দেশ থেকে প্রতি বছর পাচার হচ্ছে হাজার কোটি টাকা। অর্থসম্পদের পাশাপাশি পাচার হয়ে যাচ্ছে মানুষ। নারী ও শিশু পাচার করে ভেড়ানো হচ্ছে অপরাধজগতে। আন্তর্জাতিক মাদক পাচারের রুট হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে বাংলাদেশ। লোকচক্ষুর আড়ালে গহিন বন থেকে ধরে নিয়ে বিদেশে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে বন্যপ্রাণী। প্রতারণা ও জোচ্চুরির মাধ্যমে পাচার হয়েছে দুর্লভ সব ঐতিহাসিক প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন। সব মিলিয়ে চলতে থাকা পাচারের মহোৎসবে বিপর্যস্ত পরিস্থিতিতে পড়েছে দেশ।
শুধু তাই নয়, নানা কারণে দেশ থেকে চলে যাচ্ছে মেধাবীরা। বড় আকার ধারণ করেছে ইনটেলেকচুয়াল প্রপার্টি পাচারের সংখ্যা। জানা যায়, বাংলাদেশ থেকে টাকা পাচার বেড়েছে অস্বাভাবিক হারে। শুধু ২০১৫ সালে বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়েছে ১ হাজার ১৫১ কোটি ডলার বা ৯৮ হাজার কোটি টাকা। এ পরিমাণ অর্থ দিয়ে চারটি পদ্মা সেতু নির্মাণ সম্ভব। বিদেশ থেকে পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে মূল্য বেশি দেখানো (ওভার ইনভয়েসিং) এবং রপ্তানিতে মূল্য কম দেখানোর (আন্ডার ইনভয়েসিং) মাধ্যমেই পাচার হয়েছে এসব অর্থ। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রতিষ্ঠান জিএফআইর তথ্যমতে, গত সাত বছরে বাংলাদেশ থেকে ৫ হাজার ২৭০ কোটি ডলার পাচার হয়েছে।
স্থানীয় মুদ্রায় যা সাড়ে ৪ লাখ কোটি টাকা। এ অঙ্ক দেশের চলতি বছরের (২০১৯-২০) জাতীয় বাজেটের প্রায় সমান। সে হিসেবে প্রতি বছর গড়ে পাচার হয়েছে প্রায় ৬৪ হাজার কোটি টাকা। র্যাব বলছে, গত দেড় বছরে শুধু ড্যান্স ক্লাবের আড়ালে হাজারের বেশি নারী পাচার হয়েছেন। র্যাবের দেওয়া এ তথ্য বাংলাদেশ থেকে মানব পাচারের ভয়াবহ চিত্রই তুলে ধরে। শুধু ড্যান্স ক্লাবের নামে যদি সহস্রাধিক নারী পাচার হয়, তাহলে বিদেশে লোভনীয় চাকরি ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধার নামে কত নারী-পুরুষ ও শিশু পাচার হতে পারে, তা অনুমান করা কঠিন নয়। একটি আন্তর্জাতিক সংস্থার মতে, বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর প্রায় ৭ লাখ মানুষ অবৈধভাবে বিদেশে পাড়ি জমান, যার একটি বড় অংশ যায় পাচার হয়ে। শুধু কক্সবাজার থেকে নৌকায় করে রোহিঙ্গাদের মালয়েশিয়া যাওয়াই মানব পাচারের এক উৎসবে পরিণত হয়েছে।
এ উৎসবে দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা দালালরা ঘি ঢালছেন প্রতিনিয়ত। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর বলছে, ইয়াবার জন্য মিয়ানমারে প্রতি বছর প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা পাচার হচ্ছে। জাতিসংঘের মাদক ও অপরাধবিষয়ক দফতর থেকে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, মাদক বিশেষ করে হেরোইনের একটি বড় উৎস আফগানিস্তান হলেও এর পাচারের পথটি হচ্ছে ভারত, শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশ এবং উত্তর আমেরিকা (যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডা)। এ প্রতিবেদনে ইয়াবার নাম না থাকলেও এর মূল উপাদান মেথামফিটামিনের উল্লেখ রয়েছে। মেথামফিটামিন জব্দকারী শীর্ষ ১৬টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ রয়েছে অষ্টম স্থানে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, কোকেন পাচারকারীরা প্রতিনিয়ত রুট ও কৌশলের হেরফের করে। কয়েক বছর আগে বাংলাদেশেও কোকেনের একটি বড় চালান ধরা পড়েছিল। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় মাদকদ্রব্য উদ্ধার ও ধ্বংস করার বিবরণও রয়েছে প্রতিবেদনে। বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন ইউনিট জানিয়েছে, বাংলাদেশ থেকে চারদিক দিয়ে পাচার হচ্ছে বন্যপ্রাণী। পাচারকারীরা রুট হিসেবে ব্যবহার করছে শাহজালাল বিমানবন্দর, বেনাপোল ও হিলি স্থলবন্দর। নতুন করে সমুদ্রপথেও সক্রিয় হয়েছে অপরাধীরা। গত সাত বছরে প্রায় ৩০ হাজার বন্যপ্রাণী উদ্ধার হয়েছে। সম্প্রতি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া থেকে বাংলাদেশে আনা হয়েছিল সিংহশাবক ও বিরল প্রজাতির বাঁদর (হোয়াইট হেডেড লাঙুর)। পরে বাংলাদেশ থেকে চোরাপথে পাঠানো হয় ভারতে। ২০১৭ সালের নভেম্বরে ঢাকার উত্তরা থেকে যশোরে পাচারের সময় একটি এসইউভি থেকে দুটি সিংহশাবক ও দুটি চিতাবাঘের ছানাকে উদ্ধার করেছিল বাংলাদেশ পুলিশ। সে সময় জানা গিয়েছিল, ওই সিংহশাবক ও চিতাবাঘের ছানাগুলো বনগাঁ সীমান্ত দিয়ে ভারতে পাঠানোর ছক ছিল।
জানা গেছে, বাংলাদেশ থেকে নিয়মিত পাচার হচ্ছে অমূল্য এবং ঐতিহাসিক পাথরের মূর্তি। দেশি ও আন্তর্জাতিক বাজারে এই পাথরের মূল্য বেশি হওয়ায় পাচারকারীদের কাছেও এর চাহিদা বেশি। ঐতিহাসিক মূল্যমান যাচাই করেই এসব পুরাকীর্তির দাম নির্ধারণ করা হয়। বাংলাদেশ থেকে বিষ্ণুমূর্তি, বামনমূর্তি, শ্যামতারা, তামার আলিঙ্গন মূর্তি, ব্রোঞ্জের মূর্তি, কালো পাথরের মূর্তি, কালো পাথরের গৌরপট, সরস্বতী মূর্তি, লক্ষ্মীমূর্তি, নানা ধরনের পাত্র, ননীগোপাল মূর্তি, অজ্ঞাত দেব-দেবীর মূর্তি, কালো পাথরের হরগৌরী, গণেশমূর্তিসহ ঐতিহাসিক মূল্যমানের অমূল্য সম্পদ যুগ যুগ ধরে পাচার হয়ে যাচ্ছে। জাদুঘর-সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, রাষ্ট্রীয় প্রত্নসম্পদের মূল ভান্ডার জাতীয় জাদুঘর থেকেও পুরাকীর্তি চুরির ঘটনা ঘটছে। ঢাকা জাতীয় জাদুঘরে একাধিকবার চুরি হয়ে খোয়া গেছে মহামূল্যবান প্রত্নসম্পদ। জাদুঘরের ভ্রাম্যমাণ বাস থেকেও অনেক সময় মূল্যবান পুরাকীর্তি চুরি হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এসব ঘটনার কারণ অনুসন্ধানে তদন্ত কমিটিও হয়েছে। তবে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা কখনোই লক্ষ্য করা যায়নি। এসব ঘটনায় যেসব মামলা হয়েছে সেগুলোও একটা সময় পর থেমে গেছে বলে জানা যায়। আর যে কারণে যারা এসব চুরির সঙ্গে জড়িত ছিল তারা রয়ে গেছে ধরাছোঁয়ার বাইরে।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুরের মতে, সুশাসন না থাকলে পাচার হবেই। অর্থ পাচারের সঙ্গে জড়িতরা সমাজের উঁচুস্তরের লোক। রাজনীতিবিদ, আমলা, ব্যবসায়ী প্রায় সবার ছেলেমেয়ে বিদেশে থাকে। সন্তানদের নিরাপদ ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে তারা টাকা সরানোর চেষ্টা করেন। তাদের মধ্যে এ দেশে বিনিয়োগ বা টাকা রাখায় কোনো আস্থা নেই। দেশে টাকা ধরে রাখার ক্ষেত্রে তাদের জন্য কোনো প্রণোদনা নেই। সবার আগে দেশকে ভালোবাসতে হবে। (খবর : বাংলাদেশ প্রতিদিন, ০৫ মার্চ, ২০২০)