গাইবান্ধাঃ ‘হামার বাপ-দাদারা একান ব্রিজ চাইতে চাইতে মরি গেইছে, তাও ব্রিজ হয়নাই। হামার কপাল খারাপ বাহে। প্রত্যেকবার নেতারা হামাক ধোঁকা দেয়। ভোটের সময় এমপি, চেয়ারম্যান, মেম্বার সগাই (সকলে) হামার লোক হয়া (হন) যায়। আর ভোট বারাইলে হামাক চেনেনা। খালি কয় ভোট দেও, এবার ব্রিজ করি দেমো। হামরাও ওমারগুলের কথাত মজি যায়া কোমর বান্দিয়ে ভোট দেই। কিন্তু হামার ব্রিজ আর হয় না।’
নদী পারাপারের জন্য দীর্ঘদিনেও কাঙ্ক্ষিত সেতু নির্মাণ না হওয়ায় এভাবেই কথাগুলো বলছিলেন গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জের তারাপুর ইউনিয়নের খোর্দ্দা নামাপাতা গ্রামের বাসিন্দা ক্ষুব্ধ কৃষক আজিজুল ইসলাম (৪০)। যে সেতু নিয়ে এত ক্ষোভ, সেখানে এখন পারাপারের জন্য আছে একটি বাঁশের সাঁকো, যা আবার ভেঙে গেছে। বুড়াইল নদীর এই সাঁকোর উত্তর পাশের গ্রাম খোর্দ্দা নামাপাতা। বহুদিন ধরেই এখানে একটি সেতুর দাবি স্থানীয়দের। কিন্তু এই দাবির বিপরীতে তারা শুধু আশ্বাসই পেয়েছেন।
এ আক্ষেপ শুধু আজিজুল ইসলামের নয়। বুড়াইল নদীর দু'পারের ২০ গ্রামের প্রায় অর্ধলক্ষাধিক মানুষের। ভেঙে যাওয়া ব্রিজের ছবি তোলা দেখে ওই গ্রামের কল্পনা বেগম ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, 'এমার কোন কাম নাই, খালি আইসে আর ছবি তোলে। এললে ছবি তুলি নিয়ে যায়া উপরোত থাকি বাজেট নিয়ে আসি চেয়ারম্যান মেম্বরা খায়া তাজা হয়। বছরের পর বছর যায় হামার এই ব্রিজটেয় হয়না। এমন কোনো এমপি, টিউএনও (ইউএনও), চেয়ারম্যান-মেম্বার নাই, যাই এটে (যে এখানে) আইসে নাই। খালি আইসে আর দেখি কয়, খুব তাড়াতাড়ি এটা করি দেমো। চিন্তা করেন না। এখন মনে হয় ওমরাগুলা (তারা) হামার সাথে তামাশা করেন।'
জানা যায়, উপজেলার তারাপুর ইউনিয়ন এবং পার্শ্ববর্তী কুড়িগ্রামের উলিপুর উপজেলার বজরা ও গুনাইগাছসহ তিনটি ইউনিয়নের সংযোগ সড়ক এটি। তারাপুর ইউনিয়নের খোর্দ্দা, চর খোর্দ্দা, লাঠশালা, বৈরাগী পাড়া, মন্ডলপাড়া গ্রাম এবং বজড়া ও গুনাইগাছ ইউনিয়নের চরবিরহীম, সাধুয়া, দামারহাট, নাগড়াকুড়া, কালপানি, হুকাডাঙ্গা ও থেথরাসহ প্রায় ২০ গ্রামের মানুষ এ পথ ধরে চলাচল করেন। দুই উপজেলার সরকারি-বেসরকারি চাকরিজীবী, স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসাগামী শিক্ষার্থী, হাঁটুরে, বিভিন্ন ব্যবসায়ীসহ নানা শ্রেণি-পেশার প্রায় ৫০ হাজার মানুষ এ পথ দিয়ে দৈনন্দিন যাতায়াত করে।
খোর্দ্দা নামাপাতা গ্রামের ওপর দিয়ে চলে গেছে বুড়াইল নদী। নদীটি ছোট হওয়ায় বাঁশের সাঁকো আবার কখনো কাঠের সাঁকো দিয়েই চলত গ্রামবাসীর যাতায়াত। কিন্তু পরে তিস্তা নদী ভেঙে বুড়াইলে পানিপ্রবাহ বাড়ে। বেড়ে যায় বুড়াইল নদীর প্রস্থও। পরিচিতি পায় তিস্তার শাখা নদী হিসেবে। তখন থেকেই নদী পারাপারের জন্য সেতু নির্মাণের দাবি আরও জোরালো হয়। কিন্তু এর বিপরীতে শুধু আশ্বাসই মিলেছে। কাজের কোনো কাজ হয়নি। ২২ বছর ধরে নড়বড়ে বাঁশের সাঁকোই এ নদী পারাপারের একমাত্র অবলম্বন। প্রতি বছরই এ সাঁকো ভেঙে যায়। প্রতি বছরই নতুন করে গড়তে হয়। আর সংস্কার তো লেগেই আছে। বছরে অন্তত দুবার এ সাঁকো সংস্কার করা করতে হয় বলে জানিয়েছে স্থানীয়রা।
স্থানীয় মানিক ব্যাপারী বলেন, 'জন্মের পর থেকে এখানে কখনো কাঠের সাঁকো, আবার কখনো বাঁশের সাঁকো দেখছি। সেটিও করা হয় এলাকার মানুষের স্বেচ্ছাশ্রম ও নিজস্ব অর্থায়নে। মাস দু-এক আগ থেকে সাঁকোটি নড়বড়ে হয়ে যায়। ঝুঁকি জেনেও এর ওপর দিয়ে যাতায়াত করতে গিয়ে গত ১৫ দিনে কমপক্ষে পাঁচটি দুর্ঘটনা ঘটে। ইদানীং নদীর স্রোতে কচুরীপানা ভেসে আসে। নড়বড়ে সাঁকোর খুঁটিতে তা চাপ দেয়। এসব কারণে আগে থেকেই দুর্বল খুঁটি ভেঙে সপ্তাহখানেক আগে সাঁকোটি ভেঙে নদী পড়ে। এখন ভয়াবহ দুর্ভোগে রয়েছেন এ নদীর দুপারের মানুষ।'
এবিষয়ে তারাপুর ইউপি চেয়ারম্যান আমিনুল ইসলাম বলেন, ‘আমার ইউনিয়নে কমপক্ষে ১০টি এ ধরনের সাঁকো আছে। প্রতি বছর সেগুলো মেরামত করতে হয়, যা পরিষদের পক্ষে সম্ভব না। সে কারণে স্থানীয় ব্যক্তিবর্গের সহায়তায় সেগুলো মেরামত করা হয়। তবে ব্রিজ নির্মাণে ইতোপূর্বে কয়েকবার সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি।’
উপজেলা প্রকৌশলী শামছুল আরেফীন বলেন, ‘যেখানে সাঁকো আছে, সেখানেই স্থায়ীভাবে ব্রিজ নির্মাণের জন্য সংশ্লিষ্ট দপ্তরকে জানানো হয়েছে। বরাদ্দ পেলেই ব্রিজ নির্মাণ করা হবে।’
ব্রিজ নির্মাণের আশ্বাস দিয়ে স্থানীয় সংসদ সদস্য শামীম হায়দার পাটোয়ারী বলেন, ‘সেতু নির্মাণে তালিকা পাঠানো হয়েছে। করোনার কারণে দেরি হচ্ছে। আশা করছি খুব দ্রুত সময়ে হয়ে যাবে। আপাতত ওখানে বাঁশের সাঁকো করে দেব। ব্রিজ না হওয়া পর্যন্ত এটি অব্যাহত থাকবে।’
সুদীপ্ত শামীম/এমবুইউ