। যেটাকে আমরা বলি নির্ভরশীলতা বা আসক্তি। শিশু-কিশোরদের মানসিক বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করে। তাদের আক্রমণাত্মক করে তোলে।