Dr. Neem on Daraz
Victory Day

৫৩ বছর ইমামতি করে পেলেন রাজকীয় বিদায়, কাঁদলেন মুসুল্লিরা


আগামী নিউজ | নিজস্ব প্রতিবেদক প্রকাশিত: মে ৭, ২০২২, ০১:৪৩ পিএম
৫৩ বছর ইমামতি করে পেলেন রাজকীয় বিদায়, কাঁদলেন মুসুল্লিরা

পাবনাঃ মাত্র ২৪-২৫ বছর বয়সে এসে ইমামতি ও গ্রামের মক্তবে পড়ানো শুরু করেন। দীর্ঘ ৫৩ বছর ধরে ইমামতি করেছেন হাফেজ মাওলানা আবু মুসা। আর তাই তো তাকে রাজকীয়ভাবে বিদায় জানিয়ে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন পাবনার সাঁথিয়া উপজেলার ক্ষেতুপাড়া ইউনিয়নের যশমন্তদুলিয়া গ্রামের মুসল্লিরা।

ঈদের পরের দিন বুধবার (০৪ মে) বিকেলে শতাধিক মোটরসাইকেল, সিএনজি এবং ঘোড়ার গাড়িতে করে বিশাল শোভাযাত্রা বের করা হয়। শুধু শোভযাত্রা নয়, তাকে ঘিরে পুরো গ্রামে কয়েক দিন ধরে নানা আয়োজন চলে।

শুধু শোভযাত্রা নয়, তাকে ঘিরে পুরো গ্রামে কয়েকদিন ধরে নানা আয়োজন করা হয়। বিদায় বেলায় গ্রামের মানুষ ভালোবেসে নগদ ৩ লাখ টাকার হাদিয়া তুলেছেন। প্রায় ২০ হাজার টাকা দিয়ে একাধিক টাকার মালা দেয়া হয়েছে। এছাড়াও প্রায় প্রত্যেক বাড়ি থেকে পাঞ্জাবি, পায়জামা, টুপি, জুতা ও আসবাবপত্রসহ নানা সামগ্রী দেয়া হয়। ইমামের প্রতি গ্রামের এমন ভালোবাসার কারণে প্রশংসায় ভাসছে এলাকাবাসী।

এলাকাবাসী জানায়, কিশোর বয়সে সুজানগর উপজেলার তাঁতীবন্দ ইউনিয়নের বাড়ইপাড়া গ্রামের সন্তান হাফেজ আবু মুসা পার্শবর্তী উপজেলার যশমন্তদুলিয়া গ্রামের মসজিদের ইমাম ও খতিব হিসেবে দায়িত্ব পালন শুরু করেন। তখন মসজিদটি একেবারে জরাজীর্ণ ছিল। নামাজ আদায়ের তেমন উপযোগী ছিল না। তিনি দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে মসজিদটির উন্নতি ঘটতে থাকে। জরাজীর্ণ মসজিদটি বড় ও উন্নত করা হয়। পাশাপাশি তিনি অবহেলিত এই এলাকায় প্রতিষ্ঠা করেন মাদ্রাসা, ঈদগাহ ও গোরস্থান। এছাড়াও তিনি আশপাশে আরও বেশ কয়েকটি মসজিদ ও মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন। তার নানা উদ্যোগ এলাকার মানুষের মন জয় করে নেয়। এই ৫৩ বছরের মধ্যে তিনি গ্রামবাসীদের আত্মার সঙ্গে মিশে গেছেন।

গ্রামের মানুষ তাকে বিদায় দিতে না চাইলেও বার্ধক্যের কারণে তিনি বিদায় নিতে বাধ্য হন। কিন্তু বিদায় বেদনার হলেও এলাকাবাসী তা কষ্টে মেনে নেন এবং তার সসম্মানে যশমন্তদুলিয়া যুব সমাজের উদ্যোগে আয়োজন করা হয় রাজকীয় বিদায় সংবর্ধনার। অনুষ্ঠানে ইমামকে দেয়া হয় ক্রেস্ট। পরে তাকে ঘোড়ার গাড়ির বহরে করে রাজকীয় অথচ চোখের জলে বিদায় দেওয়া হয়। এ সময় এলাকার মুরুব্বিসহ সর্বস্তরের মানুষ প্রিয় ইমামকে ধরে গাড়িতে তুলে দেন এবং শতাধিক মোটরসাইকেল, সিএনজিসহ ঘোড়ার গাড়িতে করে তার বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে আসেন।

এ সময় সবাই কান্নায় ভেঙে পড়েন। মসজিদের ইমাম কাম-খতিবের এমন রাজকীয় বিদায়ের ভিডিও এবং ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। এরপরই তা ভাইরাল হয় এবং নেটিজেনসহ সর্বস্তরের মানুষের প্রশংসায় ভাসছে এলাকাবাসী।

যশমন্তদুলিয়া গ্রামের স্কুলশিক্ষক রেজাউল করিম জানান, হাফেজ মাওলানা আবু মুছা হেফজ সম্পন্ন করে যশমন্তদুলিয়া কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে ইমামতি ও মক্তবে পড়ানোর চাকরি নেন। চাকরি করছেন, তবে তিনি কোনোদিন বেতন ভাতার জন্য দর কষাকষি করেননি। গ্রামবাসী তাকে যা খুশি দিয়েছেন, তিনি তা না গুণেই নিয়ে নিয়েছেন।

রেজাউল করিম আরো জানান, তিনি তারও ওস্তাদ। তার মতো হাজার হাজার ছেলে-মেয়ে ইমাম সাহেবের কাছে পড়েছেন।

গ্রামের আরেক স্কুলশিক্ষক আকরাম হোসেন জানান, একজন সাদা মনের মানুষ ইমাম আবু মুছা। একই কর্মস্থলে এত বছর তিনি চাকরি করছেন অথচ কারো সঙ্গে তার মনোমালিন্য হয়নি। এজন্য চাকরি বদল করারও দরকার হয়নি। তিনি বয়সের ভারে চাকরি ছাড়তে চাইলেও গ্রামবাসী তাকে এতদিন ছাড়েননি।

এমন রাজকীয় বিদায় সংবর্ধনায় অভিভূত হাফেজ মাওলানা আবু মুছা। তিনি জানান, অনেক কম বয়সে ওই গ্রামে চাকরিতে যান। তখনও দেশ স্বাধীন হয়নি। তাকে যারা চাকরিতে নিয়েছিলেন সেই সব মুরুব্বিরা আজ আর বেঁচে নেই। তবে তাদের সন্তানরা, গ্রামের অন্যান্যরা তাকে ভালোবাসেন, শ্রদ্ধা করেন।

তিনি জানান, তিনি যখন মক্তবে পড়াতেন তখন আশপাশের গ্রামে এত মসজিদ-মক্তব মাদরাসা ছিল না। তাই পার্শ্ববর্তী দহেরপড়া, ক্রোপদুলিয়া, ঘোড়াদহ, ভবানীপুর, জিয়লগাড়ী প্রভৃতি গ্রামের ছেলে মেয়েরা তার মক্তবে পড়তে আসত। তাই তার ছাত্র-ছাত্রী কয়েক গ্রাম জুড়ে রয়েছে। তিনি অসংখ্য ছাত্রীদের কোরান শিক্ষা দিয়েছেন। তদের অনেকেই আজ বড় বড় চাকরি পেয়েছেন। কিন্তু তারা তাকে ভুলে যাননি। তাকে ভালোবাসেন।

তিনি জানান, এ গ্রামের অন্যান্য মসজিদ, ঈদগাহ, কবরস্থান তাকে নিয়েই এলাকাবাসী প্রতিষ্ঠা করেছেন। বয়স হয়ে যাওয়ায় নানা রোগ-ব্যাধিতে আক্রান্ত তিনি। তাই তার পক্ষে আর দায়িত্ব পালন করা সম্ভব হয়নি। তিনি গ্রামবাসীর অনুরোধ সত্ত্বেও চাকরি ছেড়ে এসেছেন বলে জানান।

ব্যক্তি জীবনে তিনি ৩ ছেলে ও ৫ মেয়ের বাবা। তিনি তাদেরকে মাদরাসা শিক্ষা দিয়েছেন। পরে তারা উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করেছেন। দু’ ছেলে চাকরি করছেন, এক ছেলে পড়াশোনা করছেন বলেও জানান। মেয়েদের বিয়ে দিয়েছেন।

যশমন্তদুলিয়া কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ কমিটির সভাপতি মইনউদ্দিন আহমেদ বলেন, মসজিদের ইমাম আবু মুছা দীর্ঘ ৫৩ বছর তাদের মসজিদে ইমাম ও খতিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি বার্ধক্যজনিত কারণে বিদায় নিয়েছেন। গ্রামবাসী তাকে ছাড়তে চাননি। তিনি তাদের গ্রামেরই একজন, পরম আপনজন হয়ে ছিলেন। তিনি ছিলেন তাদের অভিভাবকের মতো।

পাবনা চাঁপাবিবি মসজিদের খতিব আলহাজ্ব সাওলান সিবগাতুল্লাহ জানান, একজন ইমাম সমাজের নেতা। তার এমন সম্মান ও রাজকীয় বিদায় সংবর্ধনা দিয়ে খুবই প্রশংসনীয় কাজ করেছেন এলাকাবাসী।

এমএম

আগামী নিউজ এর সংবাদ সবার আগে পেতে Follow Or Like করুন আগামী নিউজ এর ফেইসবুক পেজ এ , আগামী নিউজ এর টুইটার এবং সাবস্ক্রাইব করুন আগামী নিউজ ইউটিউব চ্যানেলে