Dr. Neem on Daraz
Victory Day

দিনে ১২ হাজার কোটি টাকা ধার দিচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক


আগামী নিউজ | নিউজ ডেস্ক প্রকাশিত: মার্চ ২৫, ২০২০, ০৮:৫৬ এএম
দিনে ১২ হাজার কোটি টাকা ধার দিচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক

করোনা আতঙ্কে দেশের ব্যাংকগুলো থেকে নগদ টাকা তুলে নেয়ার প্রবণতা বহুগুণ বেড়েছে। কয়েক দিন থেকে ধারাবাহিকভাবে বাড়তে থাকা এ প্রবণতা গতকাল আরো তীব্র হয়। গ্রাহকের চাহিদা অনুযায়ী টাকা সরবরাহ করতে অনেক ব্যাংকই হিমশিম খাচ্ছে। অনেক দিন থেকেই তারল্য সংকট চলছে দেশের আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারেও (কলমানি)। নগদ টাকার জন্য ব্যাংকগুলোর একমাত্র ভরসা এখন কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এ অবস্থায় পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে ব্যাংকগুলোকে দিনে ১২ হাজার কোটি টাকার বেশি অর্থ ধার দিতে হচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে।

চলতি সপ্তাহের প্রথম কার্যদিবস রোববার ব্যাংকগুলোয় নগদ অর্থের চাহিদা ছিল ১৪ হাজার কোটি টাকারও বেশি। কিন্তু সেদিন কলমানি বাজারে বিনিয়োগ হয়েছে মাত্র ১ হাজার ৪৬৭ কোটি টাকা। ফলে চাহিদা মেটাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ১২ হাজার ৬৯৫ কোটি টাকা ধার করতে হয়েছে ব্যাংকগুলোকে। এর মধ্যে সাতদিন মেয়াদি রেপোতে ৪ হাজার ১৪৭ কোটি টাকা, একদিন মেয়াদি রেপোতে ৪ হাজার ২৭৪ কোটি ও অ্যাসিউরড লিকুইডিটি সাপোর্ট (এএলএস) হিসেবে ৪ হাজার ২০৩ কোটি টাকা দিতে হয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে। এছাড়া বিশেষ রেপোতে ধার দিতে হয়েছে ৬৯ কোটি টাকা। বেসরকারি ব্যাংকের পাশাপাশি সরকারি ব্যাংকগুলোকেও রেপো ও এএলএস হিসেবে এ অর্থ দিতে হয়। পরদিন সোমবারও ব্যাংকগুলোকে ১১ হাজার ১৭১ কোটি টাকা ধার দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। চলতি মাসের শুরু থেকেই এ পরিস্থিতি চলছে মুদ্রাবাজারে।

কলমানি বাজার এবং রেপো, বিশেষ রেপো ও এএলএস সুবিধার পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ফেব্রুয়ারির শুরুতেও দেশের কলমানি বাজারে দৈনিক ৫ হাজার কোটি টাকার বেশি বিনিয়োগ করেছিল ব্যাংকগুলো। গত ৪ ফেব্রুয়ারি কলমানি বাজারে সর্বোচ্চ ৭ হাজার ৫১৬ কোটি টাকা বিনিয়োগ হয়। এর পর থেকেই কলমানি বাজারে ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগ সামর্থ্য কমছে। ফেব্রুয়ারির শেষের দিকে কলমানি বাজারে বিনিয়োগের পরিমাণ ২ হাজার কোটি টাকায় নেমে আসে। আর চলতি মার্চের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবেই কমেছে এ বিনিয়োগ, যা কমতে কমতে হাজার কোটি টাকার ঘরে নেমে এসেছে।


কলমানি বাজারে বিনিয়োগ কমায় বাড়তে থাকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ধারের পরিমাণ। ফেব্রুয়ারিতে রেপো ও এএলএস সুবিধার আওতায় ব্যাংকগুলোর ঋণ গ্রহণের গড় ছিল ৫ হাজার কোটি টাকার ঘরে। মার্চে এসে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণের পরিমাণ অস্বাভাবিক বেড়ে যায়। ১৬ মার্চ রেপো ও এএলএস সুবিধার আওতায় ব্যাংকগুলোর ঋণ গ্রহণের পরিমাণ ১১ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়। এর পর থেকে এ চাহিদা বেড়েই চলছে।

ব্যাংকাররা বলছেন, পুঁজিবাজারের মতোই দেশের কলমানি বাজার ধসে পড়েছে। এ বাজার শুকিয়ে যাওয়ার পেছনে করোনাভাইরাসের প্রভাবই একমাত্র কারণ নয়। সরকার ব্যাংকিং খাত থেকে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর আমানত তুলে নিচ্ছে। 

আমানতের সুদহার কমানোর বিরূপ প্রভাবও পড়েছে ব্যাংকিং খাতে। এছাড়া বেসরকারি খাতে ঋণ না দিয়ে সরকারি বিল-বন্ড কিনে নেয়ার প্রবণতাও এর কারণ। সামগ্রিক পরিস্থিতিকে দেশের অর্থনীতি ও ব্যাংকিং খাতের জন্য বিপজ্জনক বলেই মনে করছেন তারা।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডেট ম্যানেজমেন্ট বিভাগের কর্মকর্তাদের বক্তব্য হলো, সাধারণ মানুষ ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নিচ্ছে। করোনা প্রভাবের আগে থেকেই এ পরিস্থিতি দেখা গেছে। মানুষ টাকা তুলে নিয়ে কোথায় রাখছে, সেটি খতিয়ে দেখার সময় এসেছে।

তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মো. সিরাজুল ইসলাম বলছেন, করোনা প্রভাবের কারণে মানুষ নগদ টাকা তুলে রাখছে। এক্ষেত্রে সাধারণ ছুটির প্রভাবও রয়েছে। করোনা আতঙ্ক কেটে গেলে এ পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসবে। ব্যাংকগুলোকে চাহিদার আলোকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক টাকা সরবরাহ করছে। আতঙ্কিত হওয়ার কোনো কারণ নেই।

ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নেয়ার অস্বাভাবিক প্রবণতা দেখা গেছে একাধিক ব্যাংকের শাখা ঘুরে। গতকাল রাজধানীর কারওয়ান বাজার এলাকায় একাধিক সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংকের শাখায় গিয়ে দেখা যায়, গ্রাহকরা টাকা জমা দেয়ার পরিবর্তে টাকা তুলছেন বেশি। একটি বেসরকারি ব্যাংকের শাখা ব্যবস্থাপক জানান, ব্যাংকে আসা প্রতি ১০ জন গ্রাহকের মধ্যে আটজনই টাকা তুলতে এসেছেন। এটিএম বুথগুলোতে বেশি হারে টাকা সরবরাহ করতে হচ্ছে। একই পরিস্থিতির কথা জানান, অন্য একাধিক ব্যাংকের শাখা ব্যবস্থাপকও।

দুটি শাখার ব্যবস্থাপক জানান, গ্রাহকদের চাহিদা অনুযায়ী নগদ টাকা দেয়ার জন্য একাধিকবার অন্য শাখা থেকে টাকা আনতে হয়েছে। একই পরিস্থিতির কথা জানান একাধিক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকও (এমডি)।

মানুষ গণহারে ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নিচ্ছে বলে জানিয়েছেন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের সাবেক চেয়ারম্যান ও মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহী সৈয়দ মাহবুবুর রহমান। তিনি বলেন, গ্রাহকরা গণহারে ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নিচ্ছেন। নগদ টাকার জোগান দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। দেশের কলমানি বাজারে টাকা নেই। এজন্য বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে রেপো ও এএলএসের মাধ্যমে টাকা আনতে হচ্ছে।

সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, গণহারে টাকা তুলে নেয়ার প্রবণতাটি ব্যাংকিং খাতের জন্য বিপদ ডেকে আনবে দুটি কারণে। প্রথমত, গ্রাহকরা মনে করছেন, বিশ্বের বহু দেশ শাটডাউন হয়ে গেছে। এ অবস্থায় মানুষ প্রয়োজনীয় টাকা তুলে ঘরে রাখছেন। দ্বিতীয়ত, বিদ্যমান পরিস্থিতিতে ব্যাংক নিরাপদ কিনা, প্রয়োজনের সময় ব্যাংক টাকা দিতে পারবে কিনা, গ্রাহকদের মধ্যে এমন শঙ্কাও কাজ করছে। গ্রাহকদের শঙ্কা কাটানোর জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রচারণা দরকার। মাসের শেষ সময় চলে এসেছে। চাকরিজীবীদের বেতন-ভাতা পরিশোধের জন্য বিপুল পরিমাণ টাকার প্রয়োজন হবে। পরিস্থিতি সামাল দেয়ার জন্য নতুন টাকা ছাপানোর কোনো বিকল্প নেই বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

দুই বছর ধরে তারল্য সংকট ছিল দেশের বেসরকারি ব্যাংকগুলোতে। ওই সময় কলমানি ও মেয়াদি আমানত হিসেবে এ ব্যাংকগুলোকে টাকা দিয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো। এখন রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতেও নগদ টাকার হাহাকার তৈরি হয়েছে। চলতি বছরের প্রথম থেকেই কলমানি বাজার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ধার করে চলছে রাষ্ট্রায়ত্ত রূপালী ব্যাংক। নিয়মিতভাবেই ধার করে চলতে হচ্ছে রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংককে। প্রতিদিনই কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ২-৩ হাজার কোটি টাকা করে ধার করতে হচ্ছে ব্যাংকটিকে। একই পরিস্থিতি রাষ্ট্রায়ত্ত অগ্রণী ও সোনালী ব্যাংকের। চলতি মাসের শুরু থেকে এ দুটি ব্যাংকও কলমানি ও বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে নিয়মিত ধার করে চলছে।

রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোকে কেন ধার করতে হচ্ছে—এ প্রশ্নের জবাবে জনতা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আব্দুছ ছালাম আজাদ বণিক বার্তাকে বলেন, আইন পাস করে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর উদ্বৃত্ত টাকা সরকার নিজের হিসাবে নিয়ে যাচ্ছে। চলতি মাসে জনতা ব্যাংক থেকে প্রায় ২ হাজার ৫০০ কোটি টাকার সরকারি প্রতিষ্ঠানের আমানত তুলে নেয়া হয়েছে। একসঙ্গে এত টাকা সরিয়ে নিলে ব্যাংকগুলোর পক্ষে ধাক্কা সামাল দেয়া কঠিন। এজন্যই কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে রেপো ও এএলএসের মাধ্যমে ধার নিতে হচ্ছে। তবে জনতা ব্যাংক এখনো প্রয়োজন অনুযায়ী, অনেক ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে কলমানিতে ধার দিচ্ছে।

রাষ্ট্রায়ত্ত অন্য একটি ব্যাংকের ট্রেজারি বিভাগের প্রধান বলেন, সরকার ট্রেজারি বিল-বন্ড বিক্রি করছে ৮ শতাংশের বেশি সুদে। বেসরকারি ব্যাংকগুলো অনেক দিন থেকেই ব্যক্তিখাতে ঋণ দেয়া প্রায় বন্ধ করে দিয়েছে। এ ব্যাংকগুলো এখন সংগৃহীত আমানত দিয়ে সরকারি বিল-বন্ড কিনছে, সে বিল-বন্ড কেন্দ্রীয় ব্যাংকে জমা রেখে রেপো ও এএলএসে ধার নিচ্ছে। ফলে দুভাবে বেসরকারি ব্যাংকগুলো লাভবান হচ্ছে। প্রথমত, সরকারি বিল-বন্ডে ৮ শতাংশের বেশি সুদ পাচ্ছে। আবার সে বিল-বন্ড জমা রেখে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ৬ শতাংশ সুদে রেপোতে ধার নিচ্ছে। রেপোর ধারকৃত টাকা দিয়ে বেসরকারি ব্যাংকগুলো দৈনন্দিন প্রয়োজন মেটাচ্ছে। ফলে কলমানি বাজার শুকিয়ে গেছে। ব্যাংকগুলো কলমানি বাজারে বিনিয়োগ না করে স্বল্প মেয়াদি স্থায়ী আমানত দিচ্ছে। এক্ষেত্রে সুদ পাচ্ছে ৭-৮ শতাংশ। অন্যদিকে কলমানি বাজারের সুদহার সাড়ে ৫ শতাংশে বেঁধে রাখা হয়েছে। এভাবেই অর্থনীতি ও ব্যাংকিং খাতে বহুমুখী সংকট সৃষ্টি করা হচ্ছে।

দেশের আমদানি বাজার প্রায় বন্ধ। এতে রফতানি ও রেমিট্যান্স থেকে যে বৈদেশিক মুদ্রা আয় হচ্ছে, তা ব্যয় করতে পারছে না ব্যাংকগুলো। ফলে দেশের বেশির ভাগ ব্যাংকের হাতেই প্রয়োজনের চেয়ে বেশি বৈদেশিক মুদ্রা জমা হয়েছে। বাজার পরিস্থিতি ঠিক রাখতে নিয়মিতভাবে ব্যাংকগুলোর কাছ থেকে ডলার কিনে নিচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এখন পর্যন্ত ব্যাংকগুলোর কাছ থেকে ৩০ কোটি ৫০ লাখ ডলার কিনেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এর মাধ্যমে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ব্যাংকগুলোর হাতে নগদ টাকা সরবরাহ বেড়েছে। তার পরও কেন দেশের কলমানি বাজারে টাকা নেই এর কারণ খুঁজে পাচ্ছে না কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মকর্তারা।

তারা বলছেন, বাংলাদেশ ব্যাংক বাজার থেকে ডলার কিনে নিচ্ছে। এর মাধ্যমে ব্যাংকগুলোর কাছে তারল্য বাড়ার কথা। কিন্তু উল্টোটা কেন হচ্ছে, সেটি ভাবতে হবে। আমানতের সুদহার কমে গেলে আমানতকারীরা নিরুৎসাহিত হন। পাড়া-মহল্লার সমিতি বা ডেসটিনি-যুবকের মতো প্রতিষ্ঠানে মানুষ বেশি লাভের আশায় বিনিয়োগ করে। এটি যেন না হয়, তা দেখা দরকার। (খবর : দৈনিক বণিক বার্তা, ২৫ মার্চ, ২০২০) 

আগামী নিউজ এর সংবাদ সবার আগে পেতে Follow Or Like করুন আগামী নিউজ এর ফেইসবুক পেজ এ , আগামী নিউজ এর টুইটার এবং সাবস্ক্রাইব করুন আগামী নিউজ ইউটিউব চ্যানেলে