ঢাকাঃ গত পাঁচ বছরে অবৈধভাবে ৫ শতাধিক নারী-পুরুষকে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে পাঠানোর নামে ৩০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে একটি চক্র। অবৈধভাবে মধ্যপ্রাচ্যে নারী-পুরুষ পাঠানোর পাশাপাশি এই চক্রটি সক্রিয় ছিল বিদেশ গমনেচ্ছুদের টার্গেট করে ভুয়া পাসপোর্ট ও টিকিট ধরিয়ে দিয়ে টাকা হাতিয়ে নেওয়ার কৌশলেও। জনপ্রতি নেওয়া হতো ৫ থেকে ৭ লাখ টাকা করে। পরবর্তী সময়ে ভুয়া ভিসা ও টিকিট ধরিয়ে দেওয়া হলে ইমিগ্রেশন থেকে ফিরিয়ে দেওয়া হতো ভুক্তভোগীদের। পরে এ বিষয়ে প্রতিকার চাইতে এলে ভুক্তভোগীরা এসে দেখতো অফিসের ঠিকানা পরিবর্তন করে অন্য জায়গায় চলে যেতো চক্রটি।
বিদেশে পাঠানোর নামে প্রতারণার অভিযোগে রাজধানীর রামপুরা ও হাতিরঝিল এলাকা থেকে প্রতারক চক্রটির চার সদস্যকে গ্রেফতারের পর জিজ্ঞাসাবাদে এমনই সব তথ্য পায় র্যাব। শুক্রবার (১৫ এপ্রিল) দিবাগত রাতে তাদের গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতারকৃতরা হলো— কামরুল আহমেদ (৪২), খালেদ মাসুদ হেলাল (৩৬), তোফায়েল আহমেদ (৩৮) ও মোহাম্মদ জামাল (৪২)। এসময় তাদের কাছ থেকে ২৭টি পাসপোর্ট, একটি মনিটর, একটি সিপিইউ, ১০০ ভিসার কপি, ১২৫টি টিকেট, কোভিড-১৯ নমুনা সংগ্রহ পরীক্ষার কাগজ প্রভৃতি উদ্ধার করা হয়।
শনিবার (১৬ এপ্রিল) রাজধানীর কারওয়ান বাজার সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলনে এই ঘটনার বিস্তারিত তুলে ধরেন র্যাব-৩ এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আরিফ মহিউদ্দিন আহমেদ।
র্যাব কর্মকর্তা জানান, ১২ মার্চ চক্রটি মৌলভীবাজার থেকে একজন নারীকে মধ্যপ্রাচ্যের একটি দেশে পাঠানোর কথা বলে প্রলোভন দেখিয়ে রামপুরা এলাকার গ্রেফতারকৃত কামরুলের বাসায় নিয়ে আসে। সেই বাসায় ওই নারীকে আটক রেখে গ্রেফতারকৃত তোফায়েল জোরপূর্বক তাকে ধর্ষণ করেন। সেই নারী মোবাইল ফোনে র্যাবের কাছে সাহায্য চাইলে র্যাব ১৩ মার্চ সেই বাসায় অভিযান চালিয়ে নারীকে উদ্ধার করে। পরে সেই নারীকে জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের পরিচয়ের সূত্র ধরে সাইফুল ইসলাম শান্ত নামে এক যুবককে বিয়ে করেছিলেন তিনি। বিয়ের পর সাইফুল ৫০ হাজার টাকা যৌতুকের জন্য চাপ দেন। মেয়ের বাবা অনেক কষ্টে ধারদেনা করে সেই টাকা সংগ্রহ করে তার হাতে তুলে দিলে সাইফুল সেই টাকা নিয়ে পালিয়ে যান।
সেই নারীর বাবা বিভিন্নজনের কাছ থেকে ধার দেনা করে টাকা সংগ্রহ করেছিলেন। পাওনাদাররা সেই টাকা তোলার জন্য তোফায়েলের দ্বারস্থ হয়। তোফায়েল সেই নারীর অসহায়ত্বকে পুঁজি করে তাকে সৌদি আরবে পাঠানোর কথা বলে ঢাকায় নিয়ে আসেন। সৌদি ভাষা শেখানোর কথা বলে তার বাসায় রেখে ধর্ষণ করেন। এ ঘটনায় রামপুরা থানায় একটি মামলা হয়েছে।
গ্রেফতারকৃতদের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানা গেছে, তারা সংঘবদ্ধ মানবপাচার ও প্রতারক চক্রের সদস্য। কামরুল এই চক্রের মূল হোতা এবং অপরাপর আসামিরা তার সহযোগী। তাদের জনশক্তি রফতানির কোনো লাইসেন্স নেই। কিন্তু তারা দীর্ঘদিন ধরে জনশক্তি রফতানির নামে অবৈধভাবে ভ্রমণ ভিসার মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যের একটি দেশে লোক পাঠিয়ে আসছে। এছাড়াও এই চক্র মধ্যপ্রাচ্য হয়ে ইউরোপে জনশক্তি পাঠানোর প্রলোভন দেখিয়ে বিদেশ গমনে ইচ্ছুক বেকার যুবক যুবতিদের কাছ থেকে পাঁচ থেকে সাত লাখ টাকা করে হাতিয়ে নিয়ে ভুয়া ভিসা এবং ভুয়া টিকেট ভুক্তভোগীদের হাতে ধরিয়ে দিতো। ভুক্তভোগীরা সেই ভিসা এবং টিকেট নিয়ে বিমানবন্দরে গেলে ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষ তাদের ভিসা ও টিকেট জাল হওয়ায় বিমানবন্দর থেকে ফিরিয়ে দিতো। ভুক্তভোগীরা এবিষয়ে প্রতিকার চাইলে গ্রেফতারকৃতরা তাদের সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে বাসার ঠিকানা পরিবর্তন করে দিতো।
এভাবে গত দুই বছরে প্রতারণা ঢাকতে তারা আটবার বাসার ঠিকানা পরিবর্তন করে। গত পাঁচ বছরে এই চক্রটি অবৈধভাবে শতাধিক লোককে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে পাঠায়। যারা বিদেশ গিয়ে কাজ না পেয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছে। অন্যদিকে এই চক্র শতাধিক লোককে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে পাঠানোর প্রলোভন দেখিয়ে জনপ্রতি পাঁচ থেকে সাত লাখ টাকা করে হাতিয়ে নিয়ে ভুয়া ভিসা এবং ভুয়া টিকেট সরবরাহ করে প্রায় ৩০ কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়।
প্রতারক কামরুল ও তার সহযোগীদের পরিচয়
এই চক্রের মূল হোতা কামরুল নবম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেছেন। তার কোনো নির্দিষ্ট পেশা নেই। প্রতারণা ও মানবপাচারই তার পেশা। ২০১৯ সালে তিনি ভ্রমণ ভিসায় দুবাই যান। এরপর সেখানে মানবপাচারের মাধ্যমে অর্জিত অর্থ দিয়ে দুবাইয়ের রেসিডেন্স ভিসা লাভ করেন। একটি প্রাইভেটকার কিনে নিজে ড্রাইভিং করে ভাড়ায় সেই প্রাইভেটকার চালিয়ে অর্থ উপার্জন করেন। বিশ্বে করোনার প্রাদুর্ভাব শুরু হলে প্রাইভেটকারটি বিক্রি করে গত বছরের মে মাসে তিনি দেশে ফিরে এসে পুনরায় প্রতারণা এবং মানবপাচারকে পেশা হিসেবে বেছে নেন। তার জনশক্তি রফতানির কোনো লাইসেন্স নেই। তিনি বিভিন্ন টুরস ও ট্রাভেলসের সাথে যোগাযোগ করে অবৈধভাবে ভ্রমণ ভিসায় বিভিন্ন দেশে লোক পাঠাতেন। যারা বিদেশ গিয়ে কাজ না পেয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছে। তিনি বিদেশ পাঠানোর নাম করে পাঁচ শতাধিক মানুষের সাথে প্রতারণা করেছে। কামরুলের নামে চট্টগ্রাম কোর্টে একটি চেক জালিয়াতির মামলা এবং মৌলভীবাজার কোর্টে ডাচ বাংলা ব্যাংকে ১৮ লাখ টাকার একটি মামলা রয়েছে। তার বিভিন্ন ব্যাংক অ্যাকাউন্টে ৩৮ লাখ টাকার উপরে আছে।
কামরুলের অন্যতম সহযোগী জামাল মাহবুব ইন্টারন্যাশনালের অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার। মাহবুব ইন্টারন্যাশনাল মানবপাচারের সাথে সম্পৃক্ত থাকায় বিএমইটি তাদের লাইসেন্স ব্লক করে দিয়েছে। এক মাস আগে মাহবুব ইন্টারন্যাশনালের এমডি মানবপাচারের দায়ে র্যাব-৩ এর কাছে ধরা পড়েন। জামাল সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেছেন। পাঁচ বছর ধরে তিনি কামরুলের সাথে প্রতারণা এবং মানবপাচারের কাজ করে আসছেন। জামালের নামে একটি মাদক মামলা রয়েছে।
খালেদ ২০০১ সাল থেকে দীর্ঘ ১৫ বছর সৌদি আরবে ছিলেন। ২০১৬ সালে বাংলাদেশে ফেরত এসে তিনি রাজনগর মৌলভীবাজারে রেস্টুরেন্টের ব্যবসা শুরু করেন। কিন্তু ওই ব্যবসায় তিনি সফল হতে না পেরে কামরুলের সাথে প্রতারণা ও মানবপাচারের কাজে যোগ দেন। তিনি অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেছেন।
তোফায়েলের পেশা ড্রাইভিং। এছাড়াও মৌলভীবাজারে তার সিএনজি পার্টস এবং ডেকোরেটরসের ব্যবসা রয়েছে। অতি লাভের আশায় তিনি কামরুলের সাথে প্রতারণা ও মানবপাচারের কাজে যোগ দেন। কামরুলের বড় ভাইয়ের মাধ্যমে তার সাথে পরিচিত হন।
উদ্ধারকৃত নারী তোফায়েলের গ্রাম সম্পর্কীয় আত্মীয়। সেই নারীর অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে তার সম্ভ্রম নষ্ট করার লক্ষ্যে তিনি ওই নারীকে সৌদি আরবে পাঠানোর প্রলোভন দেখান। এরপর সেই নারীকে কৌশলে ঢাকায় নিয়ে এসে কামরুলের বাসায় আটকে রেখে ধর্ষণ করেন। তার নামে থানায় একটি চুরির মামলাও রয়েছে।
এমএম