Dr. Neem on Daraz
Victory Day
দ্রুত রায় কার্যকর করার দাবী

নারায়ণগঞ্জের আলোচিত সাত খুনের সাত বছর


আগামী নিউজ | রফিকুল ইসলাম রফিক, নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রতিনিধি প্রকাশিত: এপ্রিল ২৭, ২০২১, ০৩:৩৩ পিএম
নারায়ণগঞ্জের আলোচিত সাত খুনের সাত বছর

সংগৃহীত

নারায়ণগঞ্জ: জেলার চাঞ্চল্যকর বহুল আলোচিত সাত খুনের ঘটনা সাত বছর পেরিয়ে গেলেও আসামিদের সাজা কার্যকর হয়নি এখনও। নিন্ম ও উচ্চ আদালতের রায়ের পর মামলাটি আপিল বিভাগে ঝুলে আছে আড়াই বছর ধরে। এতো দিনেও আসামিদের সাজা কার্যকর না হওয়ায় হতাশ ও ক্ষুব্ধ নিহতের স্বজনরা। তবে দ্রুত শুনানীর উদ্যোগ নেয়া হবে বলে জানান অ্যার্টনি জেনারেল।

এই দীর্ঘ সময়ে নিন্ম ও উচ্চ আদালতের সন্তোষ জনক রায় উচ্চ আদালতে বহাল রেখে অবিলম্বে কার্যকর করার দাবী নিহতদের পরিবার সহ নারায়ণগঞ্জ নাগরিক সমাজ ও সাধারণ মানুষের। প্রত্যাশা আপীল আদালতেও নিন্ম ও উচ্চ আদালতের রায় বহাল থাকবে। ধীরগতির কারণে এখনো নিহতের পরিবারের সদস্যরা ভয় আতংকে আছেন বলেও জানান। এ রায় কার্যকর হলে তা যুগান্তকারী হয়ে থাকবে এবং আইনের শাসন প্রতিষ্টিত হবে। জেলা জজ আদালতে ৩৫ আসামীর মধ্যে ২৬ জনকে মৃত্যুদন্ড এবং ৯ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দিলেও হাই কোর্ট ১৫ জনের মৃত্যুদন্ড বাকিদের বিভিন্ন মেয়াদে সাজা বহাল রাখেন।

২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জ আদালতে মামলায় হাজিরা দিয়ে ফেরার পথে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোডের লামাপাড়া এলাকা থেকে নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলাম ও আইনজীবি চন্দন সরকারসহ সাতজনকে অপহরণ করা হয়। অপহরণের তিনদিন পর শীতলক্ষ্যা নদীর বন্দরের শান্তিরচর থেকে সাত জনের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। আলোচিত ৭ খুনের নৃশংসতা শুধু নারায়ণগঞ্জবাসীকেই নয় পুরো দেশ নাড়িয়ে দিয়েছিলো। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের সংম্পৃক্ততার কারণে এই ঘটনা আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেও আলোচিত ছিলো।

এই ঘটনায় নিহত নজরুল ইসলামের স্ত্রী সেলিনা ইসলাম বিউটি ও নিহত আইনজীবী চন্দন সরকারের জামাতা বিজয় কুমার পাল বাদী হয়ে পৃথক দুটি মামলা দায়ের করেন ফতুল্লা থানায়। পরে আদালত আসামীদের স্বীকারোক্তি, জবানবন্দি ও স্বাক্ষ্যগ্রহন শেষে ৩৩ মাস পর জেলা ও দায়রা জজ আদালত ২০১৭ সালের ১৬ জানুয়ারী রায় প্রদান করেন। রায়ে ২৬ জনকে মৃত্যুদন্ড ও ৭ জনকে ১০ বছর করে এবং ২ জনকে ৭ বছর করে কারাদন্ড প্রদান করা হয়।
ওই রায়ের বিরুদ্ধে আসামিপক্ষ আপিল করলে দীর্ঘ শুনানি শেষে ২০১৮ সালে ২২ আগস্ট হাই কোর্ট ১৫ জনের মৃত্যুদন্ডের আদেশ বহাল রাখেন। আর বাকিদের বিভিন্ন মেয়াদে সাজা প্রদান করেন।

নিহত কাউন্সিলর নজরুল ইসলাম ও আইনজীবি চন্দন সরকারের পরিবারের দাবি উচ্চ আদালতে যেন এ রায় বহাল রাখেন। রায় দ্রুত কার্যকর করে নিহতদের আত্বা শান্তি পাবে এমনটাই দাবি। উচ্চ আদালতে ধীরগতির কারণে এখনো নিহতের পরিবারের সদস্যরা ভয় আতংকে আছেন বলে জানান মামলার বাদী ও নিহত নজরুল ইসলামের স্ত্রী সেলিনা ইসলাম বিউটি।

নিন্ম ও উচ্চ আদালত থেকে হাইকোর্টের দেয়া রায় সন্তোষজনক হয়েছে জানিয়ে নিহতের পরিবারের সদস্যরা আপীল বিভাগেও এ রায় বহাল থাকবে প্রত্যাশা করে তা দ্রুত কার্যকর করার দাবী জানান নিহত মনিরুজ্জামান স্বপনের ছোট ভাই মিজানুর রহমান রিপন। আর এজন্য প্রধানমন্ত্রীর দেয়া সুবিচারের আশ্বাসের বাস্তবায়ন চান তারা।

আপীল আদালতেও হাই কোর্টের রায় বহাল থাকবে এমনটাই প্রত্যাশা করেন নারায়ণগঞ্জের মানবাধিকার কর্মীসহ সচেতন নাগরিক মানবাধিকার কমিশন, নারায়ণগঞ্জ জেলা সভাপতি মাহবুবুর রহমান মাসুম। তারা দ্রুত এ ফাঁসির রায় কার্যকর করার দাবি জানিয়ে বলেন, এটা দৃষ্টান্ত ও যুগান্তকারী হয়ে থাকবে। শুধু নারায়ণগঞ্জ নাগরিক সমাজই নয় নিম্ম আদালতের রায় বহাল থাকবে এবং দ্রুত ফাঁসি কার্যকর করার দাবী সাধারণ মানুষেরও।

হাইকোর্ট নূর হোসেন, তারেক সাঈদসহ ১৫ জনের ফাঁসির আদেশ বহাল রেখে বাকি আসামিদের বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেন। এরপর থেকে মামলাটি আড়াই বছর ধরে আপিল বিভাগে চূড়ান্ত নিষ্পত্তির অপেক্ষায় আছে। আর রাষ্ট্রপক্ষ বলছে, বাদিপক্ষ আবেদন করলে মামলাটি দ্রুত শুনানী করা হবে।

আলোচিত সাত খুনের নৃশংসতা শুধু নারায়ণগঞ্জবাসীকেই নয় পুরো বিশ্ববাসীকেও নাড়া দিয়েছিল। নারায়ণগঞ্জবাসীর ললাটে এঁটে দিয়েছিল কলঙ্ক। দেশের গন্ড পেরিয়ে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেও আলোচিত হয়েছিল সাত খুনের ইস্যুটি। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এলিট ফোর্স র‌্যাব সদস্যদের সম্পৃক্ততায় নারায়ণগঞ্জের ইতিহাসে তো বটেই দেশের ইতিহাসেও ন্যক্কারজনক ঘটনার একটিতে পরিণত হয়েছিল সাত খুনের ঘটনাটি। তবে আলোচিত ওই হত্যাকা-ের সাত বছর পূর্ণ হলেও অদ্যাবধি হত্যাকান্ডের রায় বাস্তবায়ন হয়নি। নিম্ন আদালতের পরে হাইকোর্টেও দ্রুত রায় ঘোষণা করা হলেও আপিল বিভাগে রায়টি নিষ্পত্তি হতে ধীরগতির অভিযোগ করেছেন নিহতের স্বজনরা।

যে ভাবে অপহরণ
২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জের একটি আদালতে হাজিরা শেষে প্রাইভেট কারযোগে ফিরছিলেন এনসিসি’র প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলাম, তার বন্ধু মনিরুজ্জামান স্বপন, তাজুল ইসলাম, লিটন ও গাড়িচালক জাহাঙ্গীর আলম। একইসময়ে আদালতের কার্যক্রম শেষে অপর একটি প্রাইভেট কারে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন নারায়ণগঞ্জের সিনিয়র আইনজীবী চন্দন কুমার সরকার ও তার গাড়িচালক ইব্রাহীম। পথিমধ্যে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোডের ফতুল্লার খান সাহেব ওসমান আলী স্টেডিয়ামের সামনে থেকে সাদা পোশাক পরিহিত র‌্যাব সদস্যরা তাদের সাতজনকেই অপহরণ করে। সাতজনকে অপহরণের ঘটনায় উত্তাল হয়ে ওঠে নারায়ণগঞ্জ। দফায় দফায় চলতে থাকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক, ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক ও ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোড অবরোধ।

লাশ উদ্ধার
পরে ৩০ এপ্রিল শীতলক্ষ্যা নদীর চর ধলেশ্বরী এলাকা থেকে ছয়জনের ও ১ মে একজনের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। সাতজনকে হত্যাকা-ের ঘটনায় একই পন্থা ও কায়দা অবলম্বন করা হয়। নিহতদের মধ্যে সবাইকে একই স্টাইলে হত্যা করে নদীতে ফেলে দেওয়া হয়। যাতে করে লাশ ভেসে উঠতে না পারে। উদ্ধার করা লাশের সবারই হাত-পা বাঁধা ছিল, পেটে ছিল ফাঁড়া। ১২টি করে ইট ভর্তি সিমেন্টের বস্তার দুটি বস্তা বেঁধে দেওয়া হয় প্রতিটি লাশের সঙ্গে। তাদের সবার লাশের মুখ ছিল ডাবল পলিথিন দিয়ে মোড়ানো। মামলা চলাকালে প্রধান আসামিকে ভারত থেকে ফিরিয়ে আনা, আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে আসামিদের চোখ রাঙানি, নরঘাতকদের পক্ষে আদালতপাড়ায় শোডাউনসহ নানা ঘটনায় গেল পৌনে ৩ বছর ধরেই আলোচিত ছিল সাত খুনের মামলাটি। তদন্ত শেষে প্রায় এক বছর পর ২০১৫ সালের ৮ এপ্রিল নূর হোসেন, র‌্যাবের সাবেক তিন কর্মকর্তাসহ ৩৫ জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দেয় ডিবি পুলিশ। ওই বছরের ১৩ নভেম্বর নূর হোসেনকে ভারত থেকে ফিরিয়ে আনা হয়।

অভিযোগ গঠন
২০১৬ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি দুটি মামলায় নূর হোসেনসহ ৩৫ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়। দুটি মামলায়ই অভিন্ন সাক্ষী হলো ১২৭ জন করে। যার মধ্যে দুটি মামলার বাদী, দুইজন তদন্তকারী কর্মকর্তা ও প্রত্যক্ষদর্শীসহ ১০৬ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ ও জেরা সম্পন্ন হয়। এরপর ২৪ অক্টোবর থেকে শুরু হয় আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ পড়ে শোনানো ও তাদের বক্তব্য গ্রহণের কার্যক্রম। ২১ নভেম্বর থেকে শুরু হয় যুক্তিতর্ক। গত ৩০ নভেম্বর শেষ হয় আলোচিত সাত খুন মামলার আইনি কার্যক্রম।

সাত খুন মামলার রায়
২০১৭ সালের ১৬ জানুয়ারি সকাল ১০টা ৪ মিনিট থেকে ১০টা ৯ মিনিট পর্যন্ত তৎকালীন নারায়ণগঞ্জ জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারক সৈয়দ এনায়েত হোসেন আলোচিত সাত খুন মামলার রায় ঘোষণা করেন। নারায়ণগঞ্জে আলোচিত সাত খুন মামলার প্রধান আসামি নাসিকের বরখাস্তকৃত কাউন্সিলর নূর হোসেন, র‌্যাবের চাকরিচ্যুত অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) তারেক সাঈদ মোহাম্মদ, উপ-অধিনায়ক মেজর (অব.) আরিফ হোসেন ও ক্যাম্প ইনচার্জ লেফটেন্যান্ট কমান্ডার (অব.) এমএম রানাসহ ২৬ জনের ফাঁসির আদেশ দেন আদালত। বাকি ৯ জনের মধ্যে অপহরণ ও লাশ গুমের সঙ্গে জড়িত থাকায় এক আসামিকে ১৭ বছর, অপহরণের সঙ্গে জড়িত থাকায় ছয়জনকে ১০ বছর এবং লাশ গুমে জড়িত থাকায় দুইজনকে সাত বছরের কারাদন্ড দিয়েছেন আদালত।

হাইকোর্টে রায়
হাইকোর্ট ২০১৭ সালের ২২ আগস্ট সাত খুনের মামলায় ১৫ জনের মৃত্যুদন্ড বহাল রেখে রায় দেন। হাইকোর্ট বিচারিক আদালতে মৃত্যুদন্ডাদেশ পাওয়া ১১ আসামির দন্ড পরিবর্তন করে যাবজ্জীবন কারাদন্ড দেন। ২০১৮ সালের ১৯ নভেম্বর দুই মামলায় মোট ১৫৬৪ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশ করেন হাইকোর্ট। পরে আসামিরা রায়ের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে যান। এরইমধ্যে ফাঁসির দন্ডপ্রাপ্ত ১০ জনসহ ১৩ জন আপিল করেছেন। এদিকে নিম্ন আদালতে ও হাইকোর্ট মামলাটির কার্যক্রম দ্রুত চলমান থাকলেও আপিল বিভাগে মামলাটির কার্যক্রম অত্যন্ত ধীরগতিতে চলছে বলে অভিযোগ করেছেন নিহতের স্বজনরা। অপরদিকে মামলাটির রায় দ্রুত বাস্তবায়নের মাধ্যমে নরঘাতকদের ফাঁসি দ্রুত কার্যকর করার দাবি জানিয়েছেন এলাকাবাসী।

আগামীনিউজ/নাহিদ

আগামী নিউজ এর সংবাদ সবার আগে পেতে Follow Or Like করুন আগামী নিউজ এর ফেইসবুক পেজ এ , আগামী নিউজ এর টুইটার এবং সাবস্ক্রাইব করুন আগামী নিউজ ইউটিউব চ্যানেলে