দেশে প্রাথমিক শিক্ষায় অংশগ্রহণের হার প্রায় শতভাগ। যদিও এসব শিক্ষার্থীর পাঠদানে নিয়োগ দেয়া হচ্ছে না পর্যাপ্ত শিক্ষক। গড়ে তোলা হচ্ছে না প্রয়োজনীয় অবকাঠামো। ফলে প্রাথমিকের গণ্ডি না পেরোতেই শিশুদের বড় একটি অংশ ঝরে পড়ছে।
ভেঙে পড়া টিনের চাল কোনোমতে বাঁশ দিয়ে ঠেকিয়ে রাখা হয়েছে। সামান্য বৃষ্টিতে শ্রেণীকক্ষে পানি জমে। গত কয়েক বছর থেকে খসে পড়ছে দেয়ালের পলেস্তারা। এমন ঝুঁকিপূর্ণ ভবনেই চলছে যশোর সদর উপজেলার নালিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শতাধিক শিক্ষার্থীর পাঠদান।
নালিয়ার মতোই তীব্র অবকাঠামো সংকটে রয়েছে দেশের ১০ হাজারের বেশি প্রাথমিক বিদ্যালয়। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের ‘বাংলাদেশ প্রাইমারি এডুকেশন: অ্যানুয়াল সেক্টর পারফরম্যান্স রিপোর্ট ২০১৯’ (এএসপিআর) প্রতিবেদন বলছে, একটি মাত্র শ্রেণীকক্ষ দিয়েই চলছে দেশের ৬ হাজার ৫৪৬টি প্রাথমিক বিদ্যালয়। দুটি শ্রেণীকক্ষ দিয়ে শিক্ষা কার্যক্রম চালাচ্ছে—এমন বিদ্যালয় রয়েছে ২ হাজার ৮০৯টি। এছাড়া পুরনো ঝুঁকিপূর্ণ ভবনে পাঠদান চলছে এমন বিদ্যালয়ের সংখ্যাও এক হাজারের বেশি। সে হিসেবে সরকারি তথ্যমতেই দেশের ১০ হাজারের বেশি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অবকাঠামো সংকট প্রকট।
অবকাঠামো সংকটের কারণে বেশকিছু বিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ হয়ে পড়েছে। নদীভাঙন ও নদীপ্রবাহ পরিবর্তনের কারণে অবকাঠামোর ক্ষয়ক্ষতি হওয়ায় এসব বিদ্যালয়ের কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে এএসপিআর প্রতিবেদনে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, দেশের প্রায় সব অঞ্চলের প্রাথমিক বিদ্যালয়েই কম-বেশি অবকাঠামো সংকট চলছে। তবে চর, হাওড়, উপকূল ও নদী ভাঙনকবলিত এলাকায় এ সংকট প্রকট। বিশেষ করে নদীভাঙন ও বন্যাসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে পড়ে প্রতি বছরই কয়েক হাজার বিদ্যালয়ের অবকাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত হয়। নদীতে বিলীন হয়ে যাওয়া বিদ্যালয়ের সংখ্যাও কম নয়। বিলীন হওয়া বিদ্যালয়ের নতুন ভবন নির্মাণ কিংবা ক্ষতিগ্রস্ত ভবন মেরামতে চলে যায় দীর্ঘ সময়। এর ফলে টিনের চালা বা বেড়া দিয়ে অস্থায়ী ভিত্তিতে দিনের পর দিন পাঠদান চালিয়ে নিতে হয় দুর্যোগকবলিত এসব বিদ্যালয়কে।
সম্প্রতি বণিক বার্তার পক্ষ থেকে দেশের কয়েকটি জেলায় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ঝুঁকিপূর্ণ ভবন ও অবকাঠামো সংকট বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করা হয়। যশোর জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসের তথ্যমতে, এ জেলায় মোট ১ হাজার ২৮৫টি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। এর মধ্যে ১৪৭টি স্কুলের ভবনের অবস্থা করুণ। এসব স্কুলের ঝুঁকিপূর্ণ ভবনেই চলছে শিক্ষা কার্যক্রম। এতে যেমন পাঠদান ব্যাহত হচ্ছে, তেমনি থেকে যাচ্ছে দুর্ঘটনার আশঙ্কা।
যশোরের আটটি উপজেলার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ বিদ্যালয় রয়েছে শার্শায়। এ উপজেলায় ৪১টি বিদ্যালয়েই ঝুঁকিপূর্ণ ভবনে পাঠদান দেয়া হচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে উলাশী, শিববাস-শালকোনা, নাভারণ রেলবাজার, বালুন্ডা, সুবর্ণখালি, বসতপুর ও খলসী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়।
যশোর সদর উপজেলায় ১৮টি স্কুল রয়েছে ঝুঁকিপূর্ণ তালিকায়। এরই একটি হচ্ছে যশোর শহরেই অবস্থিত ঘোপ সেবা সংঘ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। এ বিদ্যালয়ের ভবনে দেখা দিয়েছে ফাটল। খসে পড়ছে পলেস্তারা। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সাঈদা ইয়াসমিন জানান, বিকল্প কোনো ভবন না থাকায় ঝুঁকিপূর্ণ ভবনেই চলছে পাঠদান। এরই মধ্যে বিদ্যালয়টি ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করেছে উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিস। স্কুলের নতুন ভবনের জন্য আবেদনও করা হয়েছে। এ উপজেলার টি কে জী সম্মিলনী বিদ্যালয়, রামকৃষ্ণ আশ্রম বিদ্যালয়, সেবা সংঘ স্কুল, দেয়াড়া স্কুল ও চাউলিয়া স্কুলও বেশ ঝুঁকিপূর্ণ বলে জানা গেছে।
যশোর সদরের ঝুঁকিপূর্ণ নালিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ফরহাদ হোসেন বলেন, বিদ্যালয়টির প্রথম ভবন নির্মিত হয়েছিল ১৯২১ সালে প্রতিষ্ঠাকালে। পরে ১৯৯৫ সালে দেয়াল করে টিনের চালা দেয়া হয়। সেই টিনে মরিচা ধরেছে। কোথাও কোথাও টিনে ফুটো হয়েছে। বাঁশ দিয়ে কোনো রকম জোড়াতালি দিয়ে ৩১০ জন শিক্ষার্থীকে পাঠদান করা হচ্ছে। এ বিষয়ে বিভিন্ন সময় উপজেলা শিক্ষা অফিসকে লিখিতভাবে জানানো হলেও এখনো পরিস্থিতির পরিবর্তন হয়নি।
যশোরের অভয়নগর উপজেলায় তিনটি ঝুঁকিপূর্ণ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ পুড়াটাল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। কেশবপুর উপজেলায় চারটি ঝুঁকিপূর্ণ প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। এর মধ্যে গৌরীঘোনা ইন্দ্রমতী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। চৌগাছা উপজেলায় ১২টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ঝুঁকিপূর্ণ। এর মধ্যে হোগলাডাঙ্গা, পাতিবিলা, বল্লভপুর রামকৃষ্ণপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে। ঝিকরগাছা উপজেলায় ২৫টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ঝুঁকিপূর্ণ তালিকায় আছে। এর মধ্যে ডহর মাগুরা, নবগ্রাম, টাত্তরা, দোস্তপুর, দেউলি নাভারণ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে বেশি ঝুঁকিতে। বাঘারপাড়া উপজেলায় ১৫টি ঝুঁকিপূর্ণ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। এর মধ্যে আছে বহরমপুর, করিমপুর, পি টি এম, দশপাখিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। মণিরামপুর উপজেলায় ২৯টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ঝুঁকিতে রয়েছে। তার মধ্যে উত্তরপাড়া, সুবলকাঠি, ভোজগাতি, লাউলি, বাটবিলা, মদনপুর, কুচলিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অবস্থা সবচেয়ে করুণ।
যশোর জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার শেখ অহিদুল আলম বলেন, যশোর জেলায় আটটি উপজেলার ১৪৭টি প্রাথমিক বিদ্যালয় ঝুঁকিপূর্ণ চিহ্নিত করা হয়েছে। এসব বিদ্যালয়ে বিকল্প কোনো ভবন না থাকায় বর্তমানে ঝুঁকিপূর্ণ ভবনেই চলছে শিক্ষা কার্যক্রম। এসব ভবনের তালিকা এরই মধ্যে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রনালয়ে পাঠানো হয়েছে। দ্রুতই এসব স্কুলের ব্যাপারে ইতিবাচক পদক্ষেপ নেয়া হবে।
যশোর শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. হাসান শওকত জানান, মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন সাপেক্ষ আমাদের বিভিন্ন বিদ্যালয়ের ভবন নির্মাণকাজ অব্যাহত রয়েছে। পর্যায়ক্রমে সব ঝুঁকিপূর্ণ বিদ্যালয় ভবন ভেঙে নতুন ভবন নির্মাণ করা হবে।
পাঁচ বছরেরও বেশি সময় ধরে ঝুঁকিপূর্ণ ভবনে পাঠদান চলছে নোয়াখালীর মাইজদীর হরিনারায়ণপুর বালিকা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়েও। সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, ভেঙে পড়েছে বিদ্যালয় ভবনের বারান্দার পাকা রেলিং, সিঁড়ির কাঠের রেলিং দুটিও নড়বড়ে। ভবনের দেয়ালের বাইরে ও ভেতরের পলেস্তারা খসে পড়ে রড দেখা যাচ্ছে। শ্রেণীকক্ষে পাঠদান চলাকালেও খসে পড়ছে পলেস্তারা। বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা জানান, গত সপ্তাহেই পরপর দুই দিন পাঠদান চলাকালে প্রাক-প্রাথমিকের শ্রেণীকক্ষের ছাদের পলেস্তারা খসে পড়ে। এতে হতাহতের কোনো ঘটনা না ঘটলেও ভেঙে পড়ার শব্দে দিগ্বিদিক ছোটাছুটি করে কোমলমতি শিক্ষার্থীরা। আতঙ্কিত হয়ে পড়ে শিক্ষার্থী ও শিক্ষকরাও।
বিদ্যালয়টির প্রধান শিক্ষক আলেয়া বেগম জানান, বালক-বালিকা মিলিয়ে বিদ্যালয়ের বর্তমান শিক্ষার্থী সংখ্যা ৩৫৩। বিকল্প কোনো ভবন না থাকায় ঝুঁকিপূর্ণ ভবনেই পাঠদান চলছে তাদের। ফাটলের ছবিসহ ৪০টির মতো ছবি দিয়ে একাধিকবার কর্তৃপক্ষকে চিঠি লেখা হয়েছে। যদিও এখন পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থা নেয়নি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ।
নদী ভাঙনকবলিত অঞ্চল কুড়িগ্রামের উলিপুরের কয়েকটি ইউনিয়নে ঘুরেও প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অবকাঠামো সংকটের চিত্র পাওয়া গেছে। এমন একটি প্রতিষ্ঠান সাহেবের আলগা ইউনিয়নের মশালের চর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গত দুই দশকে অন্তত ১০ থেকে ১৫ বার নদীভাঙনের কবলে পড়েছে এ বিদ্যালয়। একই ইউনিয়নের মেকুরের আলগা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ও বেশ কয়েকবার নদীভাঙনের কবলে পড়ে। ২০১৭ সালের বন্যার পর ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় ঝুঁকিতে পড়ে বিদ্যালয়ের পাঠদান কার্যক্রম। পরে একটি বেসরকারি সংস্থার অর্থায়নে কয়েকটি শ্রেণীকক্ষ তৈরি করে দেয়া হলেও প্রাক-প্রাথমিকের পাঠদান চলছে ভাঙাচোরা টিনের একটি ঘরে। গত সপ্তাহে স্কুলটি পরিদর্শনে গিয়ে দেখা যায়, টিনের একটি ঘরে দুটি বেঞ্চ পেতে শিশুদের পাঠদান দেয়া হচ্ছে। যদিও শিশুদের জন্য আকর্ষণীয় শ্রেণীকক্ষে পাঠদানের ব্যবস্থা করার কথা বলা হয়েছে শিক্ষানীতিতে।
পার্বত্য অঞ্চলের বিদ্যালয়গুলোতে অবকাঠামো সংকট অনেক বেশি। বান্দরবানের রোয়াংছড়ি উপজেলায় ৬২টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। এর মধ্যে একটি বেসরকারি সংস্থা পরিচালিত ১৬টি বিদ্যালয় নতুন করে সরকারি করা হয়েছে। এসব বিদ্যালয়েই অবকাঠামো সংকট সবচেয়ে বেশি। এক-দুটি কক্ষ নিয়েই চলছে বিদ্যালয়ের পাঠদান কার্যক্রম। এছাড়া পুরনো ৪৬টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রায় অর্ধেকেই অবকাঠামো সংকট রয়েছে। বিশেষ করে সাত থেকে আটটি টিনশেডের বিদ্যালয়ে অবকাঠামো সংকট সবচেয়ে বেশি। সড়ক পথে যোগাযোগব্যবস্থা না থাকায় এসব বিদ্যালয়ে ভবন নির্মাণের জন্য টেন্ডার হলেও মালামাল পরিবহন করতে না পারায় নির্মাণ কার্যক্রম পরিচালনা সম্ভব হচ্ছে না।
এ বিষয়ে উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা এসএম জাকারিয়া হায়দার বলেন, উপজেলার ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ বিদ্যালয়েই অবকাঠামো সংকট রয়েছে। বিশেষ করে নতুন সরকারি হওয়া বিদ্যালয়গুলোতে খুবই খারাপ অবস্থা। এছাড়া দুর্গম অঞ্চলের কিছু বিদ্যালয়ের নির্মাণসামগ্রী নিতে না পারায় উন্নয়ন কার্যক্রম পরিচালনা সম্ভব হচ্ছে না। ( খবর : দৈনিক বণিক বার্তা, ১৫ মার্চ, ২০২০)