ধানের তুলনায় বছরজুড়ে বাজারে ভুট্টার দাম ভালো থাকে। ধান, গমসহ অন্যান্য ফসলের তুলনায় ভুট্টার উৎপাদন ব্যয়ও কম হয়। রোগবালাইয়ের ঝুঁকি নেই বললেই চলে। এজন্য কয়েক বছর ধরে ভুট্টার আবাদ বাড়িয়েছেন নওগাঁর বিভিন্ন উপজেলার কৃষকরা। গত পাঁচ বছরের ব্যবধানে জেলায় ভুট্টার আবাদ বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে।
নওগাঁ জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছর জেলায় প্রায় ৭ হাজার ১৪৫ হেক্টর জমিতে ভুট্টার আবাদ হয়েছে, যা গত বছরের তুলনায় ২৮৫ হেক্টর বেশি। এর মধ্যে সদর উপজেলায় ২৫৫ হেক্টর, রানীনগরে ৪২০, আত্রাইয়ে ৫ হাজার ১৫০, বদলগাছীতে ৮০, মহাদেবপুরে ১২০, পত্নীতলায় ৩৫, ধামইরহাটে ৩৯০, সাপাহারে ২০, পোরশায় ১৫, মান্দায় ৬১৫ ও নিয়ামতপুরে ৪৫ হেক্টর জমিতে ভুট্টার আবাদ হয়েছে। এছাড়া প্রদর্শনী রয়েছে ৩০০টি। এসব জমিতে উন্নত মানের সুপারশাইন, মিরাক্কেল, ডন ও ১১১ জাতের ভুট্টা আবাদ করা হয়েছে।
২০১৮-১৯ মৌসুমে জেলায় ৬ হাজার ৮৬০ হেক্টর জমিতে ভুট্টার আবাদ হয়েছিল। এছাড়া ২০১৭-১৮ মৌসুমে ৬ হাজার ২২০, ২০১৬-১৭ মৌসুমে ৪ হাজার ৫০০ ও ২০১৫-১৬ মৌসুমে ৩ হাজার ৩০০ হেক্টর জমিতে ভুট্টার আবাদ হয়েছিল। অর্থাৎ গত পাঁচ বছরের ব্যববধানে জেলায় ৩ হাজার ৮৪৫ হেক্টর জমিতে বেড়েছে ভুট্টার আবাদ।
সরেজমিন জেলার বিভিন্ন ভুট্টা ক্ষেত ঘুরে দেখা গেছে, অধিকাংশ এলাকায় ভুট্টা রোপণ শেষ হয়েছে। এরই মধ্যে কোথাও কোথাও গাছে ফুল আসা শুরু করেছে। আবার কোথাও তরতাজা হয়ে গাছ বেরিয়ে আসছে।
কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ভুট্টা চাষে প্রতি বিঘায় কর্ষণ, বীজ, সার, ওষুধ ও শ্রমিকের মজুরি দিয়ে খরচ হয় ৬ থেকে ৭ হাজার টাকা। এছাড়া আলুর সঙ্গে সমন্বিত পদ্ধতিতে একই জমিতে ভুট্টার আবাদ করলে খরচ আরো কম হয়। ভুট্টার পর ওই জমিতে পাটের আবাদও করা হয়। প্রতি বিঘায় ভালো মানের ভুট্টার ফলন হয় ৩৫-৪০ মণ। এছাড়া স্থানীয় জাতের ভুট্টায় ফলন হয় গড়ে ২০-২৫ মণের মতো। বর্তমানে নতুন ভুট্টা বাজারে প্রতি মণ বিক্রি হচ্ছে ৫০০-৬০০ টাকায়। ভুট্টার আবাদে রোগবালাইয়ের ঝুঁকি কম। গত বছর প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে ভুট্টাচাষীরা কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলেন। এবার সে ক্ষতি পুষিয়ে নিতে বাড়তি আবাদ করেছেন। কোনো ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ না হলে কৃষকরা ভালো ফলন পাবেন বলে আশাবাদী।
এদিকে ভুট্টার আবাদ বাড়লেও জেলায় কমেছে বোরো ধানের আবাদ। যেসব কৃষক আগে বোরো আবাদ করতেন, এখন তারা ভুট্টার আবাদ করছেন। অনেকে আবার বোরো ধানের পাশাপাশি ভুট্টাও আবাদ করছেন।
কৃষকরা বলছেন, বীজতলা থেকে জমিতে রোপণ পর্যন্ত বোরো আবাদে খরচ অনেক বেশি। তাছাড়া বর্তমানে বাজারে ধানের দাম কম। আবার পোকার আক্রমণ হলে তা নিয়ন্ত্রণ করা অনেক কঠিন হয়ে যায়। লোকসানের ঝুঁকি কমাতে ভুট্টার আবাদ বাড়িয়েছেন তারা।
রানীনগর উপজেলার মিরাট গ্রামের কৃষক এচাহক আলী বলেন, চলতি বছর চার বিঘা জমিতে ভুট্টার আবাদ করেছি। প্রতি বিঘায় ৬-৭ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে প্রতি বিঘায় ৩৫-৪০ মণ ভুট্টা পাওয়া যাবে। সে হিসাবে ৬৮ থেকে ৮০ হাজার টাকার ভুট্টা বিক্রি করতে পারব।
তিনি বলেন, উপজেলার অধিকাংশ জমিতে মূলত দুটি ফসলে আবাদ করা হয়। ভুট্টার পর একই জমিতে পাটের আবাদ করা হয়। অল্প পরিশ্রম এবং কম খরচে অধিক লাভ হওয়ায় ভুট্টার আবাদ বাড়িয়েছি।
একই উপজেলার কৃষ্ণপুর গ্রামের সোনাতন প্রামাণিক বলেন, দেড় বিঘা জমিতে ভুট্টা চাষ করেছি। অন্যান্য ফসলের তুলনায় ভুট্টা চাষে খরচ ও পরিশ্রম কম। দামও ভালো পাওয়া যায়। প্রথম দিকে ৫০০-৬০০ টাকা মণ বিক্রি করা হয়। তবে একটু দেরিতে (ফেব্রুয়ারি-মার্চ) বিক্রি করতে পারলে প্রতি মণ ভুট্টা ৯০০ থেকে ১ হাজার টাকায় বিক্রি করা যায়।
আত্রাই উপজেলার হাটকালুপাড়া গ্রামের ভুট্টাচাষী মো. আব্দুস শুকুর বলেন, প্রতি বছরের মতো এবারো পাঁচ বিঘা জমিতে ভুট্টা আবাদ করেছি। আত্রাই নদীর চরে আবাদ করা ভুট্টার ফলন ভালো পাওয়া যায়।
আত্রাই উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কেএম কাওছার হোসেন বলেন, এ উপজেলায় চলতি বছর ভুট্টা আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৫ হাজার ৪০ হেক্টর। যার বিপরীতে আবাদ হয়েছে ৫ হাজার ১৫০ হেক্টর। এছাড়া আদর্শ প্রকল্পের আওতায় প্রদর্শনী রয়েছে ৫০টি। ভুট্টা আবাদে পরিশ্রম ও উৎপাদন খরচ কম। আবার ফলনও বেশি পাওয়া যায়। কৃষকরা যদি একটু দেরি করে ভুট্টা বিক্রি করেন, তাহলে অনেক ভালো দাম পাবেন।
নওগাঁ জেলা কৃষি সম্প্র্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক সিরাজুল ইসলাম বলেন, ভূগর্ভস্ত পানির ব্যবহার কমাতে কৃষকদের রবি শস্যসহ স্বল্প পানি দিয়ে স্বল্প সময়ে ফসল চাষের জন্য উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে। এ জেলায় প্রতি বছর ভুট্টার আবাদ বৃদ্ধি পাচ্ছে। এছাড়া কৃষি অফিস থেকে ভুট্টা চাষে কৃষকদের সার্বিক সহযোগিতা করা হচ্ছে।