ঢাকাঃ বাংলাদেশে আমরা রাস্তার ধারে কিংবা গলির মধ্যে যেসব ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে মুদি, স্টেশনারি বা পান-সিগারেটের দোকান বলে থাকি, তাদের নিয়ে খুব কমই আলোচনা হয়ে থাকে।
বর্তমান সময়ে বড় বড় ডিপার্টমেন্টাল ষ্টোরের সাথে পাল্লা দিয়ে কোন ভাবেই টিকে থাকতে পারছে না ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীরা, অভিজাত কোম্পানীর বড় বড় ডিপার্টমেন্টাল ষ্টোরের দাপট দিনের পর দিন বেড়েই চলছে।
বর্তমানে ডিপার্টমেন্টাল ষ্টোরগুলোর মধ্যে সবচেয়ে এগিয়ে রয়েছে স্বপ্ন, মিনা বাজার, আগুরা, চায়না বাজার ইত্যাদি। ঢাকার বিভিন্ন পাড়া ও মহল্লা ঘুরে দেখা যায় প্রতিটি লোকেশানে রয়েছে স্বপ্ন ও মিনা বাজার। মিনা বাজার ও স্বপ্নতে মাছ, মাংস, শাক- সবজি, ফল ফলাদি, কস্মেটিকস, পোষাকসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় সকল ব্যবহারিক পণ্য পাওয়া যায়, সকল পণ্য একসাথে পাওয়ার কারণে ক্রেতারা মহল্লার দোকান থেকে কেনাকাটা করতে অনিহা জানায়।
চামেলী বাগের সানজিদা খানম, তিনি প্রায় ৫ বছর যাবত মিনা বাজারে কেনাকাটা করেন, মহল্লার দোকান থেকে কেন কেনাকাটা করছে না তা জানতে চাইলে তিনি আগামী নিউজকে বলেন, মহল্লার দোকানে সব জিনিসপত্র থাকেন না, চাল আছে তো ডাল নেই, ডাল আছে তো আটা নেই, তাছাড়া স্বপ্ন ও মিনা বাজারে সবকিছু একত্রে পাওয়া যায় যার কারণে নানান জায়গায় দৌড়ঝাপ করতে হয় না।
শান্তিনগর বাজার ঘুরে কয়েকজন ব্যবসায়ীর সাথে কথা হয় আগামী নিউজের, বিক্রেতারা জানান, আগের চেয়ে এখন বেচাকেনা কম হয়, মানুষ এখন আর বাজারে খুব একটা আসতে চায় না, চাল, ডাল, মাছ-তরকারি এখন অনলাইনে অর্ডার করলে বাসায় পৌছে দেয়া হয়, তাছাড়া প্রতিটি মহল্লায় রয়েছে অভিজাত কোম্পানীগুলোর ডিপার্টমেন্টাল ষ্টোর তাদের কারণেই মূলত মানুষ এখন বাজারে কম আসে। বিক্রেতারা জানান, বেচাকেনা কম কিন্ত দোকানের ভাড়া প্রতিবছরে বৃদ্ধি পায়, অনেকেই দোকানপাট ছেড়ে এখন অন্য পেশায় চলে গেছে। বিক্রেতারা আরও জানান, প্রতি মাসেই বাজারে কেউ না কেউ দোকান ছেড়ে চলে যায়, অনেক কষ্টে দিন কাটে আমাদের, বহু কষ্টে টিকে আছি।
শান্তিনগরের পীর সাহেবের গলিতে ৩০ বছর ধরে মুদি ব্যবসা করেন কাদের মোল্লা, তিনি আগামী নিউজকে বলেন, দোকানপাট ছাইড়া দিমু কাকা, আর কুলাইতে পারতাছি না, রাস্তার মোড়ে বড় একটা মার্কেট হইসে নাম নাকী মিনা বাজার, সবাই দেহি সেখান থেকে সদায় কেনে, এখন আর আমাগো দোকানে আসে না। কাদের বলেন, এই মাসের পর দোকান আর রাখবো না, বেইচা দিমু।
মালিবাগ কাঁচা বাজারে ২০ বছর ধরে মাছের ব্যবসা করেন মো দেলোয়ার মিয়া, তিনি আগামী নিউজকে বলেন, স্বপ্ন ও মিনা বাজারে বেশিভাগ মানুষ কেনা কাটা করায় ক্রেতা পাচ্ছে না আগের মতো, তিনি বলেন এখন কোনরকম টিকে আছি, আগের মতো বেচাকেনা নাই লাভও নাই।
প্রখ্যাত অর্থনীতিবীদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের চেয়াম্যান, প্রফেসর ড. এম এম আকাশ আজ (২৪ মার্চ) আগামী নিউজকে বলেন, কার্ল মার্ক্স এই কথাগুলো অনেক আগেই বলে গেছে যে বড় পুঁজি ছোট ছোট পুঁজিগুলোকে খেয়ে ফেলবে, দেশ এখন পুঁজিবাদের দখলে, সামনের দিনগুলো আরও ভয়াবহ হবে।
তিনি বলেন, আগে দেখতাম বাজারে বাজারে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা হুলুদের গুঁড়া, মরিচের গুঁড়া, আটা, চাল, তেল এসব বিক্রি করতো, আর এখন এসব ব্যবসায়ীদের দেখা যায় না, বড় বড় কোম্পানীগুলো এখন এসব পণ্যগুলো প্যাকেটজাত করে বাজারে সাপ্লাই দিচ্ছে। এই ভাবেই ছোট ছোট ব্যবসায়ীগুলো দেউলিয়া হয়ে গেছে, এবং সামনের দিনে আরও হবে বলেও তিনি জানান।
বিভিন্ন আনুষ্ঠানিক চ্যানেলের মাধ্যমে ক্ষুদ্র বা মাঝারি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে পুঁজির জোগানের যে ব্যবস্থা রয়েছে, সেসব ব্যবস্থার মধ্যে এসব মুদি, মনোহারি বা পান-সিগারেটের দোকানগুলোর স্থান নেই বললেই চলে।
আর্থিক অন্তর্ভুক্তির যেসব চমৎকার কথা আমরা বলে থাকি, তার মাঝে এ অতি ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী শ্রেণিটি বেশ কম আলোচিত এবং তা সরকারের নীতি সুবিধাতে অনুপস্থিত এমনটি বলা অত্যুক্তি হবে না।
জাতিসংঘের পুঁজি উন্নয়ন তহবিল (UNCDF) বাংলাদেশের এ অতি ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের নিয়ে একটি জরিপ ও গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। জাতিসংঘের এ সংস্থাটি বাংলাদেশের অতি ক্ষুদ্র এবং স্বল্প আলোচিত ব্যবসায়ীদের নিয়ে জরিপ পরিচালনা করে প্রশংসার দাবিদার হয়েছে। বাংলাদেশের বিভিন্ন পর্যায়ের নীতিনির্ধারকরা, বাংলাদেশ ব্যাংক, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান, ফিন্যান্সিয়াল টেকনোলজি তথা ফিনটেকের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান, মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো, ফাস্ট মুভিং পণ্য উৎপাদনকারী ও বিতরণকারী প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যবসায়ীরা এবং নতুন উদ্যোক্তারাও এ গবেষণা প্রতিবেদন থেকে অনেকভাবেই উপকৃত হতে পারেন।
মুদি, মনোহারি বা পান দোকান বলে খ্যাত অতি ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানগুলো ভোক্তাদের সঙ্গে পণ্যের সম্পর্ক সৃষ্টির ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। জাতিসংঘের ক্যাপিটাল ডেভেলপমেন্ট ফান্ড বা জাতিসংঘ পুঁজি উন্নয়ন তহবিল কর্তৃক ২০১৮ সালে পরিচালিত জরিপের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশে ১৩.১০ লাখ অতি ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী রয়েছে, যাদের বছরে টার্নওভার হচ্ছে প্রায় ১৮.৪২ বিলিয়ন টাকা এবং প্রায় ২০ লাখ লোক এ ব্যবসার সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে সংযুক্ত। জাতিসংঘের ক্যাপিটাল ডেভেলপমন্টে ফান্ড তাদের এ রিপোর্টে উল্লেখ করেছে, ২০১২-১৩ সাল থেকে জিডিপিতে তাদের অবদান ছিল ১৩ শতাংশ।
আগামীনিউজ/এএইচ