ঢাকাঃ ঢাকা-৭ আসনের সরকারদলীয় সংসদ সদস্য হাজী মোহাম্মদ সেলিমের মেজো ছেলে ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) ৩০ নম্বর ওয়ার্ডের সরকার সমর্থিত কাউন্সিলর (বরখাস্ত হওয়া) মোহাম্মদ ইরফান সেলিম ছোটবেলা থেকেই কানাডায় থেকেছেন। কানাডায় থাকার কারণে বাংলা ভাষার সঙ্গে তেমন সম্পর্ক ছিল না ইরফানের। হঠাৎ করেই দেশে ফিরে রাজনীতি শুরু করেন ইরফান। তবে বাংলা ভাষার চর্চা তখনও ঠিক করে উঠতে পারেননি তিনি।
পুলিশের এলিট ফোর্স র্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত চলাকালীন সময়ে আদালতের কাছে অপরাধের স্বীকারোক্তি লিখতে গিয়ে বাংলার চেয়ে ইংরেজি লিখতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করার কথা জানিয়েছিলেন ইরফান। কিন্তু ভ্রাম্যমাণ আদালত সেটাতে অস্বীকৃতি জানায়। পরে বাংলা লিখতে অপারগতা প্রকাশ করেন এই কাউন্সিলর। পরবর্তীতে অন্য একজনের সহায়তায় বাংলা লেখা দেখে, নিজের অপরাধের স্বীকারোক্তিমূলক স্টেটমেন্ট দেন ইরফান।
র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আশিক বিল্লাহ বলেন, ‘ইরফানের বাংলাটা খুব একটা ভালো না। সে ইংরেজি বলতে ও লিখতে অভ্যস্ত বলে মনে হয়েছে। আদালতের আদেশের নিজের নাম বাংলা লিখতেও অপারগতা প্রকাশ করেন।’
কাউন্সিলর মোহাম্মদ ইরফান সেলিম রাজসিক জীবনযাপন করেও উগ্র আচরণে অভ্যস্ত ছিলেন বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা। র্যাবের অভিযানে গ্রেফতার হওয়ার পর তারা মুখ খুলতে শুরু করেছেন।
ইরফান সেলিমের বিলাসবহুল জীবনযাপনের নানা তথ্য খুঁজে পেয়েছে র্যাব। তার ছিল ১২ জন দেহরক্ষী এবং সার্বক্ষণিক সঙ্গী থাকতো প্রায় ৩০-৪০ জন যুবক। শুধুমাত্র গোপালগঞ্জ জেলার বাসিন্দা এবং তার চোখে দেখতে স্মার্ট যুবকদের দেহরক্ষী হিসেবে নিয়োগ দিতেন ইরফান।
২০১৮ সালে ঢাকা-৭ আসনের সংসদ সদস্য হাজী সেলিম অসুস্থ হয়ে পড়লে তার সিংহাসনে আসীন হন তার ছেলে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৩০ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর ইরফান।
ইরফানের বিষয়ে তদন্ত করতে গিয়ে তারা এমন একটি ব্যক্তিগত নজরদারি নেটওয়ার্ক পেয়েছেন যেখানে রয়েছে ক্লোজ সার্কিট টেলিভিশন (সিসিটিভি) ক্যামেরা এবং চোরাচালানের মাধ্যমে আনা ওয়াকি-টকি। এসব ব্যবহার করে ইরফান তার ব্যবসার সাম্রাজ্য পর্যবেক্ষণ করতেন।
র্যাব বলছে, অধিকাংশ দেহরক্ষীরই অবৈধ অস্ত্র আছে। ব্যবহারের চেয়ে ভয়ভীতি দেখানোর কাজে ব্যবহার করা হত। এই অস্ত্রগুলো অবৈধ পথে বিদেশ থেকে নিয়ে আসাট গত মঙ্গলবার (২৭ অক্টোবর) তার দেহরক্ষী জাহিদুলের কাছ থেকে এমনই এক অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার করে র্যাব।
র্যাব সূত্র বলছে, দেহরক্ষীদের সঙ্গে নিয়মিত মদ পান করেন ইরফান। ঘটনার দিন নৌবাহিনীর কর্মকর্তা ওয়াসিফ আহম্মেদ খানকে যখন মারধর করা হয় তখনও তিনি মাদক সেবন করেছিলেন। মদ খেয়ে মাতাল অবস্থাতেই মারধর করেন তিনি। ঘটনার পর বাসায় ফিরে নিজের ভুল বুঝতে পারেন ইরফান। এই মারধরের পরিণাম ভাল হবে না ভেবে আবার দাদা বাড়ির চারতালায় নিজের বারে ঢুকে সারারাত মদ পান করেন। অভিযান শুরু হলে র্যাবকে সঠিক তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেন। নিজের মদ পানের কথাও স্বীকার করেন। অভিযান চলাকালীন সময়েই তার ডোপ টেস্ট করে র্যাব। সেটার রেজাল্টও পজিটিভ আসে।
তিন ভাইয়ের মধ্যে মোহাম্মদ ইরফান সেলিম দ্বিতীয়। তাছাড়া বড় ভাই সোলায়মান সেলিম পিতার ব্যবসা দেখাশোনার পাশাপাশি পুরান ঢাকার আহমেদ বাওয়ানী স্কুল অ্যান্ড কলেজের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন এবং ছোট ভাই আশিক সেলিম অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী বলে জানা গেছে।
জানা গেছে, একদিকে এমপিপুত্র ও অন্যদিকে নোয়াখালী-৪ আসনের সাংসদ একরামুল করীম চৌধুরীর জামাতা এবং নিজে কাউন্সিলর ছিলেন ইরফান। ঢাকায় তাদের পরিবারের অন্তত ১৫০টির মতো সুউচ্চ ভবন রয়েছে।
শুধু পুরান ঢাকায় ৩০টি ভবন রয়েছে সেলিম পরিবারের। ওইসব ভবন মার্কেট ও বাড়ি হিসেবে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। এছাড়া সিমেন্ট, জাহাজ, ফ্রুটস ও ট্রেডিং ব্যবসা রয়েছে ওই পরিবারের।
তবে ইরফান সেলিম সম্পর্কে জানতে চাইলে মিটফোর্ডের একজন ব্যবসায়ী বলেন, ইরফান অন্যান্য কাউন্সিলের চেয়ে ভালো মন-মানসিকতার। বয়স কম হওয়াতে চলাফেরাটা ঠিক নয়। কিন্তু আর অন্য কোনোভাবে ব্যবসায়ীদের ডিস্টার্ব করেন না।
ইরফান কাউন্সিলর হিসেবে কেমন কাজ করেছেন- জানতে চাইলে মারুফ নামে ছোট কাটারার একজন বাসিন্দা জানান, চম্পাতলী ইউনাইটেড নামে ইরফান সেলিমের একটা সংগঠন রয়েছে। করোনাভাইরাস মহামারীর মধ্যে ওই সংগঠন থেকে লোকজনকে সহযোগিতা করা হয়েছে এবং এখনও প্রতি শুক্রবার সংগঠনের ব্যানারে গরীব মানুষদের খাবার দেওয়া হয়।
তিনি বলেন, লকডাউনের সময় লোকজনকে ঘরে থাকতে উদ্বুদ্ধ করার কাজে তাকে দেখা গেছে। চম্পাতলী, দেবীদাস ঘাট লেন, চক মোগলটুলী, সোয়ারিঘাট, ইমামগঞ্জ ও মিটফোর্ড হাসপাতাল এলাকা ৩০ নম্বর ওয়ার্ডের অন্তর্ভুক্ত। এসব এলাকায় মশা নিধনের কার্যক্রমেও ইরফান সেলিমকে দেখা গেছে।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ডিবি পুলিশের উপ-পরিদর্শক মবিনুল ইসলাম বলেন, তদন্তের স্বার্থে আরও দুই দিন জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তাদের রিমান্ডে পেয়েছি। তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করে আরও অনেক বিষয়ে পরিষ্কার হওয়া যাবে।
প্রসঙ্গত, গত ২৬ অক্টোবর ভোরে হাজী সেলিমের ছেলে ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে ধানমন্ডি থানায় হত্যাচেষ্টার মামলা করেন নৌবাহিনীর লেফটেন্যান্ট ওয়াসিফ আহমদ খান। মামলার আসামিরা হলেন- এরফান সেলিম, তার বডিগার্ড মোহাম্মদ জাহিদ, হাজী সেলিমের মদিনা গ্রুপের প্রটোকল অফিসার এবি সিদ্দিক দিপু এবং গাড়িচালক মিজানুর রহমানসহ অজ্ঞাত আরও ২-৩ জন।
এর আগের দিন ২৫ অক্টোবর রাতে কলাবাগানের ট্রাফিক সিগন্যালে হাজী সেলিমের একটি গাড়ি থেকে দুই-তিনজন ব্যক্তি নেমে ওয়াসিম আহমেদ খানকে ফুটপাতে ফেলে এলোপাতাড়ি মারধর করেন। পরে ট্রাফিক পুলিশ এসে তাকে উদ্ধার করেন। পথচারীরা এই দৃশ্য ভিডিও করেন, যা মুহূর্তেই ফেসবুকে ভাইরাল হয়ে যায়। ধানমন্ডি থানা পুলিশ এসে ঘটনাস্থল থেকে গাড়িটি থানায় নিয়ে যায়।
ওয়াসিফ আহমেদ এজাহারে অভিযোগ করেন, তিনি নীলক্ষেত থেকে বই কিনে মোটরসাইকেলে মোহাম্মদপুরের বাসায় ফিরছিলেন। তার স্ত্রীও সঙ্গে ছিলেন। ল্যাবএইড হাসপাতালের সামনে তার মোটরসাইকেলটিকে পেছন থেকে একটি গাড়ি ধাক্কা দেয়। ওয়াসিম আহমেদ মোটরসাইকেল থামিয়ে গাড়িটির গ্লাসে নক করে নিজের পরিচয় দিয়ে ধাক্কা দেয়ার কারণ জানতে চান। তখন এক ব্যক্তি বের হয়ে তাকে গালিগালাজ করে গাড়িটি চালিয়ে কলাবাগানের দিকে চলে আসেন।
মোটরসাইকেল নিয়ে ওয়াসিফ আহমেদও তাদের পেছনে পেছনে আসেন। কলাবাগান বাসস্ট্যান্ডে গাড়িটি থামলে ওয়াসিফ তার মোটরসাইকেল নিয়ে গাড়ির সামনে দাঁড়ান। তখন তিন-চার জন লোক গাড়ি থেকে নেমে বলতে থাকে, তোর নৌবাহিনী/সেনাবাহিনী বাইর করতেছি, তোর লেফটেন্যান্ট/ক্যাপ্টেন বাইর করতেছি। তোকে আজ মেরেই ফেলবো। এই বলে তাকে কিলঘুষি দিতে থাকেন। এরপর তারা পালিয়ে যান।
২৬ অক্টোবর সকালে মামলা দায়েরের পর ওইদিন দুপুরে র্যাব পুরান ঢাকার চকবাজারে হাজী সেলিমের বাড়িতে অভিযান চালায়। সেখান থেকে ইরফান সেলিম ও জাহিদকে র্যাব তাদের হেফাজতে নেয়। বাসায় অবৈধভাবে মদ ও ওয়াকিটকি রাখার দায়ে র্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত তাদের দুই জনকে দেড় বছর করে কারাদণ্ড দেন। র্যাব তাদের দুই জনের বিরুদ্ধে মাদক ও অস্ত্র আইনে দুটি করে চারটি মামলা দায়ের করেছে।
আগামীনিউজ/জেহিন